Inqilab Logo

শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জননিরাপত্তায় বাঁশ

প্রকাশের সময় : ২৮ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এম. কে. দোলন বিশ্বাস

দেশের বিভিন্ন স্থানে রীতিমত গণসমাবেশ করে স্থানীয় জনগণের হাতে বাঁশ-লাঠি-বাঁশি তুলে দিচ্ছে পুলিশ কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে মাগুরা, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরে জননিরাপত্তায় জনতার হাতে এসব তুলে দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে জঙ্গি দমনে ওই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বেশ জোরেশোরেই বলা হচ্ছে। পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি, ধারাবাহিক গুপ্তহত্যা ও জঙ্গি হামলার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের মনোবল ও সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যেই তাদের ওই উদ্যোগ।
জনতার হাতে বাঁশ তুলে দেয়ায় অবাক হওয়ার কিছুই নেই। কারণ, অনেককাল আগে থেকেই বাঙালি যেমন বাঁশ শব্দের সাথে পরিচিত তেমনই বাঁশের ব্যবহারও করে আসছে হরহামেশায়। কাউকে তিরস্কার করতে, কাউকে ঘায়েল করতে, কাউকে বশ মানাতে আবার কাউকে বধ করতে ‘বাঁশ’ ব্যবহার নতুন নয়। প্রশ্ন হল, ফৌজদারির ৫৪ ধারার ধারায় লাঠি সাথে থাকার দায়ে গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়াই পুলিশ গ্রেফতার করার আইনি সুযোগ পায়। তারপরও ওই লাঠির আদলে বাঁশকে শিল্প হিসেবে জানলেও মহাজোট সরকার বাঁশকে হাতিয়ারের মর্যাদা দিয়েছে।
দেশজুড়ে একের পর এক খুন হওয়ায় অজপাড়াগুলোতে সংখ্যালঘুদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষদের মনে আতংক ছড়িয়ে পড়ছে। মানুষের চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ সমস্যা নিরসনে দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ গ্রামের সাধারণ মানুষের সমন্বয়ে সন্ত্রাস প্রতিরোধে কমিটি গঠন করছে, যার নাম ‘ডিফেন্স পার্টি’। ওই কমিটি রাত-দিন পাহারা দিয়ে সন্ত্রাস প্রতিরোধ করবে। কমিটির প্রতিটি সদস্যর হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে একটি করে বাঁশের লাঠি, বাঁশি ও টর্চলাইট।
গত ১৫ জুন বিকালে মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার বামুন্দি ইউনিয়নের দেবীপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে প্রতিরক্ষা দল গঠনের লক্ষ্যে এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে প্রধান অতিথি জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) হামিদুল আলম গ্রাম প্রতিরক্ষা দলের সদস্যদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘মেহেরপুর জেলায় কোনো সন্ত্রাসীর ঠাঁই হবে না। আপনাদের পাহারারত অবস্থায় কোনো সন্ত্রাসীকে যদি হাতে পেয়ে যান, তাহলে তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলবেন। এর জন্য আপনাদের কোনো হয়রানির শিকার হতে হবে না। যে কোনো মূল্যে জেলাকে সন্ত্রাসমুক্ত করতে হবে। সংখ্যালঘুসহ সাধারণ মানুষকে শান্তিতে বসবাস করার সুযোগ করে দিতে হবে।’ এভাবে জেলার সব গ্রামে একাধিক প্রতিরক্ষা দল গঠন করা হবে বলেও তিনি জানান। সমাবেশ শেষে ওই ইউনিয়নের দেবীপুর, ঘোড়াঘাট ও চক কল্যাণপুর গ্রামের সাধারণ মানুষদের নিয়ে ১০টি প্রতিরক্ষা কমিটি গঠন করা হয়। প্রতিটি কমিটিতে সদস্য সংখ্যা ১০ জন। (তথ্যসূত্র : যুগান্তর- ১৫.০৬.২০১৬)
