পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
সায়ীদ আবদুল মালিক : মেয়েটির নাম আরবিতা। বয়স আনুমানিক ৮ বছর। জামালপুর থেকে মায়ের সাথে ঢাকায় এসেছে রমজান ও ঈদ মৌসুমে ভিক্ষা করতে। মা জুলেনা বেগমসহ দুই ভাই এক বোন মিলে পরিবারের ৪ সদস্য গত শুক্রবার থেকে ঢাকার মতিঝিলে নানা স্থানে ভিক্ষা করছেন। সাথে তাদের বাবা আসেনি। তিনি দেশে ক্ষেতকাম করছেন। ঢাকায় উঠেছেন ভিক্ষুকদের আস্তানা হিসেবে পরিচিত মান্ডায়। তারা শুধু একা এক পরিবার আসেনি। তাদের সাথে আরও বহু পরিবার মান্ডায় ভিক্ষুক সর্দারদের নিয়ন্ত্রণে মান্ডার বিভিন্ন ভাড়া বাড়িতে থেকে রাজধানীর নানা স্থানে ভিক্ষা করছে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে মতিঝিল পূবালী ব্যাংকের সামনে দাঁড়ালে ভিক্ষা চাইতে এলে আরবিতার সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়।
আরবিতা ও তার মা জুলেনা বেগমের সাথে কথা বলে আরও জানা যায়, তারা পরিবারের চার সদস্য গত শুক্রবার থেকে ঢাকায় ভিক্ষা করছে। ঈদ মৌসুমে প্রতিজন দৈনিক ৫ থেকে ৬শ’ টাকা করে ২ থেকে আড়াই হাজার টাকা রোজগার হয়। গত ৪ দিনে ৯ হাজার ৫০০ টাকা রোজগার হয়েছে। আগামী ৭ দিনের আরও ২৫ হাজার টাকা রোজগার হবে বলে তারা আশা করছেন। এই টাকা থেকে ভিক্ষুক সর্দার অর্থাৎ তারা যার নিয়ন্ত্রণে আছে তাকে দিতে হবে ১০ হাজার টাকা। বাকি টাকা নিয়ে তারা ঈদের আগের দিন দেশে চলে যাবেন বলে জানান।
রমজানের ঈদ সামনে রেখে নগরীতে মৌসুমী ভিক্ষুকের সংখ্যা বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত। ভিক্ষুকদের যন্ত্রণায় রাজধানীর ট্রাফিক সিগন্যাল থেকে শুরু করে বিপণিবিতান, মসজিদ-মাজার এমনকি বিমানবন্দরে মানুষ যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ ও বিব্রত। ঢাকায় তাদের সংখ্যাটাও লক্ষাধিক। সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, সারাদেশে প্রায় ৭ লাখ ভিক্ষুক রয়েছে। মৌসুমী ভিক্ষুকের সংখ্যা রাজধানীতে প্রায় ৩৫ হাজারের উপরে। রাজধানী ঢাকায় এ সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। তবে প্রতিবছর দুই ঈদে ভিক্ষুকের সংখ্যা দ্বিগুণ ছাড়িয়ে যায়। যেখানে ঈদের কেনাকাটা হচ্ছে, সেখানে হাঁটাই মুশকিল হয়ে পড়ছে। রাস্তায় যেখানে সেখানে পঙ্গু ভিক্ষুকরা শুয়ে পড়ছে। এতে চলাচলে সমস্যা হচ্ছে। অযথা যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। সড়কের ৭৮টি সিগন্যাল পয়েন্টসহ তিন শতাধিক স্থানে সকাল ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত থাকে একাধিক ভিক্ষুক।
