Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ক্রমশ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে বরিশাল মহানগরী

প্রকাশের সময় : ২২ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

অবৈধ যানবাহন হাইড্রোলিক হর্ণ ধুলা-বালু ময়লা আবর্জনার দঙ্গল আর ফুটপাতসহ মূল রাস্তা দখলের প্রতিযোগিতা দেখা কেই নেই
বিশেষ সংবাদদাতা : বরিশাল মহানগরী ক্রমশ বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। এ অভিযোগ নগরবাসী। গোটা নগরী জুড়ে অবৈধ যানবাহন, হাইড্রোলিক হর্ণ, ধুলা-বালু, ময়লা আবর্জনার দঙ্গল, ফুটপাতসহ মূল রাস্তা দখলের প্রতিযোগিতার সাথে নানা ধরনের রাসায়নিক পদার্থ প্রকাশ্যে বায়ুতে মিশে গোটা নগরীর পরিবেশ ক্রমশ অসহনীয় হয়ে উঠছে। যদিও এ নগরীতে এখন আর কেউ কোন কিছু নিয়ে কথা বলেন না। সাধারণ মানুষ বাধ্য হয়ে অনেক অনিয়মের শ্রোতে গা ভাসিয়ে দিচ্ছেন। আর দলবাজ বুদ্ধিজীবী এবং দলদাশ সুশীল সমাজ ও রাজনীতিবীদগণ কথা বলেন নৈতিকতার দায় থেকে নয়, দলীয় সংকীর্ণতায় পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে।
এর সাথে রাজনৈতিক কারণে বর্তমান নগর পরিষদের সময়ই এ নগরীর জন্য সরকারি প্রকল্প সাহায্যসহ থোক বরাদ্দ ক্রমশ হ্রাস করায় নগরীর রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে বিদ্যমান নাগরিক সুবিধা সমুহ ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ছে। সেখানে নতুন কোন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ অনেকটাই অলীক স্বপ্ন বলে মনে করছেন ওয়াকিবাহাল মহল। এমনকি অর্থের অভাবে বরিশাল সিটি করপোরেশনের নিয়মিত কর্মকর্তাÑকর্মচারীদের বেতন বকেয়া বাকি পড়েছে ৫মাসের। আর পরিচ্ছন্ন কর্মী নামে বরিশাল সিটি করপোরেশন যে প্রায় দেড় হাজার দৈনিক মজুরি ভিত্তিক কর্মচারী পুষছেন তাদের বেতনও বকেয়া এক মাসের।
২০০২ সালের ২৫ জুলাই অধুনালুপ্ত বরিশাল পৌরসভার ২৫ বর্গকিলামিটার এলাকাসহ ৪৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে বরিশাল সিটি করপোরেশন গঠিত হবার পরে বর্তমান নগর পরিষদ তৃতীয় নির্বাচিত। প্রায় ৫ লাখ জনসংখ্যার এ নগরীতে রাস্তার পরিমাণ সাড়ে ৬শ’ কিলোমিটারের মত। যার মধ্যে এখনো কাঁচা রাস্তাই প্রায় আড়াইশ কিলোমিটার। ইট বিছানো এইচবিবি রাস্তা রয়েছে ১২ কিলোমিটার এবং খোয়ার রাস্তা রয়েছে আরো ৩২ কিলোমিটার। নগরীতে এখনো ৩৬টি বাঁশের সাঁকো ছাড়াও কাঠের পুল রয়েছে ২২টি। আর নগরী জুড়ে পৌনে ৪শ’ কিলোমিটার ড্রেনের মধ্যে কাঁচা ড্রেনের দৈর্ঘ এখনো প্রায় ১৬৫ কিলোমিটার। আর পাকা ড্রেন ২১২কিলোমিটারের মত। নগরীর অভ্যন্তরের প্রায় সবগুলোড্রেনই বুজিয়ে পাকা ড্রেন নির্মাণ করা হলেও এখনো জেল খাল, নবগ্রাম রোড খাল, সাগরদী খালসহ নথুল্লাবাদ খালের অস্তিত্ব কোন ক্রমে টিকে আছে। এসব খালের দু পাশের বাসিন্দারা ক্রমশ খালগুলোকে