Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দূতাবাসের দুর্নীতি ও কয়েকটি এজেন্সির দৌরাত্ম্য বাড়ছে অভিবাসন ব্যয়

নজরদারি বৃদ্ধির দাবি ফোরাবের

শামসুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ৪ ডিসেম্বর, ২০১৯, ৯:০৭ পিএম | আপডেট : ৯:১৪ পিএম, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৯

দূতাবাসের দুর্নীতি ও কয়েকটি এজেন্সির গঠিত সিন্ডিকেটের দৌরাত্মে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে অভিবাসন ব্যয়। সিন্ডিকেটের কারসাজি ও দূতাবাসের দুর্নীতির কারণে সরকার নির্ধারিত অভিবাসন ব্যয় দ্বিগুণের চেয়েও বেশি বেড়ছে। এতে জনশক্তি রপ্তানিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। জনশক্তি রফতানির সর্ববৃহৎ বাজার সউদী আরবে সরকার নির্ধারিত অভিবাসন ব্যয় সর্বোচ্চ ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। কিন্তু কতিপয় এজেন্সির কারসাজি ও দূতাবাসের অসাধু কর্মকর্তাদের অনৈতিক চাহিদার ফলে এই ব্যয় ৩ থেকে ৪ লাখ টাকায় পৌঁছে যায়। দেশের আরেক বৃহৎ শ্রমবাজার মালয়েশিয়ারও একই অবস্থা। সরকার ৩৭ হাজার ৫০০ টাকায় মালয়েশিয়ায় প্রথমে লোক পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু সিন্ডিকেটের চাপে পরবর্তীতে সে অভিবাসন ব্যয় বাড়িয়ে সরকার ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা নির্ধারণ করে। তবে সিন্ডিকেটের কারণে বাস্তবে সেই ব্যয় হয় ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা। এই অনৈতিক অভিবাসন ব্যয়ের কারণে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ড, মাহাথির মোহাম্মদ ২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়া বন্ধ করে দেন। এই বৃহৎ শ্রমবাজারের দ্বার এখনো খুলেনি। কুয়েত, কাতার, ওমানসহ অন্যান্য দেশেও একইভাবে বাড়ে অভিবাসন ব্যয়। এতে বাংলাদেশের শ্রমবাজার হুমকির মুখে পড়েছে।
ঢাকাস্থ সউদী দূতাবাসের একগুয়েমি এবং অনৈতিক কর্মকান্ডের দরুণ প্রায় ৪০ হাজার পুরুষ (কোম্পানীর) ভিসায় কর্মীর সউদী আরব গমনে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১০ হাজার ড্রাইভিং ভিসার কর্মীও রয়েছে। সউদী দূতাবাসে ভিসা ইস্যু নিয়ে দুর্নীতি সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। সউদী দূতাবাস বর্তমানে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ফলে জনশক্তি রফতানির সর্ববৃহৎ সউদীর শ্রমবাজারে চরম হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। ভুক্তভোগি একাধিক জনশক্তি রফতানিকারক এসব অভিযোগ করেছেন।

বর্তমানে সউদী আরবে ১৫ লক্ষাধিক নারী-পুরুষ কর্মী কঠোর পরিশ্রম করে প্রচুর রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে। সউদী গমনেচ্ছু কর্মীরা এখন চড়া সুদে ঋণ নিয়ে এবং ভিটেমাটি-গবাদিপশু বিক্রি করে অভিবাসন ব্যয় যোগাতে হিমসিম খাচ্ছে। সউদী দূতাবাসের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার অনৈতিক চাহিদা মেটাতে গিয়ে দফায় দফায় অভিবাসন ব্যয় বাড়ছে। সউদীতে কর্মী প্রেরণে সরকার নির্ধারিত অভিবাসন ব্যয় ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। কিন্ত দূতাবাসের অনৈতিক চাহিদা মেটাতে গিয়ে কর্মীদের ব্যয় হচ্ছে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দূতাবাসের কথিত এ-ক্যাটাগরি ও বি-ক্যাটাগরির বেড়াজালে পড়ে শত শতি রিক্রুটিং এজেন্সির সউদী গমনেচ্ছু কর্মীরা দিশেহারা। বিপুল সংখ্যক রিক্রুটিং এজেন্সি এ-ক্যাটাগরির শর্তের কারণে হাজার হাজার কর্মী বৈধ চাহিদাপত্র পেয়েও ভিসার জন্য পাসপোর্ট জমা দিতে পারছে না। তাদের মোফার (ভিসার) ও কর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার মেয়াদও শেষ হয়ে যাচ্ছে।

