Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রাসূলুল্লা (সা:)-এর বাশারিয়াত

এ. কে. এম. ফজলুর রহমান মুন্শী | প্রকাশের সময় : ২৮ নভেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

মু’জ্বিযার বিস্ময়কর অবস্থাকে যাদু বলে তারা স্বীকার করেছে, কিন্তু তারপরও মানুষ নবী হতে পারে এ ধারণাকে তারা মেনে নিতে পারছিল না। তাই তাদেরকে বলা হয়েছিল যে, নবুওত ও রিসালতের গুণাবলী সম্পর্কে তোমাদের চেয়ে তারাই বেশি জানে, যাদেরকে কিতাব দান করা হয়েছিল। অর্থাৎ ইহুদি স¤প্রদায়ের কাছে জিজ্ঞেস করো। কেননা, তারাও জানে রাসূল এবং নবী মানুষই হয়ে থাকেন। এ প্রসঙ্গে আল-কোরআনে এরশাদ হচ্ছে- “এবং আমি তোমার পূর্বে কাউকে রাসূলরূপে প্রেরণ করিনি কিন্তু মানুষের মাঝেই একজনকে, যাদের কাছে আমি অহী প্রেরণ করতাম, আর তোমরা যদি না জেনে থাক তাহলে যারা জ্ঞাত আছে তাদের কাছে জিজ্ঞেস করে নাও।” (সূরা আম্বিয়া : রুকু-১)

একই প্রত্যুত্তর সূরা ইউসুফেও বিবৃত হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে- “আমি তোমার পূর্বে যে সকল রাসূল পাঠিয়েছি, তারাও মানুষ ছিলেন, জনবসতিতে বসবাসকারী, যাদের মাঝে আমি অহী পাঠিয়েছিলাম।” (সূরা ইউসুফ : রুকু-১২)

এর চেয়েও বিস্তৃত আলোচনা সূরা নহলে এসেছে। সেখানে এরশাদ হচ্ছে- “তোমার পূর্বে আমি প্রত্যাদেশসহ মানুষই প্রেরণ করেছিলাম, তোমরা যদি না জান তবে জ্ঞানবানকে জিজ্ঞেস কর। আমি প্রেরণ করেছিলাম স্পষ্ট নিদর্শন ও গ্রন্থসহ এবং তোমার প্রতি কোরআন অবতীর্ণ করেছি, মানুষকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য বা তাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছিল, যাতে তারা চিন্তা করে।” (সূরা নহল : রুকু-৬)

প্রত্যেক বিবেকবান ব্যক্তি যদি উপরোল্লিখিত সাদৃশ্য ও মানবীয় গুণাবলী সম্পর্কে এর অবস্থার প্রতি লক্ষ্য করে তাহলে অবশ্যই বুঝতে পারবে যে, এর সম্পর্ক বাহ্যিক অঙ্গাবয়ব, শারীরিক শক্তি ও মাখলুক হওয়ার সাথে বিজড়িত। অন্যথায় আখলাকী, রূহানী, দেমাগী, কলকী, এলমী ও আলমী বিষয়াদির ক্ষেত্রে একজন পয়গাম্বর মানুষ হওয়া সত্তে¡ও যারা নবী নন এমন শ্রেণীর লোকদের হতে বহু ঊর্ধ্বে মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী হয়ে থাকেন।
নবী এবং নবীহীনদের মাঝে বিভেদকারী মানদন্ড হিসেবে অহীকে স্থিরীকৃত করার অর্থ এই নয় যে, নবী আল্লাহর বার্তা লাভ করার সাথে সম্পৃক্ত হওয়া ছাড়া বাকি অন্যান্য গুণাবলী ও ত্রæটিসমূহের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের পর্যায়ভুক্ত হয়ে যাবেন। একথা বলা এমন যে, কেউ বললো, আলেম এবং জাহেলদের মাঝে প্রার্থক্য শুধু এলেম বা জ্ঞান। তাছাড়া উভয়েই একই রকম মানুষ। একথার অর্থ এমন হতে পারে না যে, জ্ঞান ও মূর্খতা ছাড়া অন্যান্য সদগুণাবলী ও বদগুণাবলীর ক্ষেত্রেও তারা সমান সমান। প্রকৃতপক্ষে তাদের মাঝে জ্ঞান, চরিত্র, সভ্যতা, আচরণ, রায় এবং হেকমত ও প্রজ্ঞার ক্ষেত্রে কোনই প্রভেদ নেই? অথচ দু’জনের মাঝে জ্ঞান ও মূর্খতার বিভেদ তুলে ধরে এদের মাঝে জ্ঞান ও জ্ঞানহীনতার হাজারো উপাদান, গুণাবলী এবং বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত বিভেদ ও প্রার্থক্য স্বীকার করে নেয়া হয়।

