Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রাজনৈতিক নেতা মসজিদের ইমাম ও ছাত্রসহ কুষ্টিয়ায় ৯ মাসে ৮ জন গুম

প্রকাশের সময় : ২০ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এসএম আলী আহসান পান্না, কুষ্টিয়া থেকে : কুষ্টিয়ায় এক বছরে গুম হয়েছেন ৮ জন। তাদের মধ্যে রয়েছেন রাজনৈতিক নেতা, মসজিদের ইমাম, ছাত্র ও সাধারণ মানুষ। গুম হওয়া ব্যক্তিরা হলেনÑ মিরাজুল ইসলাম মিরাজ, শেখ সাজ্জাদ হোসেন সবুজ, স্কুলছাত্র জাহীন, সরোয়ার হোসেন সরো, জাফর ইকবাল, মাদরাসা ছাত্র আবু জর গিফারি, রফিকুল ইসলাম ও ইমাম এস এম রকিব। তাদের মধ্যে এক বছর পর একজনের দেহাবশেষ পাওয়া গেলেও বাকিদের কোনো সন্ধান মেলেনি। কেউ জানে না তারা জীবিত না মৃত। কোনো ঘটনা তদন্তেই কোনো কূল-কিনারা করতে পারেনি পুলিশ। একদিকে চলছে নির্বিচার হত্যা, অন্যদিকে এসব গুমের ফলে জেলার সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে আতংক বিরাজ করছে।
ব্যবসায়ী ও বিএনপি নেতা মিরাজুল ইসলাম মিরাজের বাড়ি কুমারখালি থানাধীন চাপড়া ইউনিয়নের লাহিনীপাড়ায়। তিনি থাকতেন কুষ্টিয়া শহরে।
মীর মশাররফ হোসেন সেতু সংলগ্ন জয়নাবাদ এলাকায় গড়াই ইটভাটার মালিক ছিলেন তিনি। মিরাজ লাহিনীপাড়া ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি ও চাপড়া ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ২০১৫ সালের ৪ জুন রাত ৯টার দিকে জয়নাবাদ থেকে তার ব্যবসায়িক পার্টনার কোহিনূরের মোটর সাইকেলে কুষ্টিয়ার বাসায় ফেরার পথে লাহিনী বটতলা মোড়ে আসার পর তিনি নিখোঁজ হন। পরদিন তার স্ত্রী কুমারখালি থানায় একটি জিডি করেন। তার কোনো সন্ধান মেলেনি। অবশেষে মিরাজ হত্যা মামলায় গ্রেফতার এক আসামির স্বীকারোক্তিেেত পুলিশ গত ১৫ জুন রাতে অভিযান চালায়। আসামী জানায়, মিরাজকে হত্যা করে ইটভাটার পাশেই একটি গর্তে মাটি চাপা দেয়া হয়েছিল। তার লাশের কিছু হাড়গোড় উদ্ধার করেছে পুলিশ। সেগুলো মিরাজের কিনা তা নিশ্চিত হতে ডিএনএ টেস্ট করানো হবে। পুলিশের ধারণা, তার ব্যবসায়িক পার্টনাররা তাকে হত্যা করেছে।
কুষ্টিয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহ-সভাপতি ও কুষ্টিয়া জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ সাজ্জাদ হোসেন সবুজ ২০১৫ সালের ২০ আগস্ট থেকে নিখোঁজ রয়েছেন। গত বছর কুষ্টিয়ার মজমপুরে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালন অনুষ্ঠানে দলীয় সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী সবুজ খুন হন। শেখ সাজ্জাদ হোসেন সবুজকে সে হত্যা মামলার প্রধান আসামী করা হয়। তিনি আত্মগোপন করেন। ২০ আগস্ট কুষ্টিয়া প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে সবুজের মা শাহিদা খাতুন জানান, সেদিন ভোর ৪টার সময় সবুজ ও কুষ্টিয়া জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি আক্তারুজ্জামান লাবুকে গাজিপুরের ড্রিম স্কয়ার রিসোর্ট থেকে র‌্যাব ধরে নিয়ে গেছে। এর পর ২৬ আগস্ট লাবু কুষ্টিয়ায় ফেরত আসেন। তিনি মুখ খোলেননি। এদিকে সবুজের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস জিনিয়া স্বামীর সন্ধান চেয়ে আদালতে পিটিশন দাখিল করেন। ঐ পিটিশনের বিষয়ে আদালতে দাখিল করা প্রতিবেদনে পুলিশ স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়, সবুজ ও লাবুকে তারা আটক বা গ্রেফতার করেনি। সবুজের গ্রেফতারের ব্যাপারে জানতে চাইলে র‌্যাব-১২ কুষ্টিয়া ক্যাম্পের কমান্ডার মোসাদ্দেক ইবনে মুজিব তখন বলেছিলেন, ‘এ রকম কিছু আমাদের জানা নেই। অনেকেই আমাদের কাছে বিষয়টি জানার জন্য ফোন দিচ্ছে। জানতে পারলে আপনাদের জানাব।’ যাহোক, এ পর্যন্ত ১০ মাসেও সবুজের কোনো সন্ধান মেলেনি।
কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় ৯ মাস আগে নিখোঁজ হয় এসএসসি পরীক্ষার্থী মেধাবী ছাত্র জাহীন। ২০১৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসেনি। পরদিন তার নিখোঁজের বিষয়ে ভেড়ামারা থানায় জিডি করা হয়। গত ৩১ জানুয়ারি তার পরিবার নিজ বাড়িতে এক সংবাদ সম্মেলন করে জানান, তারা র‌্যাবকেও জানিয়েছেন। কিন্তু কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি জাহীনের।