দু’পাশ থেকে গ্রাস করছে। এসব বিবেকহীন বসতদারগণ প্রকৃতির এ অপার দানকে গলা টিপে হত্যা করলেও তা দেখার কেউ নেই। এমনকি বছর খানেক আগে উচ্চ আদালত থেকে বরিশাল জেল খালকে উদ্ধারে সিটি করপোরেশনসহ জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়া হলেও কাজের কাজ তেমন কিছ্ইু হয়নি। সম্প্রতি জেলা  প্রশাসন থেকে জেল খাল উদ্ধারে নানা মহড়া প্রদর্শনসহ স্থানীয় কিছু মিডিয়ার কল্যাণে তার ফলাও প্রচারও হয়েছে। কিন্তু জেল খাল উদ্ধার এখনো তিমিরেই। নগরীর অন্য খালগুলোর বোবা কান্না এখনো কতৃপক্ষের কর্ণ কুহরে প্রবেশ করেনি।
নগরীর কাঁচা-পাকা ড্রেনগুলোও নিয়মিত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হচ্ছে না। ফলে ঘন্টায় ৫মিলিমিটার বৃষ্টিপাতেও গোটা নগরী পানিতে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে। একদিকে কথিত পরিচ্ছন্ন কর্মী(?)দের কাজের প্রতি অবহেলা ও ফাঁকিবাজি, অপরদিকে কতিপয় নগরবাশীও ড্রেনকে ডাস্টবিনের মত ব্যবহার ছাড়াও ড্রেনের পাশে এবং ওপরে নানা ধরনের আবর্জনা ময়লার স্তূপ ফেলাসহ নির্মাণ সামগ্রী রেখে ড্রেনগুলোকে ক্রমশ অকার্যকর করে তুলছে। কতিপয় বিবেকহীন নগরবাশীর সাথে উদাসীন নগর প্রশাসন এনগরীকে ক্রমশ ময়লা আবর্জনার জঞ্জাল ও পানিবদ্ধতার নগরীতে পরিনত করছেন দিনের পর দিন। কিন্তু তা দেখার কেউ আছে বলেও মনে হয়না। পরিস্থিতি এমনই একজন যদি মাঝ রাস্তায় উচু হয়ে বসে বা দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করেন, তাহলে তাকে আসেপাশের অনেকেই হাততালি দিয়ে উৎসাহিত করেন। নগরীর নবগ্রাম রোড, বাংলাদেশ ব্যাংক রোড, এমনকি খোদ সদর রোডেই পানিতে সয়লাব হয় যাচ্ছে। তখন বড় কর্তারা বাতানুকুল গাড়ি নিয়ে ঐসব রাস্তায় সজোরে গাড়ি চালিয়ে পরিদর্শনে বের হন। তাদের গাড়ির চলাচলে ছোট-বড় ঢেউ দেখে বাচ্চারা হাত তালিও দেয়। আর তখন মনে মনে খুব বড়াইও করেন কর্তারা।
প্রতিটি ফুটপাথ দখল হয়েছে নগর প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের সহায়তায়ই। ১২হাজার রিক্সার লাাইসেন্স থাকলেও তার অর্ধেকও চলেনা নগরীতে। কারণ দেশের সবচেয়ে ব্যায়বহুল রিক্সা ভাড়ার এ নগরীর রাস্তায় এখন আর কেউ রিক্সায় চড়তে চায়না। সে যায়গা দখল নিয়েছে ব্যাটারি চালিত ইজি বাইক। কিন্তু সিটি করপোরশেন থেকে ২ হাজার ৬১০টি ইজি বাইকের লাইসেন্স দেয়া হলেও এর দিগুণেরও বেশী বাইক নগরীতে দাপিযে বেড়াচ্ছে। আর কিছুদিনের ব্যবধানেই আবার ব্যাটারি চালিত রিক্সাও এ নগরীতে ফিরে আসছে। ফলে যানবাহনের দঙ্গলে রাস্তা ভড়াট।
