দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
অনাদি অনন্তের মহা প্রভু আল্লাহ জাল্লাশানুহু আসমান-যমিন চন্দ্র সূর্য প্রাকৃতিক জাগতিক সমুদয় বস্তু তথা দৃশ্য অদৃশ্য সব কিছুর শুধু তিনিই মালিক। তাঁর শ্রেষ্ট সৃষ্টি এবং একমাত্র প্রতিনিধি মানব জাতিকে প্রেরণ পূর্বক তাদের সঠিক পথে অবিচল রাখার জন্য দুটি অলৌকিক শক্তি সৃষ্টি করেছেন। এই দুই অলৌকিক শক্তির প্রথমটি হলো নবুয়্যত আর দ্বিতীয়টি হলো বেলায়ত। প্রথমটির মালিক হচ্ছে হযরত আদম (আ.) থেকে মানবতার মুক্তির দিশারী অখন্ড মানবতার কল্যানকামী ছৈয়্যদুল মুরছালিন হযরত মুহম্মদ মুস্তাফা সাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম সহ এক লক্ষ ছব্বিশ হাজার মতান্তরে তিন লক্ষ ছয়ত্রিশ হাজার নবী রাসূল আযমাঈনগণ। শুরু হয় দি¦তীয় অলৌকিক শক্তি তথা বেলায়তের যুগ যেটি খোলাফায়ে রাশেদিন, ছালেহিনদের মাধ্যমে।বাংলাদেশ সহ বিশ্বকুলে অন্যায়-অবিচার ,হানা-হানি,লুটতরাজ অপসংস্কৃতির প্রভাবে মুসলিম জাতি দ্বিধাগ্রস্ত ,সূফীবাদকে তাচ্ছিল্য আর অপসংস্কৃতি বলে মুসলামানদের মধ্যে অনৈক্য,ঠিক তখনি যুগসেরা সূফী,কু-সংস্কারের মূল-উৎপাটনকারী ছিলেন হাদিয়ে যমান,পীরে দস্তগীর মোর্শেদেনা হযরত কেবলা শাহ আহছান উল্লাহ রাহ.ছাহেব । হযরত নূর মোহাম্মদ প্রকাশ ঠাকুর মোল্লাহ রাহ.ছাহেবের ঔরষে বাংলা ১২০৫ বঙ্গাব্দে ভাদ্রমাসের শেষ জুমা রাতের শেষভাগে দুনিয়াতে তশরিফ আনেন। হযরত কেবলা ছয় বৎসর বয়সে মমতাময়ী আম্মা ও আট বৎসর বয়সে প্রিয় বাবাকে হারিয়ে আট্টাশি বৎসর বয়সি বৃদ্ধা দাদীজানের নিকট লালিত হন।তিনিই হযরত কেবলাকে ধর্মীয় শিক্ষার উৎসাহিত করেন। এরপর সুজতিপুরের মাওলানা হযরত নিজামউদ্দীন সাহেবের নিকট থেকে কুরআনে পাকের তাফসির ও হাদিস যথাক্রমে বুখারী ,মুসলিম,আবুদাউদ,ইবনে মাজা ও তিরমিজি শরীফ অধ্যয়ন করেন । হযরত কেবলা শিক্ষা জীবনে অধ্যয়নের পাশা-পাশি কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে তাঁর হাতের লেখা বিভিন্ন হাদিস গ্রন্থ এখনো বরকতময় স্মৃতি হিসাবে আপন হুজরায় রয়েছে। হযরত কেবলা নানাজানের সহচর্যে থাকার সময় কঠোর রিয়াজত করেন ,একদিন ওয়াজ করার সময় বলেন “আমার নানা আমাকে বলেন যে, কালিমা তৈয়্যবার আয়ত্তে আনা অত্যন্ত কঠোর সাধনার ব্যপার। আমিত্বকে বিসর্জন দিয়ে অর্থাৎ কাম.