দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
একবার কয়েকজন সাহাবী রাসূলে পাক (সা:)-এর বিবিগণের সামনে হাজির হয়ে রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর রাত এবং দিনের ইবাদত-বন্দেগী ছাড়া কিছুই করেন না। বিবিগণ উত্তর করলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর ইবাদত সম্পর্কে কতটুকুই জানি? তিনি মাসুম, পবিত্র। সাহাবীদের একজন বললেন, আমি রাতভর নামাজ আদায় করব। অপরজন বললেন, আমি জীবনভর রোজা রাখব, তৃতীয়জন বললেন, আমি জীবনভর অবিবাহিত থাকব। কখনো বিবাহ করব না। রাসূলুল্লাহ (সা:) তাদের কথাবার্তা শুনছিলেন। তিনি তাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন “আল্লাহর শপথ! আমি তোমাদের চেয়ে আল্লাহকে বেশী ভয় করি। তবুও আমি রোজা রাখি, ইফতার করি, রাতে নামাজ পড়ি, ঘুমাই, দাম্পত্য জীবনযাপন করি। যে আমার তরীকার উপর নাই সে আমার দলভুক্ত নয়।” (সহীহ বুখারী : কিতাবুন নিকাহ)
কোন কোন সাহাবী অভাব ও দারিদ্র্যতার জন্য বিয়ে করার সঙ্গতিসম্পন্ন ছিলেন না। এমনকি নিজেকে সম্বরণ করাও ছিল খুবই কষ্টকর ব্যাপার। একারণে তারা শারীরিক বিশেষ অঙ্গ কেটে ফেলার মনস্থ করেছিলেন। তারা রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর দরবারে ‘রুহবানিয়াত গ্রহণ করার অনুমতি প্রার্থনা করলেন। তাদের এই অভিপ্রায় জেনে রাসূলুল্লাহ (সা:) খুবই অসন্তুুষ্টি প্রকাশ করলেন। এপ্রসঙ্গে হযরত সায়াদ বিন অয়াক্কাস প্রমুখ সাহাবীগণ বলেন, যদি রাসূলুল্লাহ (সা:) একাজের অনুমতি প্রদান করতেন, তাহলে বহুলোক এর উপর আমল করতে প্রস্তুুত ছিলো। (সহীহ বুখারী : কিতাবুন নিকাহ)
এসকল ঘটনা দ্বারা সহজেই অনুমান করা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সা:) কত বৃহত্তর পরিসরে এবং কত সহজভাবে মানুষকে সত্যিকার ইবাদতের রূপরেখা শিক্ষা দিতেন।
রাসূলুল্লাহ (সা:) স্বয়ং একটানা কয়েকদিন রোজা রাখতেন। ফলে সাহাবীগণও তাঁর অনুসরণে একটানা রোজা রাখার অভিলাষ ব্যক্ত করলেন। কিন্তুু রাসূলুল্লাহ (সা:) তাদেরকে নিষেধ করলেন, যেন তারা এমনরূপে রোজা পালন না করে। সাহাবীগণ মনে করলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) অতিশয় দয়াপরবশ হয়েই তাদেরকে এভাবে রোজা রাখতে বারণ করছেন। এজন্য তারা ইফতার করলেন না। অপরদিকে রাসূলুল্লাহ (সা:) দু’দিন রোজা রেখেছিলেন, ঘটনাক্রমে তৃতীয়দিন চাঁদ দেখা গেল। তিনি ইফতার করলেন এবং বললেন, যদি মাস আরও দীর্ঘ হত, তাহলে আমার রোজাও দীর্ঘায়িত হত। এতে করে এ ব্যাপারে যারা গোঁড়ামী করছে, তাদের গোঁড়ামীর মুখোশ খুলে যেত।
একথা শুনে সাহাবীগণ আরজ করলেন ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনিত একটানা রোজা পালন করেছেন। প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, তোমাদের মাঝে আমার মত কে আছে? আমাকে আমার প্রতিপালক পানাহার করার। (সহীহ মুসলিম : কিতাবুস সাওম) একারণে ইসলামের বিধান অনুসারে সাধারণ উম্মতের জন্য একটানা কয়েকদিন রোজা রাখা বৈধ নয়।
