পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
আওলাদ হোসেন শিল্পনগরী টঙ্গীর বাসিন্দা। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। দীর্ঘ চাকরিজীবন শেষ করে অবসরে যান ২০১৩ সালে। এককালীন পেনশনের ২০ লাখ টাকা পেয়ে ওই সময় ১২ শতাংশ মুনাফায় আমানত রাখেন একটি ব্যাংকে। তিন মাস মেয়াদি আমানত হিসাবের মুনাফা থেকে কর ও বিভিন্ন চার্জ কাটার পর প্রথম দুই বছরে প্রতি মাসে গড়ে পেতেন ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা। এ সময় তার বাসা ভাড়া দিতেন আট হাজার টাকা। আর বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিল মিলে খরচ হতো এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৪০০ টাকা।
কিন্তু ৬ বছরের ব্যবধানে আমানতে মুনাফার হার পাঁচ শতাংশের নিচে নেমে আসায় আওলাদ হোসেন তার একমাত্র সঞ্চয় থেকে এখন মাসে পাচ্ছেন আট হাজার টাকা। অথচ এই সময়ে তার বাসাভাড়া পাঁচ হাজার টাকা বেড়ে হয়েছে ১৩ হাজার টাকা। আর গ্যাস-বিদ্যুতের বিলও প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে হয়েছে আড়াই হাজার টাকা। এ ছাড়াও, প্রতিবছর জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে ছয় থেকে সাত শতাংশ।
সার্বিক অবস্থায় দেখা যাচ্ছে, ছয় বছর আগে আওলাদ হোসেন তার আমানত থেকে যে মুনাফা পেতেন, তা এখন নেমে এসেছে অর্ধেকের নিচে। পক্ষান্তরে তার পারিবারিক ব্যয় বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ফলে ব্যাংকের মুনাফার ওপর নির্ভরশীল আওলাদ হোসেনের সংসার এখন আর চলছে না। এ অবস্থায় পরিবার নিয়ে তিনি পড়ছেন বিপাকে। তাই কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ।
এমন চিত্র শুধু আওলাদ হোসেনের ক্ষেত্রেই নয়, অনেক সরকারি চাকরিজীবী এবং প্রবাসীদের পরিবারও দীর্ঘমেয়াদে আমানত রেখেছেন ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার আশায়। তাদের কেউ সন্তানের উচ্চশিক্ষার জন্য, কেউ আবার মেয়ের বিয়ের জন্য। কিন্তু সেই আমানত এখন পড়েছে হুমকির মুখে। আগামী এপ্রিল মাস থেকে আমানতে ৬ শতাংশের বেশি সুদ দেওয়া যাবে না। এই সিদ্ধান্তে বিপাকে পড়েছেন গ্রাহকরা। এর আগে চলতি বাজেটে ৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ হলেই উৎসে কর ১০ শতাংশ কেটে রাখার নিয়মের কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে তিন ভাগের এক ভাগ হয়ে গেছে। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। অথচ আগের অর্থবছরের একই সময়ে এই বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ৪১২ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এ বছর সঞ্চয়পত্রের বিক্রি আগের বছরের চেয়ে ৬৫ শতাংশ কমে গেছে। গত ১০ বছরের মধ্যে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে এই নিম্ন প্রবণতা এবারই প্রথম। আমানতের সুদহার ও সঞ্চয়পত্রে উৎসে করের কারণে গ্রাহকরা আর ব্যাংকে টাকা রাখবে না। এতে বড় সমস্যায় পড়বে পুরো ব্যাংক খাত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমানতের সুদহার শুধু নিচেই নামেনি, মূল্যস্ফীতির হার থেকেও নিচে নেমে গেছে; যা খুবই বিপজ্জনক। এতে আমানতকারীরা একদিকে ব্যাংকে আমানত রাখার ক্ষেত্রে বিমুখ হবেন। ব্যাংকের টাকা বাইরে চলে যাবে। অন্যদিকে অনেকে আবার অর্থ পাচারে জড়িয়ে পড়বেন। যা ব্যাংকিং খাতের জন্য দুঃসংবাদ বয়ে আনবে। এ ছাড়াও, মানুষের হাতে পুঁজি আটকে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পুরো অর্থনীতি। অথচ আমানতের সুদহার কমালেও ব্যাংকগুলো এখনো ঋণের সুদহার ১০ শতাংশের উপরেই রেখেছে। আর তাই নয়-ছয় সুদহারের বলি হতে যাচ্ছেন আমানতকারীরা। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেছেন।
