Inqilab Logo

শুক্রবার, ০৫ জুলাই ২০২৪, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

ডয়েচে ভেলে’র প্রতিবেদন ব্রেক্সিটে বাংলাদেশের লাভ-লোকসান

প্রকাশের সময় : ২৬ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ইনকিলাব ডেস্ক : ইইউ থেকে যুক্তরাজ্যের বের হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। শুরু হয়েছে লাভ-লোকসানের হিসাব। খোদ ব্রিটেনে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যেই চলছে এ হিসাব।
লন্ডনে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস মিনিস্টার নাদিম কাদির বলেন, ‘‘যুক্তরাজ্যে, বিশেষ করে লন্ডনে বাংলাদেশী কমিউনিটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বের হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে দ্বিধা-বিভক্ত ছিল, এখনো আছে। যারা ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হওয়ার পক্ষে ছিলেন তারা মনে করছেন এখন এখানে কাজের সুযোগ বাড়বে, দেশ থেকে আত্মীয়-স্বজনকে আনা যাবে, পড়াশোনার সুযোগ বাড়বে। আর যারা এর বিরোধিতা করেছেন তারা বলছেন এর ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে, সামাজিক নিরাপত্তা কমবে।”
তিনি বলেন, ‘‘তবে আশঙ্কার কথা, যুক্তরাজ্যে এখন মধ্যপন্থীদের খারাপ অবস্থা। হয় চরম ডান, নয় চরম বাম। ফলে এরা চাইবে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশীদের জন্য সুযোগ-সুবিধা কমাতে। এইড কমিয়ে দিতে চাইবে। চাইবে শুল্কমুক্ত সুবিধাসহ অন্যান্য সুবিধা কমিয়ে দিতে। এটা বাংলাদেশের জন্য ভয়ের ব্যাপার। তাই এখন থেকেই বাংলাদেশকে সবদিক দিয়ে সতর্কভাবে এগোতে হবে।” নাদিম কাদির জানান, ‘‘বিষয়টি যুক্তরাজ্যের জন্যই স্বস্তির নয়। তারাও একটি জটিল সময় পার করছে। আগামী তিনমাসে আরো অনেক বিষয় স্পষ্ট হবে। নতুন প্রধানমন্ত্রী হবে। আমাদেরও এই সময়টি খেয়াল রেখে এগোতে হবে।” ২০১৩-১৪ অর্থবছরে যুক্তরাজ্যে ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এটি রপ্তানির ক্ষেত্রে তৃতীয় বৃহত্তম দেশ। এর একটি অংশ শুল্কমুক্ত সুবিধায় রপ্তানি হয়।
২৮টি ইউরোপীয় দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জোট ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। ইইউ-র সিদ্ধান্ত ও অঙ্গীকার সব সদস্যের জন্য কার্যকর ছিল, কিন্তু এখন এ জোট থেকে বের হয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণে যুক্তরাজ্যেও ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হবে না। গণভোটের পরে যুক্তরাজ্যের মুদ্রা পাউন্ড দুর্বল হয়ে ১৯৮৫ সালের পর্যায়ে নেমে গেছে এবং এর প্রভাব সাথে সাথে না পড়লেও নিকট ভবিষ্যতে পড়বে। আর যদি প্রভাব নেতিবাচক হয় তাহলে তার ক্ষতি আমাদেরও নিতে হতে পারে।
নাদিম কাদির বলেন, “ব্রেক্সিট নিয়ে সারা পৃথিবীতেই এখন নানা ধরনের হিসেব-নিকেষ চলছে। বাংলাদেশও তার বাইরে নয়।” গণভোটের আগে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত যুক্তরাজ্যের এমপি রুশনারা আলী বলেছেন, “ব্রেক্সিট হলে পাঁচ লাখ বাংলাদেশীর চাকরি হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। ইইউ থেকে বেরিয়ে গেলে অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে বাংলাদেশীসহ এথনিক মাইনোরিটির লোকজনরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