আর রাস্তাগুলো দেখাশোনা করার মত কেউ আছে কিনা তা বোঝা দায়। অতি সম্প্রতিক প্রবল বর্ষণে নগরীর রাস্তাঘাটের ক্ষতবিক্ষত চেহারা আরো একবার প্রকটভাবে ফুটে ওঠার পরে নগরভবন থেকে যথারীতি কিছু মেরামতিও শুরু  হয়েছে। কিন্তু বৃষ্টি মধ্যেই ঠিকাদার বিটুমিন দিয়ে নান্তা মেরামত করছেন। সেখানে নগর ভবনের প্রকৌশল বিভাগের কারো দেখা মিলছেনা। এমনকি অনেক কাজে প্রকৌশল শাখার প্রধান প্রকৌশলী সহ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দৃষ্টি আকর্ষণের পরেও  এসব মেরামতি ও উন্নয়ন কাজের কাছে নগর প্রকৌশল বিভাগের কর্মীদের দেখা মেলেনা। এখানে ঠিকাদারের ইচ্ছা অনিচ্ছায়ই অনেক প্রায় সব কিছু হচ্ছে।
এ নগরী থেকে ডাস্টবিন বিলুপ্ত হয়েছে অনেক আগে। নগরীর বিভিন্ন রাস্তার ধারে  ময়লা আবর্জনা ফেলছে এলাকাবাশী। আবার নগর ভবনের পরিচ্ছন্ন কর্মীদের মধ্যে যাদের পেছনে রাজনৈতিক নেতাদের আশির্বাদ নেই, তারা ঐসব ময়লা আবর্জনা অনতিদুরে রাস্তার পাকেন বড় স্তূপ করার পরে সেখান থেকে সিটি করপোরেশনের ট্রাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এর পরেও নগরীর অনেক এলাকাই জঞ্জালে পচছে, দূর্গন্ধে শরীর টলছে নগরবাশীর। কিন্তু এরপরেও এসবকে ফুলের সুবাস ভেবেই দিনের পর দিন নগরবাশী হেট যাচ্ছেন কিনারা দিয়ে।
বরিশাল মহানগরীতে কয়েকটি ওষুধ কারখানা সহ কাটপট্টি ও কালীবাড়ী রোডে বিপুল সংখ্যক স্বর্ণকার ও কর্মকারের এসিড পোড়ানোর কাজটি বন্ধের কোনউদ্যোগই নেই নগর প্রশাসনের। ফলে এনগরীর বাতাসে ভাড়ি বিষ ভাসছে। শিশুদের নিঃশ্বাস নেয়ও দরুহ হয়ে পড়ছে। তবে এর সাথেই ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে পড়ছেন বরিশাল মহানগরবাশী। বাতাশে নানা রাসায়নিক ভেসে বেড়ালেও তা নিয়ে চিন্তা নেই কারো। তবে নগর প্রশাসন থেকে প্রকাশিত সিটিজেন চার্টারে ২০২০ সালের মধ্যে বরিশালকে পরিবেশ বান্ধব নগরী হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সে লক্ষে খুব  কিছু বাস্তব অগ্রগতি নেই।
পঁেচগলে যেতে বসা এনগরীকে ক্রিমির মত খুঁটে খাচ্ছে কতিপয় রাজনৈতিক নেতারা। বর্তমান মেয়রের রাজনৈতিক দূর্বলতার সুযোগে তারা নগর ভবনের সব কিছুকেই কব্জায় রাখছেন নানা ফন্দি ফিকিরে। তবে এর পরেও নগর ভবন থেকে প্রকাশিত সিটিজেন চার্টারে চলতি বছরের মধ্যে এ নগরীকে শিশুবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। যদিও এ লক্ষে বেল পার্কের পাশে একটি ক্ষুদ্রাকায় শিশু পার্ক নির্মাণ ছাড়া আর কোন কার্যক্রম  চোখে পরেনি কারো। এছাড়াও চলতি বছরের মধ্যে শতভাগ সেনটিশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু এলক্ষে নগর প্রশাসনের কোন ভ’মিকার কথা জানে না কেউ। পাশাপাশি ২০২০সালের মধ্যে নগর প্রশাসনকে ডিজিটালাইজড করার কথা বলছে সিটি করপোরেশন। বর্তমান নগর প্রশাসনের প্রথম লক্ষ ছিল গাড়িতে হাইড্রোলিক হর্ণ বন্ধ করা। কিন্তু এখন এ নগরীতে মায়ের পেটের বাচ্চাও নড়ে উঠছে হাইড্রোলিক হর্ণের আওয়াজে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ক্রমশ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে বরিশাল মহানগরী
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