বিকলাঙ্গ, প্রতিবন্ধী শিশু কিংবা একেবারে ছোট্ট শিশুকে ভিক্ষুক সাজিয়ে নামানো হচ্ছে রাস্তায়। শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধে উচ্চ আদালতের নির্দেশ অমান্য করে একশ্রেণীর অসাধু চক্র এ কাজ করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। ভিক্ষাবৃত্তি নিয়ন্ত্রণে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তি পুনর্বাসন আইন। আইনে পুনর্বাসনের সুস্পষ্ট বিধান না থাকায় ভবঘুরে আটক ভিক্ষুকরা প্রত্যাবর্তন করছে ভিক্ষাবৃত্তিতেই। ফলে যে লক্ষ্যে আইনটি প্রণীত হয়েছে সেই লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে। আইনগত ত্রুটি নিরসনের মাধ্যমে ভিক্ষুক পুনর্বাসন জরুরি বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন বিশ্লেষকরা।
শপিংমলের আশপাশের এলাকায় কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়ালে দেখা যায়, ময়লা কাপড় পরা ছোট ছোট শিশু আর নারীরা কোনো কোনো গাড়ির পেছনে দৌড়াচ্ছে। বছর জুড়েই ভিক্ষুকরা নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ভিক্ষা করে বেড়ায়। কিন্তু রোজার সময় মানুষ দান খয়রাত বেশি করে এ আশায় রাজধানীতে ভিক্ষুকের সংখ্যা বেড়ে যায়। ভিক্ষার জন্য হাত-পা জড়িয়ে ঝুলে থাকে। তাই সম্মান বাঁচাতে অনেকে ওদের হাতে টাকা তুলে দিতে বাধ্য হন।
রাজধানীর দুই শতাধিক স্পটে ভিক্ষুকদের আনাগোনা বেশি। নামাজের সময় মসজিদের সামনে ভিক্ষাবৃত্তির মূল জোন। ঢাকার যেসব স্থানে ভিক্ষুকদের ভিড় বেশি সেগুলো হচ্ছেÑ ফার্মগেট, হাইকোর্ট মাজার, শাহবাগ, কবরস্থান, বনানী কবরস্থান, মিরপুর শাহ আলী মাজার, শাহবাগ, গুলশান ১ ও ২ গোলচত্বর, বায়তুল মোকাররম মসজিদ গেট, কাকরাইল মসজিদ, মহাখালী, চকবাজার মসজিদ, আজিমপুর, মতিঝিল, গুলিস্তান গোলাপ শাহ মাজারসহ অনেক স্থানে ভিক্ষুকের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। প্রতিটি কবরস্থানের কাছে, গুলিস্তান গোলাপ শাহ, মিরপুরের মাজার, ব্যস্ততম সড়ক মোহনা বা সিগন্যাল পয়েন্ট যেমন রূপসী বাংলা, সোনারগাঁও হোটেল মোহনা, শান্তিনগর মোড়, ফকিরেরপুল, মগবাজার, ইস্টার্ন প্লাজা, গাউছিয়া, নিউ মার্কেট, মৌচাক মার্কেট।
এসব স্পট ছাড়াও রয়েছে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল, গাবতলী, সায়েদাবাদ, মহাখালী বাস টার্মিনাল। এসব স্থানে ভিক্ষুকরা গজল, হামদ-নাতসহ বিভিন্ন গান গেয়ে বা ক্ষতস্থান দেখিয়ে ভিক্ষা করে।
সরেজমিন দেখা যায়, হাত নেই, পা নেই, অন্ধ, কঙ্কালসার দেহ, অস্বাভাবিক বড় মাথা ও হাত-পা, শরীরের বিভিন্ন স্থানে ঘা এমন বেশ কিছু পুরুষ, মহিলা ও শিশু শহরময় ভিক্ষা করছে। কখনো কখনো এদের বহন করার জন্যও থাকে সুস্থ একজন লোক। এ ছাড়া সামান্য অঙ্গহানি বা সুস্থ দেহের মানুষও ভিক্ষুক সেজে ঘুরছে নগরীতে। তারা বিভিন্ন ক্ষতস্থান দেখিয়ে বা কোলে শিশু নিয়ে ভিক্ষা করে। তবে এসব শিশুর বেশির ভাগই ভাড়া করা। বিভিন্ন বস্তির শিশুকে ৫০ থেকে ৬০ টাকার বিনিময়ে এসব ভিক্ষুকের কাছে ভাড়া দেয়া হয়।
