পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
স্টালিন সরকার (রংপুর থেকে ফিরে) : মসজিদে মাগরিবের আজান হচ্ছে। পরিবারের সবাই ইফতার নিয়ে বসেছেন। কেউ ইফতার করেছেন, কেউ আজান শেষ হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। অথচ ঘরের পাশে টিভিতে নাটক চলছে। স্টার জলসা প্রচারিত এ নাটকে শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি, ঢোলবাদ্য বাজছে। ইফতার করেই গৃহকর্ত্রী অন্য ঘরে যাবেন নামাজ আদায় করতে। ২৩ জুন এ দৃশ্য চোখে পড়লো রংপুর সদরের মাহিগঞ্জে ঢাকা-কুড়িগ্রাম মহাসড়কের পাশে।
রাস্তার ধারের ওই বাড়ির ইফতারের সময়ের কা-কারখানার কথা শুনে স্থানীয় ব্যবসায়ী জানালেন, এ দৃশ্য এখন সর্বত্রই দেখা যায়। গ্রাম-গঞ্জের মানুষ ধর্মকর্মের প্রতি ঝুঁকছেন; অথচ ভারতীয় বাংলা চ্যানেলগুলোর অবাধ প্রচারণার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। রংপুর বিভাগের জেলা-উপজেলা শহরগুলোতেই শুধু নয়; গ্রাম-গঞ্জেও এমন চিত্র নিত্য চোখে পড়ে। কোলকাতার টিভিগুলোর সিরিয়াল দেখতে গ্রামের নারীরা মুখিয়ে থাকেন। হিন্দুয়ানী নাটক-সিরিয়ালে বুঁদ হয়ে যায়। রংপুরের গ্রামগুলোর ঘরে ঘরে মা-বোন-শিশুদের টিভি দেখার এ দৃশ্য দেখলে আপনার মনে হবে আপনি কোলকাতার কোনো গলিতে রয়েছেন।
বদলে গেছে রংপুরের চিত্র। এক সময়ের মঙ্গাপীড়িত এলাকার মানুষের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। সড়ক যোগাযোগের উন্নতি হয়েছে। রাস্তায় নামলে প্রাডো, ল্যা- ক্রুজারসহ অসংখ্য বিলাসবহুল গাড়ি চোখে পড়ে। শহরে এসব গাড়ির অনেক শোরুম গড়ে উঠেছে। মার্কেটগুলোয় প্রচ- ভিড়। সাধারণ কৃষক এবং মধ্যবিত্তরা অর্থনৈতিক টানা পোড়েনের মধ্যে থাকলেও ডিশ এন্টেনা পাল্টে দিয়েছে মানুষের যাপিত জীবন। ঘরে ঘরে টেলিভিশন। প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখন ডিশ। এসব ডিশ-এ গ্রামের মা, খালা, চাচী, বোন, মেয়ে, ভাবীরা কোলকাতার চ্যানেল দেখছেন বেশি। স্টার জলসা, জি বাংলা, ইটিভি, তারা টিভি, স্টার প্লাস, জি কালার, সোনি টিভিসহ ভারতীয় চ্যানেলে প্রচারিত অনুষ্ঠান দেখছেন বেশি। রংপুর জেলার কাউনিয়া, মিঠাপুকুর, গঙ্গাচড়া ও পীরগাছা উপজেলার কয়েকটি গ্রামে এ চিত্রই চোখে পড়লো। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, রংপুর বিভাগ শুধু নয়; উত্তরাঞ্চলের সব জেলায় গ্রাম-বাংলার একই অবস্থা। টিভি দেখা মানেই কোলকাতার সিরিয়াল দেখা। রংপুরের এক স্কুল শিক্ষক কথা প্রসঙ্গে জানালেন, ভারতীয় চ্যানেল অবাধে চলায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে সীমান্ত এলাকাগুলোর গ্রামে ভারতীয় চ্যানেল বেশি পরিষ্কার দেখা যায়। আর কোলকাতার চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠানাদি মান-সম্পন্ন যা দর্শক টানছে। আর ঢাকা থেকে প্রচারিত টিভিগুলোর খবরে বিশ্বাসযোগ্যতা কমে যাওয়ায় সাধারণ দর্শক দেশী টিভিগুলো দেখা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। মানুষতো এখন রাজনীতিকদের চেয়ে বেশি গালাগাল করে টকশো’র সবজান্তা টকারুদের। অথচ এক সময় দর্শকরা ঢাকার টিভি’র টকশো শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতো।
