ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
এস এম সাখাওয়াত হুসাইন
আজ ২০ রমজান মুসলিম উম্মাহর বিজয় দিবস। অষ্টম হিজরির ১০ রমজান প্রায় দশ হাজার আত্মোৎসর্গী সৈন্যের এক বিরাট বাহিনী সঙ্গে নিয়ে বিশ্বসেরা রাষ্ট্রনায়ক হযরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা অভিমুখে রওনা করলেন। পথিমধ্যে অন্যান্য আরব গোত্রও এসে হযরতের সাথে মিলিত হল। কা‘বাগৃহ ছিল খালেস তওহীদের কেন্দ্রস্থল। একমাত্র আল্লাহর বন্দেগীর জন্যে আল্লাহর নির্দেশে এটি নির্মাণ করেছিলেন হযরত ইবরাহীম (আ.)। এ যাবতকাল এটি মুশরিকদের দখলে থেকে শিরকের বড় কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছিল। হযরত মুহাম্মদ (সা.) প্রকৃত পক্ষে হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর প্রচারিত দ্বীনের আহ্বায়ক। এ কারণে তিনি তওহীদের এই পবিত্র স্থানকে শিরকের সমস্ত নাপাকী ও নোংরামী থেকে অবিলম্বে মুক্ত করার একান্ত প্রয়োজন অনুভব করলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) এবার অনুমান করলেন যে, আল্লাহর এই পবিত্র ঘরকে শুধু তাঁরই ইবাদতের জন্য নির্ধারিত করা এবং মূর্তিপূজার সমস্ত অপবিত্রতা থেকে মুক্ত করার উপযুক্ত সময় এসেছে। তাই তিনি চুক্তিবদ্ধ সকল গোত্রের কাছে এ সম্পর্কে পয়গাম পাঠালেন। অন্য দিকে এই প্রস্তুতির কথা যেন মক্কাবাসী জানতে না পারে, সে জন্য তিনি কঠোর সতর্কতা অবলম্বন করলেন।
মুসলিম সৈন্যবহিনী মক্কার সন্নিকটে পৌঁছলে কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান গোপনে তাদের সংখ্যা-শক্তি দেখতে এলেন। এমনি অবস্থায় হঠাৎ তাকে গ্রেফতার করে হযরতের কাছে হাজির করা হলো। ইনি সেই আবু সুফিয়ান, ইসলামের দুশমনি ও বিরোধিতায় যার ভূমিকা ছিল অসাধারণ। এই ব্যক্তিই বারবার মদীনা আক্রমণের ষড়যন্ত্র করেন এবং একাধিকবার রাসূল (সা.)-কে হত্যা করার গোপন চক্রান্ত করেন। এইসব গুরুতর অপরাধের কারণে আবু সুফিয়ানকে সঙ্গে সঙ্গে হত্যা করার কথা ছিল। কিন্তু হযরত (সা.) তার প্রতি করুণার দৃষ্টি প্রসারিত করে বললেন; যাও, আজ আর তোমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে না। আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করে দিন। তিনি সমস্ত ক্ষমা প্রদর্শনকারীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ ক্ষমা প্রদর্শনকারী। আবু সুফিয়ানের সঙ্গে এই আচরণ ছিল সম্পূর্ণ অভিনব। রহমাতুল্লিল আলামীনের এই আচরণে আবু সুফিয়ানের হৃদয় মনে ভাবান্তর সৃষ্টি হল। তিনি বুঝতে পারলেন মক্কায় সৈন্য নিয়ে আসার পেছনে এই মহানুভব ব্যক্তির হৃদয়ে না প্রতিশোধ গ্রহণের মানসিকতা আছে আর না আছে দুনিয়াবী রাজা-বাদশাহের ন্যায় কোন স্পর্ধা-অহংকার। এ কারণেই তাকে মুক্তি দেয়া সত্ত্বেও তিনি মক্কায় ফিরে না গিয়ে ইসলাম কবুল করে হযরতের (সা.) আত্মোৎসর্গী দলে অন্তর্ভুক্ত হলেন।