ফিমেল ওয়ার্কার্স রিক্রুটিং এজেন্সিজ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ফোরাব) এর সভাপতি টিপু সুলতান গতকাল বুধবার ইনকিলাবকে বলেন, কতিপয় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মার্কিন ডলারে নির্ধারিত ঘুষ না দিলে সউদীর ভিসা মিলছে না। সউদী দূতাবাসের ঘুষ বাণিজ্য এখন ওপেন সিক্রেট হয়ে দাঁড়িয়েছে। দূতাবাসগুলোর ওপর নজরদারী না থাকায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি বলেন, সউদী দূতাবাসের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার অনৈতিক কর্মকাÐের কারণে বিদেশগামী কর্মীদের নাভিশ্বাস উঠেছে। ভিসা ইস্যু নিয়ে সউদী দূতাবাস দুর্নীতির সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। ফোরাব সভাপতি বলেন, সউদী দূতাবাসের নানা শর্তের কারণে বর্তমানের বিভিন্ন রিক্রটিং এজেন্সির প্রায় ৪০ হাজার কর্মীর সউদী যাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সউদীগামী নিরীহ কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত এবং জনশক্তি রফতানির খাতকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য সউদী দূতাবাসের ঘুষ বাণিজ্য বন্ধে জরুরি ভিত্তিকে গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি বাড়ানোর জন্য সরকারের প্রতি তিনি জোর দাবি জানিয়েছেন।

সান সাইন ওভারসীজের স্বত্বাধিকারী মো. আনোয়ার হোসাইন গতকাল রাতে ইনকিলাবকে বলেন, মার্কিন ডলারের নির্ধারিত ঘুষ ব্যতীত সউদীর ভিসা মিলছে না। তিনি বলেন, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ও বায়রার দায়িত্বহীনতার কারণে সউদী দূতাবাসের অসাধু কর্মকর্তারা কয়েকটি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে ভিসা ইস্যু করে ঘুষের কোটি কোটি টাকা পাচার করে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, অবিলম্বে ঢাকাস্থ সউদী দূতাবাসের অসাধু কর্মকর্তাদের ঘুষ বাণিজ্য বন্ধ ও বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মীদের অহেতুক হয়রানি রোধে সরকারের কার্যকরী উদ্যোগ নেয়া জরুরি। অন্যথায় জনশক্তির সউদীর বৃহৎ শ্রমবাজারে ধস নেমে আসতে পারে।

বিএমইটির সূত্র জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সউদীতে ৩ লাখ ১৯ হাজার ৩৬৪ জন পুরুষ মহিলা গৃহকর্মী চাকুরি লাভ করেছে। ২০১৭ সনে দেশটি ৫ লাখ ৫১ হাজার ৩০৮ জন কর্মী চাকুরি লাভ করেছে। ২০১৮ সনে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৩১৭ জন কর্মী সউদীতে চাকুরি লাভ করেছে। ১৯৯১ সন থেকে সউদীতে শুধু মহিলা গৃহকর্মীই চাকুরি লাভ করেছে ৩ লাখ ৩২ হাজার ২০৪ জন। ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরের জানুয়ারি থেকে গত জুন মাস পর্যন্ত সউদী থেকে প্রবাসী কর্মীরা ৩১১০ দশমিক ৩৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্সে দেশে পাঠিয়েছে। গত জুলাই মাসেই সউদী প্রবাসীরা ৩৩১ দশমিক ২৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দেশে পাঠিয়েছে।