রংপুরের কয়েকটি গ্রামে ঘুরে এবং বিভিন্ন এলাকার খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেল, মানুষের জীবন মান উন্নত হওয়ায় হাট-বাজারের সংখ্যা বাড়ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন রাস্তার ধারে, রাস্তার মোড়ে, বড় বড় গাছের নীচে এবং স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার পাশে প্রচুর দোকান, টি স্টল গড়ে উঠেছে। ওই সব দোকানে বাধ্যতামূলক ভাবে টিভি রাখা হয়। মানুষ টিভি দেখতে দেখতে দোকানের মাল খরিদ করেন। যে দোকানে টিভি ডিশ নেই সে দোকানে চা-সিঙ্গাড়া খেতে গ্রাহকরা ঢুকতে চান না। টিভি দেখে আড্ডা দেন, চা-সিঙ্গাড়া খান। এ জন্য ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা প্রতিযোগিতা করে টিভি কিনেছেন। নতুন দোকান দেয়ার সময় বিক্রীর জন্য মালামাল কেনার আগে টিভি কেনেন। আর গ্রাম-গঞ্জেও ডিশের লাইন দেয়ায় সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে টিভি শোভা পাচ্ছে। আগে মানুষ অবসরে উঠোনে বসে গল্প করতো এখন টিভি দেখে সময় কাটায়। কোলকাতার টিভির সিরিয়ালের নারীদের কূটচাল-শঠতা এখন রংপুরের গ্রামগুলোর ঘরে ঘরে।
হারাগাছের এক ব্যবসায়ী জানালেন, দেশের মানুষ রাজনীতি সচেতন হওয়ায় এক সময় ঢাকার টিভিগুলোর টকশো, খবর শোনার প্রতি ঝুঁকে পড়তো। কিন্তু টকশোগুলোতে মিথ্যার বেসাতি, সরকারের তোষামোদী এবং টকারুদের অহরহ মিথ্যা বলায় টকশোর প্রতি মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। একই অবস্থা খবরের ক্ষেত্রেও। কর্পোরেট হাউজ থেকে প্রচারিত অধিকাংশ টিভি চ্যানেল পক্ষপাতিত্বমূলক খবর প্রচার করায় মানুষ সেসব খবর বিশ্বাস করে না। যার কারণে দেশের টিভিগুলোর বিশেষ বিশেষ খবর দেখলেও অধিকাংশ সময় কোলকাতার চ্যানেলগুলোর সিরিয়াল দেখেন। আর ঢাকার টিভি চ্যানেলগুলোর নাটক, গান এবং অনুষ্ঠানাদির মান এতো নিম্নমানের যে, গ্রামের দর্শকরা সেগুলো দেখতে চান না। রংপুর সদরের পাশের গ্রাম তকেয়ার পাড়, সদ্যপুস্কুন্নি, সাত দরগায় দেখা গেল রমজান মাসে রোজা রেখেই ঘরের মহিলা, মেয়ে ও শিশুরা কোলকাতার চ্যানেলে কেউ সিরিয়াল দেখছেন, কেউ রিয়েলিটি শো দেখছেন, কেউ কার্টুন দেখছেন। কোলকাতার টিভিগুলোতে প্রচারিত সিরিয়াল ও নাটকে শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি, মন্দিরের ঘণ্টা, ঢোলবাদ্য, পূজার সরঞ্জাম প্রাধান্য দেয়া হয়। আত্মশুদ্ধির রমজান মাসে সেই অনুষ্ঠান গ্রামের মেয়েরা দেখছেন রোজা রেখেই। রাজধানী ঢাকার শিক্ষিত সমাজের নারীদের মতোই কি আকাশ সংস্কৃতি নামে ভারতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন আমাদের গ্রাম-বাংলার মা, বোন-ভাবী-খালাদের রুচিবোধ ও মানসিকতার বিকৃতি ঘটাচ্ছে? কয়েকটি গ্রামে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গ্রামের শতভাগ মহিলাই রোজা রাখেন। ৮ থেকে ১০ বছরের মেয়েরাও যেমন রোজা রাখেন, তেমনি ছেলেরাও রোজা রাখেন এবং নামাজ পড়েন। অথচ সারাদিন রোজা রেখেই ভারতীয় টিভি’র সিরিয়াল দেখতে অস্থির হয়ে পড়েন কেউ কেউ। কোলকাতা থেকে প্রচারিত চ্যানেলের ওই সব সিরিয়াল এবং রিয়েলিটি শোতে ভাইফোঁটা, ভালবাসা দিবস, উল্কি, হোলিখেলা, রাখিবন্ধন ইত্যাদির প্রতি অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। অথচ রমজান মাসে নারীদের কেউ রোজা রেখে পালা করে কোরআন শরীফ পড়ছেন; আবার কেউ রোজা রেখেই কোলকাতার টিভি’র সিরিয়াল দেখার জন্য অস্থির হয়ে পড়েন। হিন্দী কার্টুন এবং সিরিয়াল