Inqilab Logo

শক্রবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

খুলনার চিংড়ি ও পাট রপ্তানিতে ধস

প্রকাশের সময় : ৩১ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এ.টি.এম. রফিক ও আশরাফুল ইসলাম নূর, খুলনা থেকে ঃ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রাণ কেন্দ্রীয় শিল্পনগরী খুলনা জাতীয় অর্থনীতি ও বৈদেশিক বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ‘সোনালী আঁশ’ পাট এবং ‘সাদা সোনা’ খ্যাত হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হতো খুলনাঞ্চল থেকেই। চারটি শর্তের বেড়াজালে পড়ে সীমিত আকারে পাট রপ্তানী হওয়ায় এ খাতের রপ্তানী আয়ে ভাটা পড়েছে।
আর দীর্ঘ তিন মাস চিংড়ি রপ্তানী বন্ধ থাকায় হিমায়িত মৎস্য সেক্টরে রপ্তানী শূন্যের কোটায় বললেও ভুল হবে না। এ দু’টি সেক্টরের ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতাদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। বিমাতাসুলভ আচরণের কারণে খুলনাঞ্চলের সৃষ্ট সংকট সহজে নিরসন হয় না বলে অভিযোগ উন্নয়ন কর্মীদের।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হিমায়িত চিংড়ি ও মৎস্যপণ্যে ব্যবহৃত প্যাকেজিং সামগ্রী বিদেশ থেকে আমদানি না করে দেশীয় বন্ডেড প্যাকেজিং প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় মুদ্রায় এলসি’র মাধ্যমে সংগ্রহ করতেন রপ্তানীকারকরা। কিন্তু গত বছরের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে খুলনা শুল্ক কর্তৃপক্ষ হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানীতে ব্যবহৃত প্যাকেজিং সামগ্রী কার্টুন ও একসেসরিজ সংগ্রহের ক্ষেত্রে মাস্টার এলসি’র বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার পরিবর্তে বৈদেশিক মুদ্রায় ইনল্যান্ড লেটার অব ক্রেডিট ও ইউপি জারির আগেই ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলা এবং মাস্টার এলসি’র সঠিকতা যাচাই করার তিনটি শর্ত আরোপ করে। এতে বিপাকে পড়েন খুলনাঞ্চলের অর্ধশতাধিক রপ্তানীকারক।
রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোর হিসেবে, বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানীকৃত হিমায়িত পণ্যের অন্তত ৭০ ভাগ হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানী করে খুলনাঞ্চল ৩৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে চিংড়ি রপ্তানী হয়েছিল ৫৫০ দশমিক ১৬ মিলিয়ন ডলার। একবছরের ব্যবধানে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে চিংড়ি রফতানি কমে দাঁড়ায় ৫০৯ দশমিক ৭২ মিলিয়ন ডলার। যার টাকায় মূল্যমান প্রায় ৩১৫ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) তথ্য মতে, চিংড়ি রফতানি কমে যাওয়ায় পুঁজি হারিয়ে অন্তত ২০টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশে ৫০টির মতো চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ কারখানা সচল থাকলেও ২০১৪-১৫ অর্থবছরের শেষে সক্রিয় চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ কারখানার সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৫টিতে। ফলে এ শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট ১০ লক্ষাধিক শ্রমিক পড়েন বিপাকে।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট মোঃ গোলাম মোস্তফা জানান, দেশের প্রায় ৭০ ভাগ হিমায়িত চিংড়ি খুলনাঞ্চল থেকে রপ্তানী হয়। গত অর্থ বছর দেশ থেকে ৫০৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যমানের মাছ রপ্তানী হয়। যার এরমধ্যে ৩৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের মাছ রপ্তানী হয়েছে খুলনাঞ্চল থেকেই।