ক্রোদ,মোহ,ইত্যাদি সম্পুর্ণ পরিত্যাগ করে আল্লাহপাককে রাজী করাই হচ্ছে কালিমা তৈয়্যবার উদ্দেশ্য। মাওলানা আব্দুল গফুর সাহেব দীর্ঘ প্রায় চল্লিশ বৎসর যাবত হযরত কেবলার সাথে ছিলেন তিনি বলেন হযরত কেবলাকে আমি কখনো কেবলার পাশ্চমদিকে থুথু ফেলতেও দেখিনি এবং মসজিদ হইতে বের হওয়ার সময় হযরত কেবলাকে পেছন দিয়া অথবা বের হওয়ার সময় কখনো ডান পা মসজিদ থেকে বের করতে দেখিনি। এরকম ছিল ছুন্নতের উপর হযরত কেবলার সজাগ দৃষ্টি । হযরত পেঠু শাহ নামক এক মজ্জুুব বুযুর্গ হযরত কেবলাকে শুভসংবাদ দেন,তিনি বলেন “বাবা,তোরা রোজ কি আন্দর এক হযরত আয়েঙ্গে,উয়ে তোমকো এলমে আসরার কি তালিম দেয়েঙ্গে” এর কিছু দিন পর হযরত কালিম শাহ বোগদাদী রহ. আসেন তিনি হযরত কেবলাকে কাদেরিয়া ত্বরিকার বাইয়াত করান এছাড়াও তিনি ঢাকার অদূরে মীরপুরে হযরত শাহ আলী বোগদাদী রহ. মাজারে পাকে গিয়ে কঠিন রেয়াজত করেন। তখন তিনি সারা বৎসর রোজা (পাচঁ দিন ব্যতীত)রাখতেন এবং রাতদিন তাসবিহ্ তাহলিল ,মোরাকাবা-মোশাহাদা করিতেন খাবারের সময় হলে অল্প আহার করতেন , তিনি নারায়নগঞ্জ শাহী কিল্লা ও লালবাগ মসজিদের দূরবর্তী সুরঙ্গে তিনি তৃতীয় তথা সর্বশেষ চিল্লা করেন এর পর তিনি দ্বী’ন ইসলামের প্রচার-প্রসারে আতœনিয়োগ করেন। হযরত কেবলার ইবাদত-বন্দেগীতে হুযুর নবী করিম (দরূদ) এর পূর্নাঙ্গ অনুঃস্বরণ ছিল। তিনি সারারাত ইবাদত বন্দেগীতে রাত কাটাতেন, অনেক সময় দাড়িয়ে থাকতে থাকতে তাঁর পবিত্র পা মোবারক ফুলে যেত, তিনি ৩০/৪০ দিন পর্যন্ত না খেয়ে “হসদম” সহ নানা ধরণের জিকিরে মশগুল থাকতেন, হযরত কেবলা কথার প্রসঙ্গে বলেন আমি অনেক সময় পেঠে ছোট পাথর কাপড় দিয়ে আবৃত্ত করে করে রাখতেন এবং একাধারে ৪০ দিন যাবত শুধু পানি খেয়ে খেয়ে জীবন ধারণ করেছেন। রাত্রি জাগরন ও বিভিন্ন প্রকারের জিকির-আজকারের ফলে তাঁহার শরীর মোবারক এত শুকিয়ে গিয়েছিল যে তাহাঁর শরীর মোবারকের হাঁড় ও ছামড়া একাকার হয়ে যায়। আল্লাহর প্রেমে এতই মত্ত¡ ছিলেন যে, নাওয়া-খাওয়ার কথাই ভুলে যেতেন,তিনি “ফাঁকা কাশি” অর্থাৎ উপবাস থাকতে পছন্দ করতেন। এমনিক প্রায় ৩০ বৎসর যাবত পুষ্টিকর ও মজাদার খাবার ত্যাগ করেছেন। তিন অল্পে সন্তুষ্ট থাকতেন। তাহাঁর নানা পীর মুহাম্মদ রাহ. নির্দেশে তিনি প্রায় ষাট বৎসর বয়সে বিবাহ করেন। প্রথম স্ত্রী বিবাহের দিন অতিবাহিত হয়ে রাত্রী বেলায় কলেরায় আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন। তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী, হযরত কেবলা বিবিখান্দি গ্রামে শিক্ষকতা করার সময় রাকী মালের ব্যবসা করিতেন। দুনিয়াদারি করেছেন তা আল্লাহপাকের রেজামন্দির ভিতরেই করেছেন। হযরত কেবলা অনেক বুযুর্গ ব্যক্তির সংস্পর্শে থেকে বুযুর্গী লাভ করেছেন। তিনি চরভাসানিয়া গ্রামের হযরত লস্কর মোল্লাা রহমাতুল্লাহি আলাইহির হাতে চিশইতয়া তরিকার বাইয়াত ও খেলাফত লাভ করেন।