Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ব্রিটেনের গণতন্ত্র এবং আমরা

প্রকাশের সময় : ১৯ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্টালিন সরকার : ব্রিটেনের লেবার পার্টির এমপি জো কক্স দুর্বৃত্তের হাতে নিহত হয়েছেন। বিরোধী দলের এই এমপি’র খুনের ঘটনায় কেউ কারো ওপর দোষারোপ করেননি। কেউ কারো দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তোলেননি। বিরোধী দলের এমপি খুনের ঘটনায় সরকারের ওপর ব্যর্থতার দায় চাপাননি বিরোধী পক্ষ। আবার সরকারও তদন্তের আগে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ‘নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল’ ম্যাসেজ দেয়নি। বরং সরকারের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিরোধী দল এবং সাধারণ মানুষ সবাই ব্যথিত। শোকে স্তব্ধ পুরো জাতি। দলমত নির্বিশেষে শোকের মিছিলে শামিল হয়েছেন সবাই। এটাই হলো গণতন্ত্র; এটাই হলো আইনের শাসন।
জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকলে, আইন তার নিজস্ব গতিতে চললে, প্রশাসন সতর্ক নিরপেক্ষ এবং ন্যায়ানুগ দায়িত্ব পালন করলে গণতান্ত্রিক দেশে এমনটাই হওয়ার কথা। অথচ আমাদের দেশে কেউ খুন হলেই একে অন্যের দিকে আঙ্গুল তুলি, একে অন্যকে দোষারোপ করি। দোষারোপের সংস্কৃতি এমন পর্যায়ে গেছে যে, দেশের মানুষ এখন আর কোনো পক্ষকেই বিশ্বাস করে না। সরকার, ক্ষমতাসীন দল, মাঠের বিরোধী দল, আইন শৃংখলা বাহিনী, প্রশাসন, সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মী, কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক কারো প্রতিই সাধারণ মানুষের বিশ্বাস নেই।
ব্যক্তি, দল, গোষ্ঠী স্বার্থ নয়; দেশের স্বার্থ রক্ষা করাই হলো রাজনীতি। আদর্শ নীতি নৈতিকতা রাজনীতিতে থাকবে; মত পথের ভিন্নতা থাকবে; কিন্তু দেশের স্বার্থে সবাই একতাবদ্ধ; সেটাই হলো গণতন্ত্রের শিক্ষা। হিন্দুত্ববাদী ভারত, সন্ত্রাস কবলিত পাকিস্তান এমনকি ক্ষুদ্র দেশ নেপালের দিকে তাকালেও সেটা দেখতে পাই। অথচ আমরা কোথায় রয়েছি? দেশপ্রেমের নামে যে রাজনীতি শুধু চাওয়া পাওয়াই প্রাধান্য সেটা যত আদর্শবাদী রাজনীতি হোক না কেন, সেখানে বিরোধ হবেই। ক্ষমতায় থাকলেও হবে। কারণ, দেশপ্রেম নয়; নেতাদের চাওয়া পাওয়াই তো মুখ্য। ডাকাতির মালপত্র ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে যেমন ডাকাতদের বিরোধ হয়; তেমিন ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক দল অটো ক্ষমতা পেলে প্রত্যাশা-প্রাপ্তির দ্বন্দ্বে সেটা হতে পারে। সে অভিজ্ঞতা এ দেশের মানুষের আছে। কিন্তু সাচ্চা গণতন্ত্রে সেটা চলে না।
ব্রিটেনের এমপি জো কক্সের হত্যাকা- সে দেশের রাজনীতিতে এক বিস্ময়কর ঘটনা। তার মৃত্যুর ধাক্কা হয়তো কাটিয়ে উঠবে ব্রিটেন। কিন্তু তারা যে নজীর সৃষ্টি করেছে তা গণতান্ত্রিক দেশগুলোর জন্য শিক্ষণীয় বৈকি। ব্রিটেন কার্যত পৃথিবীর সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় দেশ। লন্ডনের কথাই ধরি। সেখানে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন সাদেক খান নামের একজন মুসলমান। পৃথিবীর প্রায় সব জাতি ও ধর্মের মানুষ বাস করে লন্ডন শহরে। জো কক্সের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর ব্রিটেনের গণতন্ত্র আমাদের সামনে আরও একবার উদাহরণ হিসেবে হাজির হলো। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের কাজ করছে। কেউ তাদের ওপর কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করছে না। আইনশৃংখলা বাহিনীও নেতানেত্রীর মতো রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছে না। আবার মিডিয়া কভারেজের জন্য সিনেমার নায়ক-নায়িকার মতো নিত্যদিন ক্যামেরার সামনে দাঁড়াচ্ছেন না। মন্ত্রীরা তদন্তের আগেই পুলিশকে আঙ্গুল তুলে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন না ‘অমুক দায়ী’। এ হত্যাকা- নিয়ে ব্রিটেনের রাজনৈতিক দলগুলো কোন দোষারোপের খেলা খেলছে না। জো কক্সের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে তার নির্বাচনী এলাকায় একসঙ্গে উপস্থিত হন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ও বিরোধী নেতা জেরেমি করবিন। বিরোধী দলের এমপি কক্সের ওপর হামলাকে ‘ঘৃণাপ্রসূত’ এবং ‘গণতন্ত্রের ওপর হামলা’ আখ্যা দিয়ে বিরোধী দলীয় নেতা জেরেমি করবিন বলেছেন, তার সম্মানার্থে পার্লামেন্টে অধিবেশন ডাকা হবে। প্রত্যেক রাজনীতিক যেন লেবার এমপি’র