খুলনা কাস্টমস কমিশনার পোশাক শিল্পের ব্যাক টু ব্যাক এলসির শর্তগুলো হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য করার শর্ত দিলে রপ্তানী বন্ধ হয়ে যায়। এ সংকট নিরসনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ৭ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেয়। সে কমিটি কাজ এ ব্যাপারে কাজ করছে।
রপ্তানীকারকদের অভিযোগ, নতুন শর্তে প্যাকেজিং করতে পারায় হাজার কোটি টাকারও বেশী চিংড়ী রপ্তানী বন্ধ হয়ে গেছে। সমস্যার দ্রæত সমাধানের দাবি জানিয়েছেন তারা।
অপরদিকে কাঁচা পাট রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ জুট এসোসিয়েশন (বিজেএ)’র সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ জানুয়ারি এক প্রজ্ঞাপনে দেশের ৪১টি প্রতিষ্ঠানকে ২ লাখ ৭৭ হাজার বেল কাঁচা পাট রপ্তানির অনুমোদন দেয় বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়।
পরে নির্দেশনাটি শিথিল করে বলে, কাঁচা পাট চারটি প্রক্রিয়ায় প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করা যাবে। অর্থাৎ স্বয়ংক্রিয় স্ক্যানিং, মেশিন কাট জুট (১০-১২ মিলিমিটার), জুট সিলভার ও জুট টো প্রক্রিয়ায় কাঁচা পাট রপ্তানিযোগ্য।
রপ্তানীকারকদের অভিযোগ, ব্যবসায়ীদের সাথে কোন ধরনের আলোচনা ছাড়াই সরকার প্রাথমিক পর্যায়ে গত বছরের ৩ নভেম্বর থেকে টানা একমাস পাট রপ্তানী বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। পাট রপ্তানী বন্ধের সিদ্ধান্তের পর রপ্তানী প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত প্রেস হাউসগুলোও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে হাউসগুলোয় কর্মরত লক্ষাধিক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ে।
এ বছরের শুরুতেই চারটি শর্তে সীমিত আকারে ৪ ধরণের পাট রপ্তানীর অনুমতি দেয় সরকার।
এদিকে গত ৫ নভেম্বর বিজেএ’র পক্ষে সংবাদ সম্মেলন করা হয়েছিল। সংবাদ সম্মেলনের উদ্বৃতি দিয়ে কাঁচাপাট রপ্তানীকারক আলহাজ শেখ আব্দুল মান্নান বলেন, রপ্তানীকারক ও পাট ব্যবসায়ীদের সাথে কোন প্রকার আলোচনা না করেই সরকার কাঁচাপাট রপ্তানী বন্ধ ও পরে সীমিত আকারে ৪ ধরণের পাট রপ্তানীতে চারটি শর্তারোপের সিদ্ধান্ত নেয়। অথচ অন্তত ২৫টি দেশে খুলনাঞ্চল থেকে পাট রপ্তানী হতো।
বাংলাদেশ জুট এসোসিয়েশনের ভাইস-চেয়ারম্যান শেখ সৈয়দ আলী বলেন, পণ্যে পাটের মোড়কের ব্যবহার নিশ্চিত করতে গত ৩ ডিসেম্বর সবধরনের কাঁচাপাট রপ্তানি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছিল সরকার। এ ঘোষণার ১২ দিনের মাথায় ১৫ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে চার প্রক্রিয়ায় কাঁচাপাট রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার আওতাবহির্ভূত করে আদেশ জারি করে পাট মন্ত্রণালয়।
তবে শর্ত সাপেক্ষে মাত্র ৪১টি প্রতিষ্ঠানের পাট রপ্তানী অনুমতি দিলেই সমস্যা-সংকটের সমাধান হয়নি। পাট শিল্পকে বাঁচাতে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ উজ জামান বলেন, আমলতান্ত্রিক জঠিলতা ও সরকারের বিমাতা সুলভ ব্যবহারের কারণে খুলনাঞ্চলের মানুষের বঞ্চনার শেষ নেই। কোন একটা সমস্যা হলে তার সমাধানেও কেউ আন্তরিক নন। অবিলম্বে পাট ও হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানী সম্পর্কে দেশের বৈদেশিক আয়ে ভাটা পড়বে। তাতে সরকারের উন্নয়ন প্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: খুলনার চিংড়ি ও পাট রপ্তানিতে ধস
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