এরপর থেকে তিনি উভয় তরিকায় মুুরিদানদের বাইয়াত করা আরম্ভ করেন। তিনি প্রথমে ওয়াজ-নসিহতের মাধ্যমে তালিম দেয়া শুরু করেন তখন অনেক অমুসলিমদের মুসলিম ধর্মে দীক্ষিত করেন । হযরত কেবলার ওয়াজ শুনে তাহাঁর সান্যিধ্যে থেকে হযরত কেবলার রুহানী তাওয়াজ্জুর বরকতে সিদ্ধ সন্যাসীগনও তাদের পূর্ব ধর্ম পরিত্যাগ করে ইসলামের ছায়াতলে আসেন। তিনি বলেন আল্লাহপাক আমাকে এমন শক্তি দিয়েছেন ইচ্ছা করলে আমি পৃথক একটি তরিকাত সৃষ্টি করেতে পারতাম কিন্তু গৌছে পাক (রাদি) আনহুর ইজ্জতের দিকে খেয়াল করে আমি পৃথক তরিকত সৃষ্টি করিনি। হযরত কেবলা ওয়াজ-নছিহতের বরকতে দেশের অনেক কুসংস্কার নিয়ম-নীতির বিরুদ্ধে তালিম দিয়ে মুসলমানদের আহ্লে ছুন্নাত ওয়াল জামাতের অনুসারী করেন,শরীয়ত বিরোধী কোন কার্যকলাপ তিনি মোঠেও সহ্য করতেন না ,যারা অন্যায় করত তাদের কঠোর হস্তে দমন করার চেষ্টা করতেন। হযরত কেবলার জীবদ্দশায় বে-জুমার একটি দল সৃষ্টি হয় ওরা জুমার নামায পড়তনা। তাদের বিরুদ্ধে তিনি জিহাদ করেন। এ বে-জুমাদলের মতে পরাধীন দেশ অর্থাৎ যে দেশে ইসলামী হুকুমত নেই ঐ দেশে জুমার-ঈদের নামায আদায় করা জায়েজ নেই। তাদের দলকে “দুদিয়াল” নামেও ডাকা হত। দুদিয়াল বাহিনি ক্রমশ সারাদেশ ব্যাপী ছড়িয়ে পরেছিল বিশেষকরে বরিশাল,ঢাকা,ফরিদপুর ও ত্রিপুরা জেলার কয়েক স্থানে তাদের শক্ত ঘাটি করতে সর্মত হয়,তখন তারা অনেক জুমা মসজিদ ধুলিস্যাত করেদেয় এমনকি তারা হযরত কেবলার প্রতিষ্টিত মসজিদ ভাঙ্গার জন্য আসে তখন হযরত কেবলা আপন হুজরা শরীফে ধ্যানমগ্ন ছিলেন ঐ সময় হযরত কেবলার মসজিদে তাঁহার কয়েকজন মুরিদান ছিল দুদিয়াল বাহিনীর আগমনের আওয়াজ শুনে মুরিদানগন মসজিদ থেকে বের হয়ে হযরত কেবলার নিকট কেঁদে কেঁদে বলেন হজুর দুদিয়াল বাহিনী আসতেছে মসজিদ ধংস করার জন্য প্রত্তুত্তরে হযরত কেবলা মুরিদানদের ও বলেন বাবারা মসজিদ আল্লাহর ঘর যার ঘর তিনিই রক্ষা করবেন।এর একটু পরেই দুদিয়াল বাহিনী হযরত কেবলার বাড়ীর আঙ্গিনায় প্রবেশ করতে চাইলে আল্লাহর হুকুমে তাদের চোখ অন্ধ হয়ে যায়। তাদের শোচনীয় অবস্থা হওয়ায় তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরে হযরত কেবলার নিকট ক্ষমা চাইলেন হযরত কেবলা তাদের ক্ষমা করে দেন যার ফলশ্রæতিতে তাদের চোখের জ্যোতি ফিরে পায়, তারপরেও ঐ দুদিয়াল বাহিনী ক্ষান্ত হয়নি তারা হযরত কেবলার প্রান নাশের ও চেষ্টা চালায় কিন্তু আল্লাহর হুকুমে তাদের সে চেষ্টাও বিফলে যায়। হযরত কেবলা অনেক শীর্ষ স্থানীয় আলেমদের মাধ্যমে