দেখার কারণে অনেক শিশু হিন্দী শব্দ উচ্চারণ করছেন। শহরে অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বৃহত্তর রংপুরের হাজার হাজার গ্রামের প্রায় একই চিত্র। বিশেষ করে লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও পঞ্চগড়ের অনেক গ্রামের মানুষ কোলকাতার টিভি’র সিরিয়ালগুলোর চরিত্রের মতোই আচার-আচরণ করেন এবং কথাবার্তা বলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। পারিবারিক বিরোধে কোলকাতার টিভি’র সিরিয়ালগুলো অনুঘটকের কাজ করছে।
বাংলাদেশের চ্যানেলের ভারতে প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকায় বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশী ভারতের বাংলা ভাষাভাষী রাজ্যগুলোতে ঢাকার কোনো চ্যানেল দেখানো হয় না। অথচ বাংলাদেশের দর্শকরা ভারতীয় বাংলা চ্যানেলগুলো দেখছে নিয়মিত। এ সুযোগে তারা বাংলাদেশের অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্যের বিজ্ঞাপন নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের তথাকথিত কিছু সংস্কৃতিসেবীর কোলকাতামুখিতার কারণে রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে বসবাসরত নতুন প্রজন্ম দেশীয় সংস্কৃতির বদলে কোলকাতার সংস্কৃতির প্রতি বেশি দুর্বল। কিন্তু গ্রাম-গঞ্জে সেটা দেখা যায়নি। কোলকাতার সংস্কৃতি এতোদিন গ্রাম-গঞ্জকে গ্রাস করতে পারেনি। কিন্তু ডিজিটালের বদৌলতে এখন ভারতীয় চ্যানেলের অবাধ প্রচারের কারণে কোলকাতার সংস্কৃতির প্রসার ঘটছে রংপুরসহ বাংলার গ্রাম-গঞ্জে। এতে করে দেখা যায় দেশীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্য দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। যা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জগতে বিশাল ক্ষতির কারণ হতে পারে বলে অনেকেই মনে করেন। রংপুরের যারা নিয়মিত ঢাকার চ্যানেল দেখেন তাদের বক্তব্য হলো- ঢাকার চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠানাদির মান ভাল। সরকার ভারতীয় চ্যানেলগুলোর অবাধ প্রবেশাধিকার দেয়ায় মূলত এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কোলকাতার টিভি’র সিরিয়াল ও নাটকের চেয়ে বাংলাদেশী নাটকের কাহিনী, চিত্রগ্রহণ গুণগত মান অনেক উন্নত। বাংলাদেশের নাটকগুলোর ভিডিও চিত্রের মধ্যে বাংলার প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্য ফুটে উঠে এবং সমাজ-বাস্তব জীবনের সাথে মিলিয়ে অনেক নাটকের কাহিনী সাজানো হয়। সেই সাথে থাকে মানুষকে আনন্দ দেয়ার মতো হাস্যকর অনেক কমেডিয়ান চরিত্র। অথচ বাংলার মানুষ দেশীয় কৃষ্টি এবং এত সুন্দর সংস্কৃতি বাদ দিয়ে গ্রহণ করছে কোলকাতার সংস্কৃতি। আগে শুধু রাজধানী ঢাকা এবং বিভাগীয় শহরগুলোর মানুষের মধ্যে এ প্রবণতা ছিল। এখন গ্রাম-গঞ্জের মা-বোন এবং শিশুদের মধ্যে এ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এভাবে যদি মানুষ দেশীয় সংস্কৃতি ভুলে আকাশ সংস্কৃতির নামে কোলকাতার হিন্দুয়ানী শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি ঝুঁকতে থাকে তাহলে দিন দিন হারিয়ে যাবে বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। বিশেষ করে বেগম রোকেয়া, আব্বাস উদ্দীন, শেখ ফজলুল করিমের রংপুর কোলকাতার অপসংস্কৃতির অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।