দেশজুড়ে একের পর এক ধর্মীয় সংখ্যালঘুসহ ভিন্নমতাবলম্বী খুন হওয়ায় মাগুরা জেলার প্রামগুলোতে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে পুণ্যার্থী উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। সমস্যা সমাধানে মাগুরা পুলিশ সুপারের উদ্যোগে গ্রামে গ্রামে চলছে প্রতিরক্ষা দল গঠন কর্মসূচি। রাত জেগে মানুষ গ্রাম পাহারা দিচ্ছে। জানা গেছে, মাগুরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম জানান, ‘সম্প্রতি কিছু গুপ্তহত্যায় সর্বত্র যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে, সেই প্রেক্ষাপটে জেলাবাসীর মধ্য মনে সাহস বাড়ানোর জন্য ওই পদক্ষেপ। এখানে শুধু সংখ্যালঘু নয়, মসজিদের ইমাম, শিক্ষক, পেশাজীবী, ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বারসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। লক্ষ্য, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সব মানুষকে একত্র করে প্রতিরোধ গড়া।’
আমরা মনে করি, জনতার হাতে বাঁশ তুলে দেয়া, নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধানের সর্বোত্তম পন্থা নয়। মোদ্দা কথা, নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। আরও নির্দিষ্ট করে বললে রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। নাগরিকদের হাতে এই দায়িত্ব তুলে দেয়া হলে সেটার অপব্যবহারেরও আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশ শুধু নয়, বিশ্বব্যাপী নিরীহ জনসাধারণের উপর গুপ্ত হামলার পাশাপাশি সার্বিকভাবে সহিংসতার মাত্রা যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে উন্নত-অনুন্নত নির্বিশেষে কোনো রাষ্ট্রের পক্ষেই দায় এড়ানো সম্ভব নয়। বরং যতো সমস্যাই হোক না কেন জনগণের নিরাপত্তা বিধান করাই রাষ্ট্রের নির্ধারিত দায়িত্ব।
বিশেষ করে গুপ্তহত্যার সাথে সংশ্লিষ্ট অপরাধীরা যেসব কৌশল অবলম্বন করে চলছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা ছাড়া তাদের শনাক্ত করা কঠিন। এ ক্ষেত্রে সর্বস্তরের জনগণের সচেতন ও সংঘবদ্ধ ভূমিকা বা প্রতিরোধ যে অপরিহার্য, আমরা তা অকপটে স্বীকার করছি। তবে যে কোনো প্রেক্ষাপটই হোক না কেন, পুলিশের পক্ষ থেকে জনগণের হাতে যে বাঁশ-লাঠি-বাঁশি তুলে দেয়া হচ্ছে, তার তেমন কোনো তাৎপর্য অন্তত আমরা খোঁজে পাই না। জনগণকে নিজেদের নিরাপত্তার ব্যাপারে যেমন বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে তেমন রাষ্ট্র জননিরাপত্তা নিশিচত করবে, এটাই স্বাভাবিক। এটা এখন সময়ের দাবিও বটে।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সহিংসতা ক্রমেই লাগামহীন হয়ে উঠছে। কারণে-অকারণে রক্ত ঝরছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। কিন্তু কারও বোধোদয় হবার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এ চিত্র বিশ্বের অনেক দেশের। অন্যদিকে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকর্তৃক গৃহীত নিরাপত্তার ক্রমবর্ধমান বজ্রআঁটুনিও রুখতে পারছে না ওই রক্তস্রোত। এমন একটি প্রেক্ষাপটে আত্মরক্ষার্থে রাষ্ট্রের পাশাপাশি জনগণের সর্বাত্মক সচেতনতা ও সক্রিয় ভূমিকার যে গুরুত্ব নেই, আমরা কিন্তু তা অস্বীকার করছি না। নিরাপত্তার স্বার্থে জনগণের হাতে আইনসম্মতভাবে অস্ত্র তুলে দেওয়ার দৃষ্টান্ত যে নেই, আমরা এটাও অস্বীকার করি না। প্রশ্ন হচ্ছে, বাঁশ-লাঠি-বাঁশি মানুষের হাতে তুলে দেয়া আইনসম্মত কি-না এবং তা দিয়ে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব কিনা সেটাই প্রশ্ন।
লেখক : দৈনিক সংবাদের সাবেক সহ-সম্পাদক।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জননিরাপত্তায় বাঁশ
আরও পড়ুন