একবার রাসূলুল্লাহ (সা:) কোন একটি মসজিদে গমন করে দেখলেন, এর এককোণে একটি রশি ঝুলছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এখানে রশি ঝুলছে কেন? লোকজন উত্তর করল, এই রশিটি যয়নাবের দাসী টাঙিয়ে রেখেছে। রাতে দাঁড়িয়ে বন্দেগী করতে করতে যখন সে দাঁড়াতে অপারগ হয়ে যায়, তখন এই রশি ধরেই সে উঠা-বসা করে। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা:) নির্দেশ করলেন, রশিটি খুল দাও, আর তোমরা যতক্ষণ সুস্থ, সচেতন থাকবে, ততক্ষণই কেবল নামাজ আদায় করবে। আর যদি পরিশ্রান্ত হয়ে অপারগ হয়ে যাও, তাহলে বসে থাকাই উত্তম। (জামউল কাওয়ায়েদ বহাওয়ালায়ে মুজামে করীর ও আওছাত লিত্তিবরানী ও আবু দাউদ)
একবার একজন মহিলা রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। তাকে দেখে হযরত আয়েশা (রা:) বললেন, এতো খাওলা। লোকজন বলছে, সে নাকি রাতভর নিদ্রা যায় না, ইবাদত-বন্দেগীতে অতিবাহিত করে। তা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন, সে রাতে মোটেই ঘুমায় না? হে লোক সকল! তোমরা ঐ পরিমাণ ইবাদত-বন্দেগী কর, যতটুকু ক্ষমতা তোমাদের আছে। (সহীহ বুখারী, মসলিম, মুয়াত্তা ইমাম মালেক, নাসাঈ ও জামউল কাওয়ায়েদ)
যারা নিজেদের শক্তি ও সামর্থ্যরে অতিরিক্ত রাতভর নামাজে মশগুল থাকত, তাদেরকে লক্ষ্য করে রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, ঐ পরিমাণ কাজের কষ্টই সহ্য কর, যা তোমাদের সাধ্যের ভিতর আছে। কেননা তোমরা যতক্ষণ পর্যন্ত অস্বস্তিবোধ না কর, আল্লাহপাক ততক্ষণ অস্বস্তিবোধ করেন না। আল্লাহপাকের নিকট ঐ কাজটি অধিক পছন্দনীয়, যা তোমরা হরহামেশা করে যাচ্ছ। যদিও তার পরিমাণ কম হয়। (আবু দাউদ, আল-কামদু ফিস সালাত অধ্যায়)
হজ্জের সময় রুহবানিয়াতের বহু আচার-অনুষ্ঠান আরবদের মাঝে চালু ছিল। কোন কোন হাজী এই অঙ্গীকার করত যে, সে এই সফরে মুখে কোন কথা বলবে না। অথবা এই শপথ করত যে, সবসময় পায়ে হেঁটে চলবে, কখনো যানবাহনের ধারে কাছেও যাবে না। যদিও যানবাহন সংগ্রহের পরিপূর্ণ সুযোগ তার আছে। আবার কেউ এই শপথ করত যে, কখনো ছায়ায় অবস্থান করবে না। সবসময় প্রখর রোদেই অতিবাহিত করবে। কোন কোন লোক নিজের অপরাধের প্রকাশকল্পে নাকের সাথে রশি বেঁধে কা’বা শরীফের তাওয়াফ করত এবং এই কাজকে পুণ্য বলে মনে করত।
কিন্তুু পবিত্র ইসলাম এই সকল আচার ও আচরণকে চিরতরে নির্র্মূল করে দিয়েছে এবং এসঙ্গে ঘোষণা করেছে-“অনর্থক ভিত্তিহীন কষ্টবরণ আল্লাহর সন্তুুষ্টির পরিচায়ক হতে পারে না।”
