Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সিরিয়ার বিদ্রোহীদের জন্য দেয়া অস্ত্র বিক্রি হচ্ছে জর্দানের কালো বাজারে

প্রকাশের সময় : ২৮ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ইনকিলাব ডেস্ক : সিরিয়ার বিদ্রোহীদের জন্য সিআইএ ও সউদি আরবের দেয়া অস্ত্রশস্ত্র জর্দানের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ধারাবাহিকভাবে চুরি করেছেন এবং কালোবাজারের অস্ত্র ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। সেগুলো কালোবাজারে বিক্রি হচ্ছে। আমেরিকান ও জর্দানি কর্মকর্তারা এ কথা জানান। এসব চুরি করা অস্ত্র দিয়ে গত নভেম্বরে আম্মানে একটি পুলিশ প্রশিক্ষণ স্থাপনায় ২ জন আমেরিকান ও অন্য ৩ ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করা হয় বলে কয়েকমাস ধরে এ হত্যাকা-ের ঘটনা তদন্তকারী এফবিআই কর্মকর্তাদের বিশ্বাস। মার্কিন ও সউদি কর্মকর্তাদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে কয়েকমাস আগে এ অস্ত্র চুরির ঘটনার তদন্ত হয়। আল জাজিরা ও দি নিউইয়র্ক টাইমস যৌথভাবে অনুসন্ধানের পর প্রথমবারের মত এ খবর প্রকাশ করে। ওবামা প্রশাসন জর্দানে এ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখার আশা করলেও লাখ লাখ ডলারের অস্ত্র চুরির এ ঘটনায় সিরিয়ার বাশার বিরোধীদের অস্ত্র প্রদান ও প্রশিক্ষণের বিশৃঙ্খল ও অপরিকল্পিত কর্মসূচির বিষয়টিই প্রকাশিত হয়েছে। সিআইএ ও পেন্টাগন দশকের পর দশক ধরে এ ধরনের কর্মসূচি চালিয়ে আসছে।
জর্দানি কর্মকর্তারা বলেন, এ কর্মসূচির সাথে জড়িত জর্দানি কর্মকর্তারা অস্ত্র বিক্রি থেকে লাভবান হয়েছেন। তারা সে অর্থ ব্যয়বহুল এসইউভি, আইফোন ও অন্যান্য বিলাসবহুল সামগ্রী কেনায় ব্যয় করেছেন।
কালাশনিকভ অ্যাসল্ট রাইফেল, মর্টার ও রকেট চালিত গ্রেনেডসহ এসব অস্ত্র চুরি ও তা কালোবাজারে বিক্রির ফলে অস্ত্র বিক্রির কালোবাজারে নতুন অস্ত্রের বন্যা সৃষ্টি করেছে।
এসব অস্ত্রের বেশিরভাগই কি হয়েছে তা তদন্তকারীরা জানতে পারেননি। কিন্তু অপরাধী নেটওয়ার্ক ও জর্দানের গ্রামীণ গোত্রগুলো নিজেদের অস্ত্রভা-ার সমৃদ্ধ করতে কালোবাজার থেকে এসব অস্ত্র কিনছে। অস্ত্র চোরাচালানিরা দেশের বাইরে অস্ত্র পাচারের জন্য অস্ত্র বাজার থেকে অস্ত্র কেনে।
এফবিআইয়ের ওয়াশিংটন ফিল্ড অফিস আম্মান হত্যকা-ের তদন্ত অব্যাহত রেখেছে।
আমেরিকান ও জর্দানি কর্মকর্তারা বলেন, তদন্তকারীদের বিশ্বাস যে জর্দানি পুলিশ ক্যাপ্টেন আনোয়ার আল জায়েদ যে অস্ত্র ব্যবহার করে ২ জন জর্দানি, ২ আমেরিকান ঠিকাদার ও একজন দক্ষিণ আফ্রিকানকে হত্যা করে তা সিরিয়ার বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির জন্যই জর্দানে এসেছিল।
কর্মকর্তারা বলেন, অস্ত্রের ক্রমিক নং পরীক্ষা করে এ তথ্য জানা গেছে।