হাইকোর্টের মাজার গেটে সামনে দেখা যায়, আট-নয় বছরের প্রতিবন্ধী একটি মেয়ে শিশুর পায়ের হাঁটু থেকে নিচের দিকে দগদগে ঘা। সেখানে মাছি বসছে বারবার। আর শিশুটি মাছি তাড়াতে ছটফট করছে। ঘায়ের কারণে মাছি যেন তার পিছু ছাড়তে চাইছে না। শিশুটির শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতাকে পুঁজি করে ভিক্ষা চাইছে পাশে বসে থাকা জামেনা বেগম। শিশুটি আপনার কে? জানতে চাইলে জামেনা বলেন, মেয়ের ঘরের নাতি। আবার সচিবালয়ের সামনে দেখা যায়, ছয়-সাত মাস বয়সের একটি শিশুকে কোলে নিয়ে ভিক্ষা করছে রেহানা আক্তার। রেহানার বয়স আনুমানিক আট-নয় বছর। কোলের শিশুটি কে জানতে চাইলে সে বলে, ছোট ভাই। মায়ে কামে গেছে, হের লাইগ্যা ভাইটারে কোলে নিয়ে ভিক্ষা করতে হচ্ছে।
জানা যায়, অনেক মহিলার কোলে থাকে দুগ্ধপোষ্য শিশু। এই শিশুদের বেশির ভাগই তারা আনে বিভিন্ন বস্তি এলাকা থেকে ভাড়া করে। এ ছাড়া একই পরিবারের সবাই মিলেও পাশাপাশি পয়েন্টে ভিক্ষা করে। ভিক্ষুকদের নিয়ন্ত্রণে কোনো উদ্যোগেই কাজ হচ্ছে না। মাঝেমধ্যে ভিক্ষুক পুনর্বাসনের নামে ভিক্ষুক নির্মূল অভিযান চালায় পুলিশ। তাদের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে ধরে ভবঘুরে কিংবা কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। কিন্তু জামিনে বের হয়ে এসে ফিরে যায় আবার সেই আগের পেশায়।
ঢাকার বিভিন্ন ট্রাফিক সিগন্যালে একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী চক্র শিশুদের ঘুমের ওষুধ খাইয়ে নারীদের কোলে দিয়ে ভিক্ষার কাজে ব্যবহার করছে। এদের পাশাপাশি অনেক দরিদ্র বাবা-মাও তাদের শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত করছে। শিশুদের কোমল মুখ ও জরাজীর্ণ অবস্থা দেখে অনেকেই তাদের ভিক্ষা দিয়ে সাহায্য করতে হাত বাড়ান।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ভিক্ষাবৃত্তি নিয়ন্ত্রণকারী চক্রটি ব্যবসার জন্য এতই হিংস্র ও পাষ- হয়ে থাকে যে, তারা শিশুদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ কেটে রক্তাক্ত করে কিংবা হাত-পা ভেঙে পঙ্গু বানিয়ে রাস্তার মোড়ে মোড়ে ফেলে রেখে ভিক্ষা করাতেও দ্বিধাবোধ করে না।
জানা যায়, একশ্রেণীর পাষ- নারীও আছে, যারা টাকার বিনিময়ে কোলের শিশু বিক্রি কিংবা ধার দেয় ওই চক্রের কাছে। তারা অনেক সময় দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকায় কোলের শিশুকে বিক্রি করে দিতেও দ্বিধা করে না। এসব শিশুর অসহায়ত্বকে পুঁজি করে প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা আয় করছে অসাধু চক্রটি। অথচ এসব শিশুকে তারা নামেমাত্র খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখে। একপর্যায়ে এসব শিশু নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে অল্প বয়সে মারা যায়।
শ্যামলী শিশু হাসপাতালের ডা. নাহিদ ফারজানা বলেন, ভিক্ষাবৃত্তির কাজে ব্যবহৃত এসব শিশুকে যদি নিয়মিত কোনো ধরনের ড্রাগ দেয়া হয় তাহলে পরবর্তী সময়ে এসব শিশু ওই ড্রাগে আসক্ত হয়ে পড়বে। এতে অপুষ্টির শিকারসহ শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।