বায়রার ইসির অন্যতম সদস্য মোহাম্মদ আলী গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, সউদী দূতাবাসের অসাধু কর্মকর্তাদের ঘুষ বাণিজ্যের কারণে জনশক্তি রফতানিতে অশনি শঙ্কেত দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, প্রতিটি হাউজ ড্রাইভার ভিসা বাবদ ৫শ মার্কিন ডলার, কোম্পানীর ড্রাইভার ভিসার ৭শ ডলার এবং যে কোনো কোম্পানীর ভিসার জন্য দূতাবাসে ২৩০ ডলার ঘুষ দিতে হয়। কয়েকটি অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে অনৈতিক ভাবে পাসপোর্ট জমা দিলে ৬/৭ ঘন্টায়ই ভিসা মিলছে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সউদী দূতাবাসের ঘুষ বাণিজ্যের বিষয়টি বায়রার মহাসচিবকেও অবহিত করা হয়েছে। বায়রা নেতা মোহাম্মদ আলী বলেন, সউদী মুসানেদ প্রায় তিনশ’ রিক্রুটিং এজেন্সির সার্ভার বন্ধ করে রেখেছে। বিএমইটিও ১৭০টির মতো এজেন্সির সার্ভার বøক করে রেখেছে। সউদী দূতাবাস গামকার আবগ্রেড নানা অনিয়মের কারণে প্রায় আড়াইশ এজেন্সির সার্ভার বøক করেছে। কেউ কেউ মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে দূতাবাস থেকে ছাড় পাচ্ছে । এতে জনশক্তি রফতানিতে নানা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।

দূতাবাসের নানা হয়রানির কারণে আল খামিজ, গ্রীণ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল, সিটি এয়ার, জাভেদ ওভারসীজ ও মাস ট্রেড এজেন্সি কর্মীদের পাসপোর্ট দূতাবাসে জমা দিতে পারছে না। এতে কর্মীদের ভিসা ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার মেয়াদও শেষ হয়ে যাচ্ছে। যেসব কর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার মেয়াদ শেষ হতে ২/১ দিন বাকি সেসব কর্মীর কিছু পাসপোর্ট জমা নিচ্ছে বলে জানা গেছে। জে এস কে ট্রাভেলস, আল ইসলাহ, সাসকো’র মাধ্যমে পাসপোর্ট জমা দিলে দূতাবাস দ্রুত ভিসা দিচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠছে। বায়রার সদস্য মোহাম্মদ রিপন বলেন, ঢাকাস্থ সউদী দূতাবাসে রাষ্ট্রদূতের পদটি দীর্ঘ দিন যাবত খালি রয়েছে। এতে কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা ভিসা ইস্যু নিয়ে দেদারসে ঘুষ লেনদেন চালিয়ে যাচ্ছে। নতুন রাষ্ট্রদূত এলেই এসব ঘুষ বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

এদিকে, গামকা (গালফ অ্যাপ্রুভ মেডিক্যাল সেন্টার এসোসিয়েশন) নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশের ১৫টি মেডিক্যাল সেন্টারকে অকার্যকর ঘোষণা করেছে। এতে মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের ভাব মর্যাদা ক্ষুন্ন হচ্ছে। জনশক্তি রফতানির এই সর্ববৃহৎ শ্রমবাজার ধরে রাখতে না পারলে রেমিট্যান্স খাতে বড় ধরনের ধাক্কা আসতে পারে। একাধিক রিক্রুটিং এজেন্সির স্বত্বাধিকারি এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

রাতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শেখ রফিকুল ইসলামের সাথে আলাপকালে সউদী দূতাবাসে ভিসা ইস্যু নিয়ে বৈদেশিক মূদ্রায় ঘুষ বাণিজ্য সর্ম্পকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়টি আপনারা প্রবাসী সচিবকে অবহিত করুন। এসব দুর্নীতি হয়ে থাকলে তিনি অবশ্যই ব্যবস্থা নিবেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