একবার হযরত ওকবা বিন আমের (রা:)-এর বোন এই শপথ করেছিল যে, তিনি পদব্রজে হজ্জ সমাপন করবেন। হযরত ওকবা (রা:) রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর খেদমতে এসে এব্যাপারে ফতোয়া জিজ্ঞেস করলেন। রাসূলুল্লাহ (সা:) উত্তরে জানালেন, তোমার বোনের এই শপথের কোন প্রয়োজনীয়তা আল্লাহপাকের নেই। বরং তাকে গিয়ে বলো, সে যেন যানবাহনে চড়ে হজ্জ কাজ সমাধা করে।” (আবু দাউদ ও মানসাদে ইবনে জারুদ, ঈমান ও নজর অধ্যায়) অনুরূপরভাবে রাসূলুল্লাহ (সা:) একব্যক্তিকে দেখলেন যে, কুরবানীর উট সাথে থাকা সত্তে¡ও সে পদব্রজে পথ চলছে। তিনি তাকে উটের উপর আরোহণ করতে নির্দেশ করলেন। সে ক্ষমা প্রার্থনা করে বললো, এ যে কুরাবানীর উট। এর উপর কেমন করে আরোহণ করি? রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন, আমি জানি এটা কুরবানীর উট কিন্তু তবুও তুমি এর উপর আরোহণ করে পথ চল। (সহীহ বুখারী : ১ম : ৮২ পৃ:)
একবার হজ্জের সফরের সময় রাসূলুল্লাহ (সা:) একবৃদ্ধকে দেখলেন যে, সে চলতে পারছে না। তার ছেলে তাঁকে উভয় দিকের হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। রাসূলুল্লাহ (সা:) জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন যে, বৃদ্ধ লোকটি পদব্রজে হজ্জ আদায় করার শপথ করেছে। রাসূলুল্লাহ (সা:) তার প্রতি লক্ষ্য করে বললেন, কেউ তার জানের উপর কষ্ট আরোপ করুক, এমন কাজের কোন প্রয়োজন আল্লাহ পাকের নেই। তোমরা এই বৃদ্ধ লোকটিকে যানবাহনে চড়িয়ে দাও। (আবু দাউদ, তিরমিজী, ইবনে জারুদ, নাসাঈ) একবার রাসূলুল্লাহ (সা:) কোন এক বিষয়ের উপর খুতবা দিচ্ছিলেন, এমন সময় একজন লোককে দেখলেন যে, সে নিদাঘ সূর্যের তাপে খোলা মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এর অবস্থা কি? লোকজন উত্তর করল, এ লোকটি শপথ করেছে যে, সে কখনো বসবে না, ছায়ায় দাঁড়াবে না, কাহারো সাথে কোন কথাও বলবে না এবং একটানা রোজা রেখে যাবে। এর নাম হচ্ছে আবু ইসরাইল। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন, তাকে গিয়ে বল, সে যেন কথা বলে, দাঁড়িয়ে না থেকে বসে, ছায়ায় আরাম গ্রহণ করে এবং নিজের রোজা পুরা করে। (সহীহ বুখারী, আবু দাউদ ও ইবনে জারুদ)
হজ্জের সময় একবার রাসূলুল্লাহ (সা:) দেখলেন যে, একটি লোকের নাকে রশি বাঁধা আছে এবং আর একটি লোক সেই রশি ধরে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি তার নিকট গেলেন এবং রশি কেটে দিলেন তারপর সহায়তাকারী লোকটিকে বললেন, নাকের রশি ছেড়ে তাকে সহায়তা কর এবং তাকে তাওয়াফ করাও। (সহীহ বুখারী : ঈমান ও নজর অধ্যায়) এই শ্রেণীর অপ্রয়োজনীয় সাধনার প্রবাহ দেখে খৃষ্ঠান পাদ্রীদের অবর্ণনীয় দু:খ-কষ্টের কথা তুলে ধরে রাসূলে পাক (সা:) বললেন-নিজের উপর কঠোরতা প্রদর্শন করো না। কেননা, তোমাদের পূর্ববর্তী কাওমের লোকেরা নিজের উপর কঠোরতা আরোপ করেই ধ্বংস হয়ে গেছে। তাদের পরবর্তী বংশধরদের এখনো তোমরা বিভিন্ন গীর্জা ও স্তুূপের মাঝে দেখতে পাবে। (আবু দাউদ, মুজামে করীব, আওছাত লিত্তাবরানী, জামউল কাওয়ায়েদ)
খাতিমুল আম্বিয়া (সা:) ইবাদতের এসকল ভ্রান্ত তরীকাকে নিজের ছোট একটি কথার দ্বারাই নির্মূল করে দিয়েছেন। ‘লা জারূরাতা ফিল ইসলাম’ অর্থাৎ ইসলামে রুহবানিয়াত বা নীতিহীন কৃচ্ছ¡তার কোন প্রয়োজন নেই। (আবু দাউদ) (চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।