পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
বিদায় নিলেন দেশের ‘গ্রামীণ জনপদ উন্নয়ন’ কিংবদন্তি স্যার ফজলে হাসান আবেদ। নোবেল বিজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূসের মতোই সারাবিশ্বের মানুষ তাকে এক নামেই চেনেন। গণমানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন, শিক্ষা এবং উন্নয়নের জন্য অভাবনীয় অবদানের জন্য তিনি বহু পুরস্কার ও সম্মান অর্জন করেছেন। এনজিও ব্র্যাকের মাধ্যমে তিনি আত্মমানবতার যে সেবা করেছেন তা ইতিহাসে জায়গা করে নেবে।
দেশে এনজিওতে ভেসে গেছে। দেশের দারিদ্র্যতাকে পুঁজি করে হাজার হাজার এনজিও ব্যবসায় নেমেছে। এদেশের গরিব মানুষের দুঃখ-দুর্দশার চিত্র তুলে ধরে বিদেশ থেকে ডলার-পাউন্ড এসে গাড়ি-বাড়ির মালিক হচ্ছেন। বিশ্বের সবচেয়ে দামি গাড়িতে ঘুরে বেড়ান। নারীর উন্নয়নের নামে নারীদের বেলেল্লাপনায় উদ্বুদ্ধ করেন। এনজিওগুলো যখন সুদের ব্যবসা করে মানুষ এবং সমাজের সর্বনাশ করছেন; তখন এনজিও’র মাধ্যমে উন্নয়নের অন্যান্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ।
তিনি ব্র্যাকের মাধ্যমে মানুষকে স্বাবলম্বীর পাশাপাশি তুরস্কের শিক্ষাব্যবস্থার মতোই দেশের সুবিধাবঞ্ছিত মানুষের ঘরে শিক্ষার আলো জ্বালিয়েছেন। তিনি নারী স্বাধীনতা নয়, নারীর উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন। তিনি দেশের হাজার হাজার বেকার মানুষের কর্মক্ষেত্র তৈরি করেছেন। অন্য এনজিওগুলো যখন বিদেশ থেকে টাকা এনে নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন আর বিলাসি জীবন যাপনে অভ্যস্ত; তখন স্যার আবেদ মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনের কথা চিন্তা করেছেন। তার প্রতিষ্ঠান নিজের পরিবার আর ছেলেমেয়ের বদলে দেশের মানুষের সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। সে জন্যই মৃত্যুর আগে তিনি নিজের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলো কিভাবে চলবে তা নির্ধারণ করে গেছেন। এটা অন্যান্য দৃষ্টান্ত।
বরেণ্য ব্যক্তিত্ব এনজিও ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের দাফন আজ। রাজধানীর বনানী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে। এর আগে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত তার লাশ ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হবে। দুপুর সাড়ে ১২টায় আর্মি স্টেডিয়ামেই নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।
স্যার ফজলে হাসান আবেদ গত শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টায় ইন্তেকাল করেন। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই ব্যক্তিত্বের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে সারাদেশে নেমে আসে শোকের ছায়া। তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে দেশের বরেণ্য ব্যক্তি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, শিক্ষাবিদ, মানবাধিকারকর্মী হাসপাতালে ছুটে যান। বিশ্বের প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলোতে তার মৃত্যুর খবর ফলাও করে প্রচার করা হয়। গতকালও মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে ছুটে যান দেশের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। স্যার আবেদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আজ রোববার তার প্রতিষ্ঠিত সারাদেশের ব্র্যাকসহ সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হবে।
ফজলে হাসান আবেদের মৃত্যুতে তার রুহের মাগফিরাত কামনা করে শোকবার্তা দিয়েছেন মহামান্য প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা। সামাজিক সংগঠন ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোও মরহুম আবেদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন; শোকবার্তা দিয়েছেন। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহম্মদ ইউনূস মরহুমের কর্মময় জীবন তুলে ধরে স্মৃতিচারণমূলক লেখা লিখেছেন। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমানও লিখেছেন স্যার আবেদকে নিয়ে আবেগঘন লেখা।
স্যার ফজলে হাসান আবেদ প্রতিষ্ঠিত ব্র্যাক এখন সারা বিশ্বে পরিচিত। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও সম্মানিত এনজিও। মহান মুক্তিযুদ্ধের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের তৃণম‚লের মানুষের সেবা করতে গিয়ে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেন ফজলে হাসান আবেদ। মাত্র এক লাখ কর্মী নিয়ে শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর ১১টি দেশের ১২০ মিলিয়ন মানুষকে বিভিন্ন সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