জর্দানের সংবাদ মাধ্যম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এইচ. আল মোমানি অস্ত্র চুরির সাথে জর্দানি গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার অভিযোগ একেবারেই ঠিক নয় বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, আমাদের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলোর অস্ত্রশস্ত্রের সঠিকভাবে খোঁজ-খবর রাখা হয় ও সর্বোচ্চ শৃঙ্খলা অনুসরণ করা হয়।
তিনি জেনারেল ইন্টেলিজেন্স ডাইরেক্টরেট বা জিআইডি নামে পরিচিত ক্ষমতাশালী জর্দানি গোয়েন্দা সংস্থাকে একটি বিশ্বমানের সুখ্যাতি সম্পন্ন প্রতিষ্ঠান বলে আখ্যায়িত করেন। জর্দানে জিআইডি প্রধানকে বাদশাহর পর দ্বিতীয় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি মনে করা হয়।
এ বিষয়ে সিআইএ ও এফবিআই প্রতিনিধিরা কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরোধী একটি বাহিনী গড়ে তোলার লক্ষ্যে সিআইএ ও বিভিন্ন আরব গোয়েন্দা সংস্থা মিলে ২০১৩ সালে টিম্বার সাইকামুর সাংকেতিক নামে বিদ্রোহীদের সরাসরি অস্ত্রসজ্জিত করার এ কর্মসূচি শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্র ও সউদি আরব এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক। সউদি আরব তাদের অস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রদান করছে, আর সিআইএর আধা-সামরিক কর্মকর্তারা তাদের কালাশনিকভ, মর্টার, ট্যাংক বিধ্বংসী গাইডেড মিসাইল ও অন্যান্য অস্ত্র ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।
এ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি একটি গোপনীয় বিষয়। এর বাজেট সম্পর্কেও কিছু জানা যায় না। মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, সিআইএ গত তিন বছরে হাজার হাজার বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। আর সেসব প্রশিক্ষণ প্রাপ্তরা রাশিয়া আক্রমণ শুরুর আগে পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্রে সিরিয়া সরকারের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করেছিল।
সিরিয়ার সীমান্ত সংলগ্ন হওয়ায় সিরিয়ার সরকারবিরোধী বাহিনী প্রশিক্ষণের জন্য জর্দানকে বাছাই করা হয়। শুরু থেকেই সিআইএ ও আরব গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বলকান ও ইউরোপের অন্যান্য স্থান থেকে কেনা অস্ত্রবিরোধী বাহিনীর কাছে পৌঁছাতে জর্দানি গোয়েন্দা সংস্থার উপর নির্ভর করে।
এ কর্মসূচি ছিল ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিরুদ্ধে লড়ার জন্য আরেক বাহিনী তৈরির কর্মসূচি এ থেকে ছিল আলাদা। মুষ্টিমেয় কিছু সিরীয় বিদ্রোহীকে প্রশিক্ষণ দেয়ার পর এ কর্মসূচি বন্ধ করা হয়।
জর্দানি ও আমেরিকান কর্মকর্তারা অস্ত্র চুরি প্রাসঙ্গিক তদন্ত বিষয়ে বলতে পরিচয় গোপন রাখেন, কেন না সিরীয় বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ যুক্তরাষ্ট্র ও জর্দানের সরকারী পর্যায়ে গোপনীয় বিষয়।