অনুরূপভাবে অহী লাভকারী ও যারা অহী লাভ করেনি তাদের কথা বলতে গিয়েও এ দু’য়ের মাঝে হাজারো বৈশিষ্ট্য, গুণাবলী, সহায়ক অবস্থার প্রার্থক্যকেও মেনে নেয়া হয়েছে। সুতরাং অহী এবং রিসালতের কথা বাদ দাও, অন্যান্য লোকদের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদাকে সামনে রেখে চিন্তা কর তাহলে এ কথাটা স্বীকার করে নিতে হবে যে, মানুষের জন্য যে সকল গুণাবলী ও শ্রেষ্ঠত্ত হওয়া সম্ভব, এগুলোর ঊর্ধ্বতম পর্যায় হতে সর্বনিম্ন পর্যায় হওয়াও অসম্ভব নয়। তবে যদি কেউ মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের ক্ষেত্রে শীর্ষতম পর্যায়ে পৌঁছে যায়, সে নিজস্ব শারীরিক গুণাবলী এবং বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে বরাবর হওয়া সত্তে¡ও সমাজের অন্যান্য লোকজনদের থেকে অবশ্যই বিশেষ মর্যাদাবান ও সম্মানিত বলে বিবেচিত হবেন। কেউ কি এমন কথা বলতে পারে যে, শারীরিক শক্তির অধিকারী মহাবীর রুস্তম মানুষ ছিল না? কারো এমন বলার অবকাশও আছে কি যে, গ্রিক দর্শনের প্রতিরূপ এরিস্টটল মানবিক স্বভাব ও আকৃতি হতে ঊর্ধ্বজগতে অবস্থান করেছিল? বর্তমান বিশ্বের অন্যতম বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারক এডিসন মানুষ ছিল না। যার অত্যাশ্চর্য আবিষ্কারগুলো পৃথিবীকে চমকিত করেছে। কিন্তু মানবিক দিক থেকে একরকম হওয়া সত্তে¡ও তারা নিজেদের পরিমন্ডলে অন্যান্য সাধারণ মানুষের তুলনায় বিশেষ মর্যাদা ও প্রজ্ঞার অধিকারী ছিলেন। তদুপরি নিজেদের মানবিক বৈশিষ্ট্যাবলী-উঠা-বসা, চলা-ফেরা, পানাহার, নিদ্রা, জাগরণ, দেখা-শোনা, আকার-আকৃতি প্রত্যেক বিষয়ে সাধারণ মানুষের মতোই ছিল। তাদের হাত-পা সাধারণ মানুষ হতে পৃথক কিছু ছিল না। তারা সার্বিকভাবে মানবিক বাধ্য-বাধকতা হতেও মুক্ত ছিল না।