৬ শতাংশ সুদে মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখবে কি না, এ প্রশ্নের জবাবে এবিবির ভাইস চেয়ারম্যান ও এক্সিম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হায়দার আলী মিয়া বলেন, বিদেশেও সুদ কম। তাই আমাদের সুদ কমানো হলেও মানুষ টাকা রাখবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে বার্ষিক মূল্যস্ফীতি এখন ৬ শতাংশের বেশি। এর সঙ্গে ব্যাংকে টাকা রাখলে নানা রকম সেবা মাশুল দিতে হয়। আবার মুনাফার ওপর ১০ শতাংশ কর দিতে হবে। ফলে আমানতে ৬ শতাংশ সুদ কার্যকর হলে আমানতকারীদের তেমন কিছুই থাকবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেছেন, ৬ শতাংশ সুদ নির্দিষ্ট করে দিলে গ্রাহকদের টাকার মান কমে যাবে। এতে ব্যাংকের আমানত কমে যাবে। তখন ঋণ দেওয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাতে পুরো খাতে হযবরল পরিস্থিতি দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ জন্য এসব উদ্যোগ বন্ধ করে সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়াই ভালো।
সূত্র মতে, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের বড় বাধা মনে করা হয়। বেশি সুদে টাকা নিয়ে ব্যবসায় টিকে থাকা কঠিন বলে আসছেন ব্যবসায়ীরা। আর তাই ২০১৮ সালের বাজেট ঘোষণার আগেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যাংক ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার জন্য নির্দেশ দেন। নির্দেশের পর ২০১৮ সালের ২০ জুন বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) সিদ্ধান্ত নেয়, আমানতের সুদহার হবে ৬ শতাংশের নিচে। আর ঋণের সুদহার হবে ৯ শতাংশের নিচে। সুদের এ হার তারা ২০১৮ সালের ১ জুলাই থেকে কার্যকর করার কথাও জানায়। বাস্তবতা হলো- ওই সময় থেকে আমানতের সুদহার ব্যাংকগুলো ৬ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনলেও ঋণের সুদহার ১০ শতাংশের উপরেই রেখেছে। এতে দেশ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সেই সাথে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন আমানতকারীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে আমানতের উপর সুদের হার তিন শতাংশেরও কম। কিছু কিছু ব্যাংক ৬ শতাংশও দিয়ে থাকে। আবার কেউ কেউ তারও বেশি সুদ দেয়।
বেসরকারি ইস্টার্ন ব্যাংক সঞ্চয়ের উপর গ্রাহককে সুদ দেয় ২ থেকে সাড়ে ৩ শতাংশ। ৩ ও ৬ মাস মেয়াদী এফডিআর’র ক্ষেত্রে সাড়ে ৩ এবং ১ বছর মেয়াদী এফডিআর’র ক্ষেত্রে ৪ শতাংশ সুদ দেয়।
ব্যাংক এশিয়া সঞ্চয়ের উপর গ্রাহককে সুদ দেয় ৩ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশ। ৩ ও ৬ মাস মেয়াদী এফডিআর’র ক্ষেত্রে সাড়ে ৫ শতাংশ এবং ১ বছর মেয়াদী এফডিআর’র ক্ষেত্রে ৬ শতাংশ সুদ দেয়।
আবার কিছু কিছু ব্যাংক আমানত সংকট কাটাতে মেয়াদী আমানতে সাড়ে ১০ শতাংশ পর্যন্তও সুদ দিয়ে থাকে। এর মধ্যে পদ্মা ব্যাংক মেয়াদী আমানতে ১০ থেকে সাড়ে ১০ শতাংশ, এনআরবি গ্লোবাল সাড়ে ৭ থেকে ৮ শতাংশ এবং মধুমতি ব্যাংক মেয়াদী আমানতে সাত ৭ শতাংশের উপরে সুদ দেয়।
এদিকে ঋণের সুদহার কমাতে ব্যাংকগুলোকে একের পর এক সুবিধা দিয়েছে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ে তারা প্রতিশ্রুতি দেন, দাবি মানা হলে ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিট বা এক অঙ্কে নামিয়ে আনবেন।