জর্দানের কর্মকর্তারা বলেন, এ কর্মসূচি পরিচালনা করেন জিআইডির লজিস্টিক কর্মকর্তাদের একটি গ্রুপ যারা এসব অস্ত্র জর্দানে এসে পৌঁছার পর সরাসরি সেগুলো তাদের হাতে আসে। অফিসাররা সেগুলো নির্ধারিত স্থানে ফেলার আগে নিয়মিতভাবে ট্রাকভর্তি অস্ত্র গায়েব করে দেন।
তারপর সেগুলো জর্দানের কিছু বড় অস্ত্রবাজারে বিক্রি করা হয়। প্রধান অস্ত্র বাজারগুলো হচ্ছে দেশের দক্ষিণে অবস্থিত মা’ন, আম্মানের বাইরে সাহাব ও জর্দান উপত্যকা।
জিআইডির বর্তমান প্রধান জেনারেল ফয়সাল আল শুবাকি এ অস্ত্র চুরির বিষয় জানেন কিনা তা পরিষ্কার নয়। তবে কতিপয় জর্দানি গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, জিআইডির কিছু সিনিয়র কর্মকর্তা অস্ত্র কর্মসূচি সম্পর্কে জানেন এবং তারা নিচু পর্যায়ের অফিসারদের কাছ থেকে তা গোপন রেখেছেন।
আমেরিকা ও সউদি আরব অস্ত্রচুরি সম্পর্কে অভিযোগ করার পর জিআইডি এ কর্মসূচির সাথে সংশ্লিষ্ট একজন লেঃ কর্নেলসহ কয়েক ডজন অফিসারকে গ্রেফতার করে। তাদের পরে মুক্তি দিয়ে চাকরিচ্যুত করা হয়। তবে তারা চাকরির পেনশন পাচ্ছেন এবং এ কর্মসূচি থেকে তারা যে অর্থ পেয়েছিলেন তা নিয়ে নেয়া হয়নি।
সিআইএ নেতৃত্বাধীন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি আয়োজনে জর্দানের সিদ্ধান্ত হচ্ছে তাদের মধ্যকার দীর্ঘ অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে সর্বশেষ অধ্যায়। আইসেনহাওয়ারের আমলে এর শুরু। ১৯৫২ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা বাদশাহ হোসেন জর্দানের মাটি থেকে বিভিন্ন গোয়েন্দা কর্মকা- চালাতে দেয়ার বিনিময়ে সিআইএ কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ লাভ করেন। সিআইএর অর্থ ও বিশেষজ্ঞরা তাকে জিআইডি প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে যা তার সরকারের প্রতি অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক হুমকি দমন করে।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন সন্ত্রাস দমন কর্মসূচির জন্য জর্দানকে টাকার বন্যায় ভাসিয়ে দেয়। আমেরিকান ও জর্দানি গুপ্তচররা যৌথভাবে আম্মানের বাইরে একটি সন্ত্রাস দমন কেন্দ্র পরিচালনা করে এবং জর্দানের একটি গোপন বন্দীশালায় সিআইএর আটক করা লোকদের এনে রাখা হয়।
‘স্টেট অব ডিনায়াল’ শিরোনামে ২০০৬ সালে প্রকাশিত বইতে সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড ২০০৩ সালের এক কথোপকথনের কথা স্মরণ করেন যাতে সিআইএর তৎকালীন পরিচালক জর্জ জে. টেনেট জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা কন্ডোলিজা রাইসকে বলেন যে ‘আমরাই জর্দানের গোয়েন্দা বিভাগ সৃষ্টি করেছি এবং এখন তা আমাদের।’
২০০৯ সালে জিআইডি এক জর্দানি ডাক্তারকে সিআইএর কাছে নিয়ে আসে। তিনি বলেছিলেন যে তিনি আল-কায়েদা নেতৃত্বের মধ্যে প্রবেশ করেছেন। তিনি একজন ডবল এজেন্টে পরিণত হন এবং আফগানিস্তানের একটি প্রত্যন্ত এলাকার ঘাঁটিতে বোমা বিস্ফোরণে নিজেকে উড়িয়ে দেন। এতে ৭ জন সিআইএ কর্মচারী ও কয়েকজন জিআইডি অফিসার নিহত হন।