যেমন অন্যান্য দুর্বল, জাহেল, দুর্বল স্মৃতিশক্তির অধিকারী মানুষ দুনিয়াতে বসবাস করে তেমনি বিশেষ মর্যাদাবান লোকেরাও বসবাস করে। এক্ষেত্রে এসকল মানুষ বাহ্যত: একই পর্যায়ভুক্ত বলে মনে হয়। যদি আম্বিয়ায়ে কেরামের নবুওত ও রেসালতের গুণটিকে পৃথক রাখা হয় তাহলে, তারাও মানুষেরই মতো মানুষ। কিন্তু অহী ও প্রত্যাদেশ লাভের কারণে তারা এমন শক্তি ও মর্যাদার আসনে সমাসীন হন এবং তাঁদের মাঝে এমন এক শারীরিক বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠে যা সাধারণ মানুষ হতে সম্পূর্ণ পৃথক ও আলাদা। আত্মিক ও দৈহিক দিকের মাঝে তাদের সমকক্ষ অন্য কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই নবী ও রাসূলগণ মানুষ হয়েও বিশেষ গুণ ও বৈশিষ্ট্যের জন্য সাধারণ মানুষ হতে সম্পূর্ণ আলাদা ও পৃথক সত্তা।
রাসূলুল্লাহ (সা:)-কে দেখে (‘সাওমে বিছাল’ ক্রমাগত একসাথে রোজা রাখা) কতিপয় সাহাবী ‘সাওমে বিছাল’ পালন করতে শুরু করেন। কিন্তু তিনি তাদেরকে তা করতে নিষেধ করলেন এবং বললেন, “তোমাদের মাঝে আমার সমতুল্য কেউ আছে কি? আমার প্রতিপালক আমাকে, আহার করার এবং পান করান।” (সহীহ বুখারী ও কিতাবুস সাওম) এর দ্বারা প্রতিপন্ন হয় যে, রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর মতো রূহানী খাদ্য কারো পক্ষে গ্রহণ করা কি সম্ভব হয়েছে? শুধুমাত্র ‘অহী’ ছাড়া অন্যান্য দিকেও রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর সমকক্ষ হওয়া কি আদৌ কল্পনা করা যায়? অনুরূপভাবে নিদ্রাবস্থায়ও নবীগণের অন্তর সজাগ বা জাগ্রত থাকে। এর সপক্ষে বহু সহীহ হাদীস আছে। রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, “আমার চোখ নিদ্রা যায়, কিন্তু অন্তর নিদ্রা যায় না। তাছাড়া অন্যান্য আম্বিয়ায়ে কেরামের অবস্থাও তাই। তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, “আম্বিয়াগণের চোখ নিদ্রা যায় না।” (সহী বুখারী : বাবুল আসরা) তবে কি এই অবস্থা সকল মানুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য? সকল মানুষই কি এ ব্যাপারে সমপর্যায়ভুক্ত?

রাসূলুল্লাহ (সা:) নামাজ আদায়ের সময় মুক্তাদীগণকে নামাজের কাতার সোজা করার নির্দেশ প্রদান করতেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “আমি আমার সম্মুখভাগকে যেভাবে দেখি ঠিক তেমনি আমার পেছনে তোমাদেরকেও প্রত্যক্ষ করি। এ পর্যায়ে সাধারণ মানুষের অবস্থা কি তাই? তারা কি সম্মুখভাগ যতটুকু দেখতে পায়, অনুরূপভাবে পেছনের দিকও দেখতে পারে?

আল-কোরআনে মহান রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন, “তোমরা কি এ ব্যাপারে ঝগড়া করছ, যা রাসূলুল্লাহ (সা:) প্রত্যক্ষ করতেন? তিনি সেই ফেরেশতাকে দিকচক্রবালে দ্বিতীয়বারে দর্শন করেছেন। তবে কি সাধারণ মানুষও আকাশমন্ডলে ফেরেশতাদেরকে অবলোকন করতে পারে?

রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর পবিত্র সান্নিধ্য লাভ করার ফলে উম্মাহাতুল মু›মিনীনগণ অর্জন করেছিলেন সুমহান মর্যাদার এক অনন্য আসন। এরই ফলশ্রুতিতে মহান আল্লাহ পাক তাদেরকে লক্ষ্য করে ইরশাদ করেন, “হে নবীর গৃহিণীগণ! যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর (তাহলে জেনে রেখ যে,) তোমরা অন্যান্য মহিলাদের মতো নও। এই আয়াতের দ্বারা বুঝা যায় যে, তাকওয়া ও পরহেজগারীর পর উম্মাহাতুল মু›মিনীনগণ অন্যান্য রমণীদের মতো নন। তাহলে একথা বলা কি যথার্থ নয় যে, স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা:) অন্যান্য মানুষের মতো ছিলেন না। তিনি স্বীয় গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যাবলীর ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ হতে বহু ঊর্ধ্বে অবস্থিত ছিলেন। এখনও আছেন এবং চিরকাল থাকবেন। তার পবিত্র জাত ও সিফাতের সাথে সৃষ্টজগতের কোনো বস্তু বা ব্যক্তির তুলনাই চলে না। তিনি প্রকৃতই ছিলেন অতুলনীয়। কবি কতো সুন্দরইনা বলেছেন- “বাদ আজ খোদা বুযুর্গ তুই কিসসা মুখতাসার।” অর্থাৎ আল্লাহ পাকের পবিত্র জাত ও সিফাতের পর রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর মতো সম্মান, মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী আর কেউ নন। মোটকথা, নবী এবং নবীহীন সত্তাদের মাঝে অহী এবং নুবওতের যে ধারা প্রার্থক্য করা যায় এর অর্থ হচ্ছে এই যে, এই দু’শ্রেণীর লোকদের মাঝে অহী এবং রিসালতের যাবতীয় উপকরণ, বৈশিষ্ট্য ও প্রয়োজনীয় গুণাবলীর মাঝে যেটুকুন প্রভেদ লক্ষ্য করা যায়, সেগুলো যে সত্তার মাঝে পাওয়া যাবে তিনি এসকল গুণাবলীহীন মানুষ হতে বহুগুণ বেশী মর্যাদার অধিকারী হবেন, এতে কোনও সন্দেহ নেই। আল-কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, “অবশ্যই স্বয়ং আল্লাহ পাক ও তাঁর ফেরেশতামন্ডলী রাসূলুল্লাহ (সা:)এর উপর সালাত বা দরূদ পাঠ করেন।” (সূরা আহযাব : রুকু-৭)

এর দ্বারা বুঝা যায় যে, ‘রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর মর্তবা মানুষ হওয়া সত্তে¡ও সমগ্র সৃষ্টিকূলের চেয়ে অধিক ছিল। যার কারণে মহান রাব্বুল আলামীনের সালাত ও সালাম তাঁর উপর অহরহ বর্ষিত হতে থাকে।
অপর এক আয়াতে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন, “আমি আপনাকে বিশ্বজগতের ও রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি”। (সূরা আম্বিয়া : রুকু-৭)

এই আয়াতের মর্মের প্রতি তাকালে দেখা যাবে যে, একদিকে বিশ্বজগত এবং অপরদিকে নবীউর রহমত একই পরিমন্ডলে অবস্থান করছেন না। সৃষ্টি হিসেবে বিশ্বজগতের মূল অবলম্বন হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর রহমত। এই রহমত ছাড়া কোনও সৃষ্টি অস্তিত্ব লাভ করতে পারে না।

মহান আল্লাহ পাক আরও ঘোষণা করেছেন, “হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আল্লাহ পাক ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য প্রদর্শন কর।” (সূরা নিসা : রুকু-২০)

এই আয়াতের দ্বারা সুস্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, রাসূলের আনুগত্য একান্ত অপরিহার্য। এ-ই যদি হয় অবস্থা, তাহলে আনুগত্য লাভের ক্ষেত্রে সকল মানুষকে একই বরাবর মনে করা সত্যের অপলাপ ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। শুধু তা-ই নয়, মহান রাব্বুল আলামীন উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, “আমি মোহাম্মদ (সা:)-কে সকল মানুষের জন্য নবীরূপে প্রেরণ করেছি।” (সূরা সাবা : রুকু-৩)

সকল মানুষ এবং এ সকল মানুষের যিনি নবী এই দুই পৃথক সত্তা ও শ্রেণীর মাঝে কী কোনই প্রভেদ নেই? হ্যাঁ, আছে এবং আছে বলেই, রাসূলুল্লাহ (সা:) মানুষ হয়েও অন্যান্য মানুষের মান-মর্যাদা এবং বৈশিষ্ট্য হতে সম্পূর্ণ পৃথক ছিলেন, এখনও আছেন, চিরকাল থাকবেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