মক্কায় প্রবেশ : এবার তিনি খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.) কে আদেশ দিলেন; ‘তুমি পিছন দিক থেকে মক্কায় প্রবেশ করো, কিন্তু কাউকে হত্যা করো না। আবশ্য কেউ যদি তোমার উপর অস্ত্র উত্তোলন করে তাহলে আত্মরক্ষার জন্যে তুমিও অস্ত্র ধারণ করো’। এই বলে হযরত (সা.) নিজে সামনের দিক থেকে শহরে প্রবেশ করলেন। হযরত খালিদের সৈন্যদের ওপর কতিপয় কুরাইশ গোত্র তীর বর্ষণ করল এবং তার ফলে তিনজন মুসলমান শাহাদাত বরণ করলেন। খালিদ (রা.) প্রত্যুত্তর দিলেন কাফেরদের ১৩ জন নিহত হল এবং বাকিরা পালিয়ে গেল। রাসূল (সা.) এ ঘটনার কথা জানতে পেরে খালিদ (রা.)-এর কাছে কৈফিয়ত তলব করলেন। তিনি প্রকৃত ঘটনা জানতে পেরে বললেন; ‘আল্লাহর ফয়সালা এরকমই ছিল’। পক্ষান্তরে তিনি কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই মক্কায় প্রবেশ করলেন। তাঁর সৈন্যদের হাতে একজন মানুষও নিহত হল না।
মক্কায় সাধারণ ক্ষমা : রাসূলুল্লাহ (সা.) মক্কায় প্রবেশ করে কোনো প্রতিশোধ গ্রহণের কথা বললেন না, বরং তিনি এই মর্মে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন; ১. যারা আপন ঘরের দরজা বন্ধ করে থাকবে তারা নিরাপদ ২. যারা আবু সুফিয়ানের ঘরে থাকবে তারাও নিরাপদ এবং ৩. যারা কা‘বাগৃহে আশ্রয় নিবে তারাও নিরাপদ। তিনি কি অবস্থায় মক্কায় প্রবেশ করলেন তা উল্লেখযোগ্য। তার পতাকা ছিল সাদা ও কালো রঙের। মাথায় ছিল লৌহ শিরস্ত্রাণ এবং তার ওপর ছিলো কালো পাগড়ী বাঁধা। তিনি উচ্চস্বরে সূরা ফাতাহ তিলাওয়াত করছিলেন। সর্বোপরি আল্লাহ তা‘আলা সমীপে তাঁর এমনি বিনয় ও ন¤্রতা প্রকাশ পাচ্ছিল যে, সওয়ারী উটের ওপর ঝুঁকে পড়ার ফলে তার মুখমন্ডল যেনো উটের কুঁজ স্পর্শ করছিল। মক্কা বিজয়ের এই ঘটনার সাথে আধুনিক কালের কোন রাজ্য জয়ের ঘটনাকে তুলনা করলেই ইসলাম ও জাহিলিয়াতের পার্থক্যটা স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। জাহিলিয়াতের ঝা-াবাহীরা বিজয়কে মনে করে নিজেদেরই কৃতিত্বের ফসল। তাই বিজয় উৎসবের নামে তারা প্রকাশ করে দানবীয় উল্লাস। আর সে উল্লাসের শিকার হয় অসহায় ও নিরস্ত্র মানুষ।
কা‘বা গৃহে প্রবেশ : রাসূলুল্লাহ (সা.)কা‘বা ঘরে প্রবেশ করে সর্বপ্রথম মূর্তিগুলোকে বাইরে ছুঁড়ে ফেলার নির্দেশ দিলেন। তখন কাবাগৃহে ৩৬০টি মূর্তি বর্তমান ছিল। দেয়ালে ছিল নানারূপ চিত্র অংকিত। এর সবই নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হলো। এভাবে আল্লাহর পবিত্র ঘরকে শিরকের নোংরামী ও অপবিত্রতা থেকে মুক্ত করা হলো। এরপর রাসূল (সা.) তকবির ধ্বনি উচ্চারণ করলেন, ক‘াবাগৃহ তওয়াফ করলেন। এই ছিল তাঁর বিজয় উৎসব। এ উৎসব দেখে মক্কাবাসীদের হৃদয়-চক্ষু খুলে গেল। তারা দেখতে পেল, এতোবড় একটি বিজয় উৎসবে বিজয়ীরা না প্রকাশ করলো কোনো শান-শওকাত আর না কোনো গর্ব-অহংকার, বরং অত্যন্ত বিনয় ও কৃতজ্ঞতার সাথে তারা আল্লাহর কাছে অবনমিত হচ্ছে এবং তার প্রশংসা ও জয়ধ্বনি উচ্চারণ করছে। এই দৃশ্য দেখে কে না বলতে পারে যে, প্রকৃতপক্ষে এ বাদশাহী কিংবা রাজত্ব নয়, এ অন্য কিছু। এটা ছিল মানবরচিত আইন-কানুনের বিরুদ্ধে আল্লাহর সার্বোভৌমত্ব ও একত্ববাদের মহা বিজয়।