জিআইডির আরেক নাম মুখবারাত। এর সাম্প্রতিক কালের দু’ প্রধানকে দুর্নীতি, টাকা আত্মসাৎ ও ব্যাংক জালিয়াতির দায়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।তাদের একজন জেনারেল সামিহ বাত্তিখি ১৯৯৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত জিআইডির প্রধান ছিলেন। ভুয়া সরকারী চুক্তি দেখিয়ে ৬০ কোটি ডলার ব্যাংক ঋণ গ্রহণকারী চক্রের তিনি অংশীদার ছিলেন এবং আড়াই কোটি ডলার পকেটস্থ করেন। তার ৮ বছর কারাদ- হয়। কিন্তু তা কমিয়ে ৪ বছর করা হয়। তিনি আকাবা উপসাগর তীরস্থ ভিলায় সে দ-ভোগ করছেন।
জেনারেল মোহাম্মদ আল দাহাবি ২০০৫ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত জিআইডির প্রধান ছিলেন। ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর জর্দানে পালিয়ে আসা ইরাকি নাগরিকদের কাছ থেকে জিআইডি কর্মকর্তারা যে লাখ লাখ ডলার আটক করেন তা চুরির জন্য তাকে অভিযুক্ত করা হয়। বিচারকালে জানা যায় যে তিনি প্রাইভেট কারে করে ইরাক থেকে টাকা চোরাচালানের ব্যবস্থা করেন এবং ইরাকি ব্যবসায়ীদের কাছে নাগরিকত্ব বিক্রির সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তার ১৩ বছর কারাদ- ও লাখ লাখ ডলার জরিমানা করা হয়।
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বাশার আল আসাদকে উৎখাতের জন্য বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ দিতে সিআইএকে ব্যবহারের যৌক্তিকতা নিয়ে মার্কিন প্রশাসনের অভ্যন্তরে এক বছরেরও বেশী সময় বিতর্ক চলার পর ২০১৩ সালের এপ্রিলে বিদ্রোহীদের অস্ত্র দেয়ার গোপন কর্মসূচি অনুমোদন করেন।
কাতার চীনে নির্মিত এফএন-৬ কাঁধ থেকে নিক্ষেপযোগ্য অস্ত্র তুরস্ক সীমান্ত দিয়ে সিরিয়ায় পাচারের ব্যয় বহন করে এবং সউদি আরব কোনো কোনো সময় সিআইএর সাহায্যে কেনা হাজার হাজার কালাশনিকভ ও লাখ লাখ রাউন্ড গুলি পাঠায়।
২০১৩ সালের শেষ নাগাদ বিদ্রোহীদের ছোট ছোট গ্রুপকে প্রশিক্ষণ প্রদান ও তাদের সিরিয়ার অভ্যন্তরে পাঠাতে সরাসরি সউদি আরব , ইউ এ ই ও অন্যান্য দেশের সাথে কাজ করে সিআইএ।
আম্মানে বন্দুক হামলাকারী ক্যাপ্টেন জায়েদকে তাৎক্ষণিকভাবে হত্যা করা হয়। তার ভাই ফাদি আবু জায়েদ বলেন, তিনি এখনো মনে করেন তার ভাই নির্দোষ ছিলেন। তিনি এ ধরনের হামলা চালানোর পরিকল্পনা করার কোনো ইঙ্গিত দেননি। তিনি বলেন, জর্দান সরকার এ হত্যকান্ডের ব্যাপারে তার কোনো প্রশ্নের জবাব দেয়নি এবং তার ভাইয়ের ময়নাতদন্ত রিপোর্টও প্রকাশ করেনি। সূত্র আল জাজিরা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সিরিয়ার বিদ্রোহীদের জন্য দেয়া অস্ত্র বিক্রি হচ্ছে জর্দানের কালো বাজারে
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