জো কক্সের প্রতি সম্মান জানাতে পারে সে জন্য তিনি অধিবেশন ডাকার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বলেছেন, আমরা যেখানেই ঘৃণা, বিভক্তি আর অসহিষ্ণুতা দেখি না কেন, তা রাজনীতি থেকে, আমাদের জীবন ও সমাজ থেকে নির্মূল করতে হবে। আমরা যদি সত্যিকার অর্থে জো’র প্রতি সম্মান জানাতে চাই তাহলে সেবা, সমাজ ও সহিষ্ণুতা- এই মূল্যবোধগুলো লালন করতেই হবে। জো কক্সের নির্বাচনী এলাকার শহর বার্স্টলে ছুটে গেছেন হাউজ অব কমন্সের স্পিকার জো বেরকাও। তারা সবাই জো’র কফিনে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। অথচ আমাদের দেশে এ চিত্র কল্পনা করা যায়? কেউ মারা গেলে বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কেউ খুন হলে আমাদের নেতানেত্রীরা শোক-সমবেদনার বদলে মুখে ভেংচি কাটেন। খিস্তিখেউর করেন মুখ দিয়ে বিষ্ঠার গোলা ছোঁড়েন। মানবতাবোধ ও সমবেদনা যেন হারিয়ে গেছে নেতানেত্রীদের হৃদয় থেকে। রাজনৈতিক ভিন্নমতের কারণে সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমদের মতো ব্যক্তির নামাজে জানাযা সংসদ এলাকায় করতে দেয়া হয়নি।
 জো কক্সের খুনের ঘটনাস্থল থেকে ৫২ বছর বয়সী ঘাতক টমাস মেয়ারকে গ্রেফতার করা হয়। সে এখন পুলিশী হেফাজতে রয়েছে। কিন্তু তাকে বাংলাদেশের মাদারীপুরের কলেজ শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীকে হত্যাচেষ্টা মামলায় রিমান্ডে থাকা আসামী গোলাম ফয়জুল্লাহ ফাহিমের মতো ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হতে হয়নি। খুনের দায়ে তার বিচার হবে। জো কক্সের খুনের পরও পুলিশের বিরুদ্ধে কেউ ব্যর্থতার অভিযোগ তোলেনি। ওটাকেই বলে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলা। অথচ বন্দুকযুদ্ধে গোলাম ফয়জুল্লাহ ফাহিমের মৃত্যুর খবর প্রচার হওয়ার পর আমাদের দেশের কেউ পুলিশের কথা বিশ্বাস করছে না। যেমন বিশ্বাস করেনি কয়েকদিন আগে যশোরে পুলিশের দাবি গণপিটুনিতে ৩ জন নিহতের খবর। শুধু মানবাধিকার সংস্থাগুলোই নয়; সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠেছে। সকলেই অভিযোগ করছেন বন্দুকযুদ্ধ পুলিশের সাজানো নাটক।
পৃথিবীর গণতান্ত্রিক দেশগুলোর দিকে তাকালে আমরা দেখি দেশে কখনো সংকট সৃষ্টি হলে সরকার সংকট উত্তরণে সর্বদলীয় ঐক্যের ডাক দেন। বিরোধী দল, অন্যান্য রাজনৈতিক দল, বিশিষ্টজনদের নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সংকট উত্তরণের পথ খুঁজে বের করেন। অথচ আমাদের দেশে চলছে উল্টো স্রোত। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো চলমান সংকট নিরসন ও জঙ্গীবাদ ঠেকানোর পথ খুঁজে বের করতে সরকারের প্রতি ঐক্যের আহবান জানাচ্ছেন। অথচ সরকার বলছে নো সংলাপ। উল্টো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিবাদ-বিভাজন সৃষ্টি করা হচ্ছে। দেশী-বিদেশী মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মূল্যায়ন হলো- বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে। নাগরিকের অধিকার নেই বললেই চলে। বিএনপির ভাষায় দেশ এখন পুলিশী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। আইন শৃংখলা রক্ষার নামে পুলিশ যখন তখন যাকে খুশি ধরে নিয়ে যাবে; এজন্য কোন মামলা লাগবে না। ‘বন্দুক যুদ্ধ’ ‘ক্রসফায়ার’ ‘গণপিটুনিতে মৃত্যু’ শব্দগুলো আইনের শাসনের সঙ্গে সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছে। পত্রিকায় খবর বের হয়েছে গত ১২ দিনে ২০ জন মানুষ কথিত ক্রসফায়ার আর বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। ইংরেজরা ১৯০ বছর বাংলাদেশসহ এ অঞ্চল শাসন করে গেছে। সেই ইংরেজদের ঘৃণা করবো কি তারা যে গণতন্ত্রের সারিতে রয়েছে সেখানেও আমরা যেতে পারছি না। জাতি হিসেবে এটা আমাদের লজ্জার না গৌরবের? আমরা গণতন্ত্র, জনগণের ভোটের অধিকার, আইনের শাসনের কথা বলে মুখে তুবড়ি উড়াচ্ছি; সত্যিই কি আমরা গণতন্ত্রের পথে রয়েছি? ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে না আলাদা হবে সে জন্য ২৩ জুন গণভোট হবে। অথচ আমাদের সংবিধান থেকে ‘গণভোট’ শব্দটি তুলে দেয়া হয়েছে। জো কক্সের খুনের পর বৃটেনের সব দলের নেতারা যা করলেন সেটা প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্র। তাহলে গণতন্ত্রের অভিধানে আমাদের অবস্থান কোথায়?



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ব্রিটেনের গণতন্ত্র এবং আমরা
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