তবে যুক্তরাজ্যে প্রায় ১০ হাজার কারি রেস্টুরেন্ট চালু অবস্থায় আছে এবং প্রায় এক লাখ লোক এখানে কাজ করে। প্রতিবছর এর ব্যবসার পরিমাণ প্রায় ৪ দশমিক ২ বিলিয়ন পাউন্ড। কারি হাউজের শেফদের মধ্যে সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশীদের প্রাধান্য আছে। ইইউতে থাকার কারণেই বাংলাদেশসহ ইউরোপের বাইরের দেশ থেকে কারি শেফ আনতে ভিসা পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ কেউ মনে করছেন, এই সুযোগটি এবার পাওয়া যাবে। তবে তা নির্ভর করছে যুক্তরাজ্যের ভিসা নীতি সহজ হয় কিনা তার ওপর। একক বাজার ও শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের মতো লাভজনক সুবিধার প্রশ্নে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিয়ে ব্রিটেনের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু শুধু পণ্য ও পরিষেবা নয়, নাগরিকদের অবাধ প্রবেশের অধিকার, অভিন্ন মুদ্রা, শরণার্থীদের আশ্রয়ের মতো বিষয় তাদের পছন্দ নয়। এই ভাবমূর্তি কতটা ঠিক, গণভোটে তার প্রমাণ পাওয়া যবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. হেলাল উদ্দিন বলেন, “আসলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্রেক্সিটের কী প্রভাব পড়বে তা বুঝতে আরো সময় লাগবে, কারণ, এর ফলে যদি যুক্তরাজ্য বা ইইউ’র প্রবৃদ্ধি বা অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে আমরাও ক্ষতিগ্রস্ত হব। এখন আমরা ইইউ এবং যুক্তরাজ্যে পণ্য রপ্তানি করছি। আমরা যদি আমাদের প্রাইস লেভেল এবং মান ঠিক রাখতে পারি, তাহলে চাহিদা কমার কারণ নেই।” তিনি আরো বলেন, ‘‘যুক্তরাজ্য ইইউ থেকে বের হয়ে গেলেও সুবিধাটা নিতে চাইবে। ফলে তাদের ইইউ›র অনেক শর্ত মানতে হবে। কেউ চাইবে না অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হোক। তবে একসঙ্গে থাকার সুবিধা ছিল। একসঙ্গে থাকলে প্রবৃদ্ধি অর্জন সহজ হয়।”
ইইউ থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়া রাজনৈতিক সমস্যা দেখছে না আ’লীগ
স্টাফ রিপোর্টার জানান, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত জোট থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজনৈতিক জটিলতার মুখে পড়বে না সরকারি দল আওয়ামী লীগকে। তবে রাজনৈতিক স্বার্থে বাংলাদেশকে এখন পৃথক সম্পর্ক তৈরি করতে হবে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর অন্তত দুটি শক্তিধর দেশ জার্মান ও ফ্রান্সের সঙ্গে। এর বাইরে যুক্তরাজ্যের সঙ্গেও পৃথক নতুন সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। ইতিমধ্যে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরুন তার পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি ব্রিটেনের জোটে থাকার পক্ষে ছিলেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইউ) দেশগুলো থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়ার জনরায় এখন বাংলাদেশকে রাজনৈতিক পৃথক সম্পর্কের দিকে জোর দিতে হবে। ইইউভুক্ত দেশগুলোর ভেতর থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকরা এসব কথা বলেন। ইউরোপীয় ২৮টি দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জোট হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকরা জানান, ইইউতে যুক্তরাজ্যের থাকার কারণে শুধু যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকলেই ইউভুক্ত অন্য দেশগুলোকে নিয়ে তেমন ভাবতে হতো না বাংলাদেশকে। কারণ ইইউভুক্ত ২৮ দেশের প্রায় সবটাকে ‘ডোমিনেট’ করত যুক্তরাজ্য। তাই যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলেই ইইউ নিয়ে তেমন মাথা ঘামানোর প্রয়োজন পড়ত না বাংলাদেশের। সরকারি দলটির নীতি-নির্ধারকরা মনে করেন, যুক্তরাজ্যের জনগণের সরাসরি ভোটে যুক্তরাজ্য আলাদা হওয়ার পর এখন ইইউভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে জার্মান ও ফ্রান্স সবচেয়ে শক্তিধর হয়ে পড়েছে। তাই জার্মান ও ফ্রান্সের সঙ্গে পৃথক সম্পর্ক নতুন মাত্রায় নিতে বেশি করে কূটনীতিক সম্পর্ক বাড়াতে হবে, সেই সঙ্গে রাজনীতিক সম্পর্ক জোরদার করতে হবে। ওইসব নেতারা বলেন, জার্মানের সঙ্গে আমাদের রফতানি সম্পর্ক রয়েছে, তাই সে দেশটির সঙ্গে রাজনৈতিক সুসম্পর্কও জরুরি।