ব্যাংকগুলো যেসব সুবিধা পেয়েছে- সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখার সুযোগ। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিধিবদ্ধ নগদ জমা বা সিআরআর সংরক্ষণের হার সাড়ে ৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ৫ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার নেওয়ার ‘রেপো’ সুদহার ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশে নামানো হয়। এর আগের বছর করপোরেট কর আড়াই শতাংশ কমিয়ে সাড়ে ৩৭ শতাংশ করে সরকার। এ ছাড়া ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের দাবির মুখে এক পরিবার থেকে চারজন পরিচালক এবং একজন পরিচালক টানা নয় বছর থাকার সুযোগ দিয়ে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা হয়।
অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর মাসে ব্যাংকগুলো ক্ষুদ্র ও মাঝারিশিল্পের মেয়াদি ঋণে সুদ নিয়েছে ১২ থেকে সাড়ে ১৬ শতাংশ। দুটি ব্যাংক ১৮ শতাংশ পর্যন্ত সুদে এসএমই ঋণ দিয়েছে। ২০১৮ সালে ব্যাংকের উদ্যোক্তারা যখন সিঙ্গেল ডিজিট সুদে ঋণ বিতরণের ঘোষণা দিয়েছিলেন, ব্যাংকগুলো এসএমইর মেয়াদি ঋণ বিতরণ করে ১১ থেকে ১৫ শতাংশ সুদে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংক খাতে বর্তমানে প্রায় ১২ লাখ কোটি টাকার আমানত রয়েছে। আর ঋণ রয়েছে ১০ লাখ কোটি টাকার মতো। এসব ঋণের মধ্যে ৪০ শতাংশের মতো রয়েছে উৎপাদনশীল শিল্পঋণ। এসব ঋণে বর্তমানে যে হারেই সুদ থাকুক, ১ জানুয়ারি থেকে তা ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছিল।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কাছে ব্যাংক মালিকদের দাবির প্রেক্ষিতে গত ৩০ ডিসেম্বর বেসরকারি ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যান ও এমডিদের সঙ্গে বৈঠক করে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ১ এপ্রিল থেকে ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সব ঋণে সর্বোচ্চ সুদহার হবে ৯ শতাংশ এবং আমানতের বিপরীতে সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ বাস্তবায়নের কথা জানান।
ব্যাংক থেকে সরকারের লাগামহীন ঋণ নেওয়ার কারণে বেরসকারি খাত বঞ্চিত হচ্ছে মন্তব্য করে আহসান মনসুর বলেন, বাজেটে সরকার পুরোবছরের জন্য যে ঋণ নিতে চেয়েছিল তা প্রায় ৫ মাসেই নিয়ে ফেলেছে। “তাহলে বেসরকারি খাত ঋণ পাবে কোথায়? সুদের হার কমলেই কী খুব লাভ হবে?”
বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের পাঁচ মাস নয় দিনে (১ জুলাই থেকে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত) ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৪৭ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা নিয়ে ফেলেছে সরকার। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়েছে ৯ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা। আর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিয়েছে ৩৭ হাজার ২৬১ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরেছে সরকার। অর্থাৎ ১২ মাসে ব্যাংক থেকে সরকারের যে টাকা ধার করার কথা ছিল, তার পুরোটাই পাঁচ মাসে নিয়ে ফেলেছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম রাজস্ব আদায় এবং সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়ায় প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে বাধ্য হয়েই সরকারকে ব্যাংক থেকে প্রচুর ঋণ নিতে হচ্ছে, বলেন আহসান মনসুর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, সুদহার কমাতে চাইলে সবার আগে খেলাপি ঋণ কমানোর কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য শুধু পুনঃতফসিল বা পুনর্গঠন না করে খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর হতে হবে। এক খাতের নামে দেওয়া ঋণ যেন আরেক খাতে ব্যবহার না হয়, সেখানে তদারকি বাড়াতে হবে। এভাবে ব্যাংকের হাতে পর্যাপ্ত তারল্য এলে আমানতের সুদহার না কমিয়েও ঋণের সুদহার কমানো সম্ভব।#
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।