বিজয়ের পর ভাষণ : বিজয়ের পর তিনি ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। তাতে তিনি বলেন, ‘এক আল্লাহ ছাড়া কোনো মা‘বুদ (ইলাহ) নেই; কেউ তার শরীক নেই। তিনি তাঁর সব ওয়াদা সত্যে পরিণত করেছেন। তিনি তাঁর বান্দাদের সাহায্য করেছেন এবং সমস্ত শত্রুবাহিনীকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। জেনে রেখো; সমস্ত গর্ব-অহংকার, সমস্ত পুরোনো হত্যা ও রক্তের বদলা এবং তামাম রক্তমূল্য আমার পায়ের নীচে। কেবল ক‘াবার তত্ত্বাবধান এবং হাজিদের পানি সরবরাহ এর ব্যতিক্রম। হে কুরাইশগণ! জাহিলী আভিজাত্য ও বংশ-মর্যদার ওপর গর্ব প্রকাশকে আল্লাহ নাকচ করে দিয়েছেন। সমস্ত মানুষ এক আদমের সন্তান আর আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে মাটি থেকে। অতঃপর তিনি নি¤েœাক্ত আয়াত পাঠ করলেন। লোক সকল! আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের নানা গোত্র ও খান্দানে বিভক্ত করে দিয়েছি, যেন তোমরা একে অপরকে চিনতে পার। কিন্তু আল্লাহর নিকট সম্মানিত হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যে অধিকতর আল্লাহভীরু। আল্লাহ মহাবিজ্ঞ ও সর্বজ্ঞ। (সূরা হুজরাত : ১৩)
ইসলামের শ্রেষ্ঠতম বিজয়ী তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ বিজয়ের পর যে ভাষণ দেন, এই হচ্ছে তার নমুনা। এতে না আছে তাঁর দুশমনদের বিরুদ্ধে কোন জিঘাংসা, না আছে কোনো বিদ্বেষ। এতে না আছে তাঁর আপন কৃতিত্বের কোন উল্লেখ আর না তাঁর আত্মোৎসর্গী সহকর্মীদের কোন প্রশংসা, বরং প্রশংসা যা কিছু, তা শুধু আল্লাহরই জন্যে আর যা কিছু ঘটেছে তা শুধু তারই করুণার ফলমাত্র।
শত্রুর হৃদয় জয় : হযরত মুহাম্মদ (সা.) যে জনসমাবেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন, যেখানে বড় বড় কুরাইশ নেতারা উপস্থিত ছিলেন, যারা ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য চেষ্টা করেছিলেন, ইসলামপন্থীদের বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত করেছিলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের দিকে তাকালেন এবং জিজ্ঞেস করলেন,; বলো তো, আজ তোমাদের সঙ্গে আমি কিরুপ আচরণ করবো? তারা সবাই বলে উঠল আপনি আমাদের সম্ভ্রান্ত ভ্রাতা ও সম্ভ্রান্ত ভ্রাতুস্পুত্র। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা করলেন; ‘যাও, আজ আর তোমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই; তোমরা সবাই মুক্ত।
লেখক : সাংবাদিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।