তাছাড়া ইইউভুক্ত দেশগুলো থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক কোনও জটিলতা সৃষ্টি করবে না বাংলাদেশে। তবে বাণিজ্যিক কিছু সমস্যায় পড়তে হতে পারে সরকারকে। এ সমস্যার কারণেই যুক্তরাজ্য ইইউভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে থাকুক তা চেয়েছে বাংলাদেশ সরকার। এজন্য সরকারের জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে ব্রিটেনে পাঠানো হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইচ্ছায়। তিনি বাংলাদেশী কমিউনিটিতে এ ব্যাপারে প্রচার-প্রচরণাও চালিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্রিটেনের ৫২ শতাংশ জনগণ ইইউভুক্ত না থাকার জন্যে ভোট প্রদান করেন।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য নূহ-উল আলম লেনিন বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত জোট থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা বিশ্ব অর্থনীতিতে কিছুটা প্রতিক্রিয়া পড়বে। বাংলাদেশে সরাসরি এর কোনও প্রভাব পড়বে বলে মনে করি না। রাজনৈতিক কোনও সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। ট্রেডিশনাল যে সম্পর্ক তাই অব্যাহত থাকবে।
তিনি বলেন, ব্রিটেনে ইইউভুক্ত জোটে থাকার কারণে ইইউভুক্ত অন্যান্য দেশ নিয়ে তেমন ভাবতে হতো না। এখন ইইউভুক্ত সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।
এ বিষয়ে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়া জনরায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনও প্রভাব পড়বে না। তবে রাজনৈতিক পৃথক সম্পর্ক সৃষ্টির ক্ষেত্রে আমাদের গুরুত্বারোপ করতে হবে।
তিনি বলেন, আগে ব্রিটেনের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলে ইইউভুক্ত অন্য দেশগুলোকে নিয়ে তেমন দুশ্চিন্তা করার দরকার হতো না। এখন ইইউ’র প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে নতুন করে রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে।
প্রসঙ্গত, স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পেয়ে থাকে। ব্রিটেনে এই জোটে থাকুক তা চেয়েছিল সরকারি দল আওয়ামী লীগ। গত মে মাসে জাপানে জি-সেভেন এর আউটরিচ প্রোগ্রামে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরুনের মধ্যে একটি বৈঠক হয়।
জানা গেছে, বৈঠকে শেখ হাসিনা ক্যামেরুনকে বলেনÑ অর্থনৈতিক অগ্রগতি অব্যাহত রাখার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকাটাই যুক্তরাজ্যের জন্য লাভজনক হবে। যদি যুক্তরাজ্য ইইউ থেকে বের হয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয় তবে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা পাওয়ার জন্য যুক্তরাজ্যের সঙ্গে আবার নতুন করে আলোচনা করতে হবে। বিষয়টিকে এতই সিরিয়াসলি গ্রহণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এজন্যে তিনি জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে ব্রিটেনেও পাঠিয়েছেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ডয়েচে ভেলে’র প্রতিবেদন ব্রেক্সিটে বাংলাদেশের লাভ-লোকসান
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