বে-জুমা দলের সাথে তর্ক ও করিয়েছেন এবং দুদিয়াল বাহিনি যুক্তি-তর্কে ও যখন টিকতে পারেনি তখন আলেমদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন হয়রানী মূলক মামলা মোকাদ্দমা করেন হযরত কেবলার দোয়ার বরকতে তারা তাতেও ঠিকতে পারেনি। পরিশেষে দুদিয়াল বাহিনির প্রধান অর্থাৎ দুদুমিয়ার ছেলের সামনে হযরত কেবলা কুরআন-হাদিসের আলোকে যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করাতে তা মানতে বাধ্য হয়। হযরত কেবলা মানুষের মনের খবরা খবর জানতেন কখনো বলেও দিতেন আবার কখনো বলতেননা যেটাকে তাছাউফের ভাষায় “কাশফ” বলে। তাঁহার অহরহ কারামত প্রকাশ হয়েছে-যেমন জনৈক মুরিদান ঘূর্নিঝড়ের কবলে পড়লে “এয়া র্মুশেদু” আহŸান করলে ঐ মুরিদানকে হযরত কেবলা উদ্ধার করেন এছাড়াও তাঁকে স্বরণ করলে মানুষ ডুবন্ত নৌকা হতে উদ্ধার হওয়া,তাঁহার দোয়ার বরকতে নিউমোনিয়া রোগী ভাল হওয়া,জঠিল-কঠিন রোগে আক্রান্ত রোগী আরোগ্য লাভকরা জোরপূর্বক হযরতকেবলার বাড়ীর পিছনের জমিন সরকার কর্তৃক দখলীয় করে নগর বাসীর ময়লা-আর্বজনা ফেলার জন্য গর্ত করতে গিয়ে তারা সফল না হওয়া,তাহাঁর দোয়ার বরকতে পুত্র সন্তান হওয়া ইত্যাদি হাজারো কারামত প্রকাশিত হয়েছে। তিনি শুধু পীর -মুরিদি বা ওয়াজ-নসিহত করে জীবন কাটাননি সমাজের অনেক কুসংস্কার দুর করেছেন যেমন,বে-জুমার দলকে তারানো ,অমুসলিমদের মুসলিম ধর্মে ধীক্ষিত করা, বিভিন্ন জায়গায় মসজিদ প্রতিষ্টা করাও মসজিদ প্রতিষ্টা করতে মুসলমানদের সহযোগীতা সহ মুসলিম সমাজে তখন আমূল পরিবর্তন আনেন। মুলমানদের স্বার্থ রক্ষার জন্য একতাবদ্ধ করে আন্দোলন করতে পরামর্শ দিতেন। তিনি সবাইকে গান্ধী নীতি ত্যাগ করে মুসলিম লীগে থাকার পরামর্শ দিতেন। হযরত কেবলা পরিবারিক,সামাজিক,রাজনৈতিক থেকে সমাজের সব কু-সংস্কার দূর করতে সদা প্রস্তুুত ছিলেন। তাইতো তৎকালীন বিজ্ঞ আলিম সমাজ তাঁকে সংস্কারক তথা তেরশত বর্ষের মুজাদ্দিদ হিসাবে ঘোষনা দিয়েছিলেন। এ মহা মনিষী ১২৮ বৎসর তিন মাস সাতাশ দিন বয়সে ১১ই কার্তিক ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ ,২০শে রবিউস সানি ১৩৪৫ হিজরী রোজ বৃহষ্পতিবার ফজরের নামাযের পর ইন্তিকাল করেন। ঢাকা মুশুরীখোলা সাহ সাহেব লেইনে আগামী ১১ই কার্তিক মোতাবেক ২৬শে অক্টোবর এ মহান মনিষির ঈসালে ছাওয়াব মাহফিলে শরিক হয়ে হযরত কেবলায়ে আলমের রুহানী ফয়েয হাসিল করুন। মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের মহান সাধকের প্রতিষ্টিত তরিকতের উপর অটল রাখুন-আমিন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।