২০১৫ সালের ৫ অক্টোবর কুষ্টিয়া শহরের নতুন কোর্টপাড়া এলাকা থেকে সরোয়ার হোসেন সরোকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ পরিচয় দেয়া লোকেরা। সরোর স্ত্রী জানান, রাত ১১টার দিকে বাসার নিচে দোকানে বসে সিগারেট খাওয়ার সময় কুষ্টিয়া মডেল থানার ৪ জন এসআই দুই মোটর সাইকেলে সেখানে আসে। তারা সরোকে তুলে নিয়ে যান। থানায় যোগাযোগ করলে পুলিশ তাকে বলে যে খোঁজ-খবর করেন। পেয়ে যাবেন। কিন্তু এ পর্যন্তও স্বামীর খোঁজ পাননি তিনি।
কুমারখালি উপজেলার কয়া গ্রামের জাফর ইকবালকে ২০১৫ সালের ৯ নভেম্বর গভীর রাতে পুলিশের পোশাক পরা লোকজন তুলে নিয়ে যায়। তাদের মধ্যে কুমারখালি থানার এস আই রাজিব থানায় যোগাযোগ করতে বলেন। জাফরের বড় ভাই পরদিন থানায় গেলে রাজিব জানান, গতকাল রাতে আমার ডিউটি ছিল না। তিনি জাফরকে ধরেননি বা ধরতে যাননি বলে জানান। ৮ মাসেও রাজিবের কোনো খোঁজ মেলেনি।
এ বছর ২৮ জানুয়ারি সাদা পোশাকে র‌্যাব পরিচয় দিয়ে ৩ ব্যক্তি কুষ্টিয়ার মঙ্গলবাড়ির আশরাফুল উলুম মাদরাসার ছাত্র আবু জর গিফারিকে মাইক্রোবাসে করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সে দাওরায়ে হাদিস ক্লাসের ছাত্র ছিল। পরদিন মাদরাসার বড় হুজুর হাফেজ মওলানা আবু দাউদ কুষ্টিয়া মডেল থানায় একটি জিডি করেন। তিনি জিডিতে বলেন, র‌্যাব অফিসে খোঁজ নিতে গেলে তারা জানায়, এ ব্যাপারে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। তার পিতা আমির হোসেন বলেন, তিনি বিভিন্ন স্থানে দেন দরবার করেও ছেলের কোনো হদিস করতে পারেননি। অনেকেই অনেক আশ্বাস দিলেও ছেলেকে ফিরে পাননি। পাবেন কিনা জানেন না।
কুষ্টিয়া সদর উপজেলার আলামপুর ইউনিয়নের বালিয়াপাড়া গ্রামের অধিবাসী রফিকুল ইসলাম। ৩ ফেব্রুয়ারি নিজের মোটর সাইকেলে করে বেলা ১১টার দিকে কুষ্টিয়া যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হন। পথের মাঝে জিকে ক্যানালের ব্রিজে ৪ জন লোক তাকে মোটর সাইকেলে তুলে নেয় বলে জানা যায়। এ ব্যাপারে রফিকুলের স্ত্রী শীলা বাদী হয়ে কুষ্টিয়া মডেল থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। লিখিত অভিযোগে শীলা বলেন, বালিয়াপাড়া পশুহাট ও বালিয়াপাড়া কলেজিয়েট স্কুল নিয়ে দুটি পক্ষের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে দ্বন্দ্ব চলছিল। এর জের ধরে প্রতিপক্ষের লোকজন রফিকুলকে অপহরণ করেছে। তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।
কুষ্টিয়ার কুমারগাড়া মসজিদের ইমাম এসএম রকিব। মসজিদের পাশে একটি ঘরে তিনি থাকতেন। গত ২৯ এপ্রিল রাত সাড়ে ১২টার দিকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দেয়া সাদা পোশাক পরা লোকেরা তাকে তুলে নিয়ে যায়। তার ভাই আবুল হাসান জানান, তারপর থেকে তার কোনো খোঁজ পাননি। কুষ্টিয়া মডেল থানায় ৩ বার জিডি করতে গেলেও নেয়া হয়নি। তিনি বলেন, পুলিশ জানায় তারা জিডি নিতে পারবে না।
গোটা জেলায় একদিকে খুনের ঘটনা বেড়েছে অন্যদিকে ৯ মাসে ৭টি গুমের ঘটনা সর্বস্তরের জনমনে ভীতি ও আতংকের সৃষ্টি করেছে। সাধারণ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি না ঘটার ব্যাপারে পুলিশ সজাগ থাকলেও এসব গুমের ঘটনার কিনারা করতে পারেনি। ফলে তাদের দক্ষতা ও নৈপুণ্য প্রশ্নবিদ্ধ। আপাত স্বস্তির বিষয় যে ২৯ এপ্রিলের পর গত দেড় মাসে আর কোনো অপহরণ-গুমের কথা জানা যায়নি। তা সত্ত্বেও জেলার মানুষকে নিরাপত্তা পরিস্থিতির ব্যাপারে আশ্বস্ত করতে পুলিশ আরো সতর্ক ও সক্রিয় হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন অভিজ্ঞ মহল।



 

Show all comments
  • Anisur Rahaman ২০ জুন, ২০১৬, ১২:০৩ পিএম says : 0
    বর্তমান সরকারের আমলে সব সম্ভব।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রাজনৈতিক নেতা মসজিদের ইমাম ও ছাত্রসহ কুষ্টিয়ায় ৯ মাসে ৮ জন গুম
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