বেসরকারি উন্নয়নে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া ফজলে হাসান আবেদ সমাজকর্মের জন্য স্যার উপাধি পেয়েছেন। ব্র্যাক এনজিও ছাড়াও তার প্রতিষ্ঠিত ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক ব্যাংক, মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিস্ঠান বিকাশ, আড়ং, ব্র্যাক ডেইরি, ব্র্যাক চিকেন, ব্র্যাক ফিসারিজ, ব্র্যাক নার্সারি, ব্র্যাক প্রিন্টিং, ব্র্যাক সিল্ক, ব্র্যাক লবণ, ব্র্যাক সিনেটারি ন্যাপকিন অ্যান্ড ডেলিভ্যারি কিট, ব্র্যাক সিডসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দেশের লক্ষাধিক মানুষ কাজ করছেন।
স্যার ফজলে হাসান আবেদ চলতি বছর ব্র্যাকের চেয়ারম্যানের পদ থেকে অব্যাহতি নেন। তাকে প্রতিষ্ঠানটির ইমেরিটাস চেয়ার নির্বাচিত করা হয়। ১৯৭২ সালে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করার পর সংস্থাটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় পরিণত হয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচন ও উন্নয়নে ভূমিকা রাখায় স্যার আবেদ বাংলাদেশ ও বিশ্বের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ অ্যাওয়ার্ড ও সম্মাননা পেয়েছেন। বিশ্বের বহু দেশে ব্র্যাকের উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে।
দেশবরেণ্য উন্নয়নকর্মী ফজলে হাসান আবেদ কর্মময় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য অনেকগুলো আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৮০ সালে র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার, ২০১১ সালে ওয়াইজ প্রাইজ অব অ্যাডুকেশন, ২০১৪ সালে লিও টলস্টয় ইন্টারন্যাশনাল গোল্ড মেডেল, স্প্যানিশ অর্ডার অফ সিভিল ম্যারিট, ২০১৫ সালে বিশ্ব খাদ্য কর্মস‚চি পুরস্কার অর্জন করেন। ২০১৯ সালে তিনি সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্বপ‚র্ণ ব্যক্তি হিসেবে সাউথ এশিয়ান ডায়াসপোরা অ্যাওয়ার্ড, শিক্ষায় ভ‚মিকা রাখায় ইয়াডান পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন।
ফজলে হাসান আবেদ ১৯৩৬ সালের ২৭ এপ্রিল হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচংয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন একজন ভ‚স্বামী। তার মায়ের নাম সৈয়দা সুফিয়া খাতুন। তার পূর্বপুরুষরা ছিলেন ওই অঞ্চলের জমিদার। স্যার আবেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিষয়ে ও পরে ব্রিটেনের গøাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। পরবর্তীতে তিনি শেল অয়েল কোম্পানিতে অর্থনৈতিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন।
ফজলে হাসান আবেদের শিক্ষাজীবন শুরু হয় হবিগঞ্জে। হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণি থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। পরবর্তীতে দেশভাগের ঠিক আগে তার বাবা পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে হবিগঞ্জ থেকে গ্রামের বাড়ি বানিয়াচংয়ে চলে আসেন। পরবর্তীতে তিনি চাচার চাকরিস্থলে ভর্তি হন কুমিল্লা জেলা স্কুলে। সপ্তম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সেখানেই লেখাপড়া করেন। চাচা পাবনায় বদলি হওয়ায় তিনিও চাচার সঙ্গে পাবনায় চলে যান এবং পাবনা জেলা স্কুলে ভর্তি হোন। সেখান থেকেই ১৯৫২ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৫৪ সালে এইচএসসি পাস করেন নটরডেম কলেজ থেকে। সেবছরই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে ভর্তি হন।
১৯৫৬ সালের অক্টোবর মাসে তিনি স্কটল্যান্ডে গিয়ে গøাসগো ইউনিভার্সিটিতে নেভাল আর্কিটেকচারে ভর্তি হন। নেভাল আর্কিটেকচারের কোর্স ছিল চার বছরের। দুবছর লেখাপড়া করে কোর্স অসমাপ্ত রেখে ১৯৫৬ সালে গøাসগো ইউনিভার্সিটি ছেড়ে লন্ডন চলে যান এবং সেখানে ভর্তি হন অ্যাকাউন্টিংয়ে। এখানে কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টিংয়ের ওপর চার বছরের প্রফেশনাল কোর্স পাস করেন ১৯৬২ সালে। এ ছাড়া তিনি ১৯৯৪ সালে কানাডার কুইনস ইউনিভার্সিটি থেকে ‘ডক্টর অব ল’ এবং ২০০৩ সালে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে ‘ডক্টর অব এডুকেশন’ ডিগ্রি লাভ করেন।
মূলত মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে ছোট একটি ত্রাণ কার্যক্রমের মাধ্যমে ১৯৭২ সালে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। গত ৪৭ বছরে বিশ্বজুড়ে অন্তত ১১ কোটি মানুষের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখার মাধ্যমে ব্র্যাক পরিণত হয় বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ও কার্যকর বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায়। ব্র্যাকের উন্নয়ন ব্যবস্থার আওতায় রয়েছে সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ, মাইক্রোফাইন্যান্স, উচ্চশিক্ষা, বিনিয়োগ এবং উন্নয়ন কর্মসূচি। এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের ১১টি দেশে বিস্তৃত রয়েছে সংস্থাটির কার্যক্রম। এছাড়াও ব্র্যাকের অ্যাফিলিয়েট কার্যালয় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে এবং যুক্তরাজ্যে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।