দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
“ফিরে এলো আজ সেই মহ্ররম মাহিনা ত্যাগ চাই মর্শিয়া ক্রন্দন চাহিনা।” আরবী নববর্ষের প্রথম মাস হ’ল ‘মহররম’। মহররম অর্থ নিষিদ্ধ বা পবিত্র। অর্থাৎ এ মাসে কোনরূপ যুদ্ধ বিগ্রহ ঝগড়া-ফাসাদ নিষিদ্ধ বা নাজায়েজ। রাসূল (সাঃ) এ মাসে কখনো কাফেরদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হননি। মহররম এর দশ তারিখকে বলা হয় ‘আশুরা’। একক দিন হিসাবে ১০-ই মহররম যত ঐতিহাসিক ও সৃষ্টিগত ঘটনা ঘটেছে অন্য কোন দিনে তা হয় নাই।
হাদীস শরীফে আছে; “রাসূল (সাঃ) এর উম্মতদের গোনাহ মাফের ওয়াদা আল্লাহপাক এ দিনেই করেছিলেন। জিব্রাইল (আঃ) এ দিনে পৃথিবীতে সর্বপ্রথম রহমতের ভান্ডার নিয়ে আসেন, আর আঝোর ধারায় রহমতের বৃষ্টির সূচনা হয়েছিল এ দিনে। এ দিন আল্লাহপাক আরশে আজীমে সমাসীন হন; এ দিনে রাসুল (সাঃ) কে চিরতরে নিষ্পাপ ঘোষনা করা হয়। এ দিন দুনিয়া ধ্বংস প্রাপ্ত হবে।
পৃথিবীতে কোন বড় কাজ, বড় আদর্শের প্রতিষ্ঠা, বড় আত্মত্যাগ ছাড়া সম্ভব নয়। সেদিন কারবালার মরুপ্রান্তরে হযরত ইমাম হোসেন (রাঃ) এর বড় আত্মত্যাগ ও মর্মান্তিক শাহাদতের মধ্য দিয়ে যে কারবালার সূচনা হয়েছে তা আজও থেমে যাই নাই। যুগে যুগে যে কত কারবালা ঘটেছে, কত প্রাণের রক্তে এ মাটির পৃথিবী সিক্ত হয়েছে এর হিসাব করা সম্ভব নয়।
কারবালা কেবল ধ্বংসই করে নাই, সাথে সাথে শিক্ষা দিয়েছে নতুন করে পুনঃ জাগরনে। তাই বলা হয় ঃ “ইসলাম জিন্দাহোতে হ্যায়, হ্র কারবালা কি বাদ”। এক বিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এ চরম সভ্যতার যুগে সভ্য মানুষ আজ হিংসা-দ্বেষ ও ক্ষমতার লোভে যে কারবালার পুনঃরাবৃত্তি ঘটায়ে চলেছে কে জানে এর শেষ কোথায়? হয়তো এ রক্তস্নাত হয়ে নতুন যে সূর্যদ্বয় হবে তার আলোয় নতুন যে পথ খুঁজে পাবে বিশ্ব মানব তাই হবেÑ“মোহাম্মদী ইসলাম।”
আজ কেবল মুসলমানরা নয়, সমগ্র বিশ্বমানব এক মহাযুদ্ধের দ্বার প্রান্তে দন্ডায়মান। মানুষ আজ সকল মানবগড়া মতবাদ হতে মুখ ফিরায়ে চেয়ে আছে এক পথের সন্ধানে। মুসলিম বিশ্বের নেতাগণ, আলেমগণ ব্যর্থ হচ্ছেন সে পথের দিশা দিতে, সে নেতৃত্ব দিতে। কারণ এজন্য যে আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব ও শক্তির প্রয়োজন তা তাদের নেই।
আজকের বিশ্বপ্রেক্ষাপটে, ধর্মীয়;রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণের মাধ্যমেই প্রকৃত পক্ষে খুঁজে দেখা দরকার কি কারণে মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য বিনষ্ট হয়েছে কেন এ জাতি বর্তমান দুঃখজনক অবস্থায় এসে উপনীতি হয়েছে। জার্মান ঐতিহাসিক ভন ক্রেমার লিখেছেন, “যদি আলী এবং মুয়াবিয়ার মধ্যে কোন সংঘর্ষ না হতো তাহলে মুসলমানদের ভবিষ্যৎ ভাগ্য আরও প্রীতিকর এবং অধিকতর ও সাফল্যমন্ডিত হতো।” হযরত আলী (রাঃ) যিনি রাসুল (সাঃ) এর বংশধর এবং যাকে নবী (সাঃ) জ্ঞানের দরজা বলেছেন; তার সাথে মুয়াবিয়ার যুদ্ধ না হতো তাহলে হয়তো ইসলামে আত্মঘাতি সংঘর্ষ; গুপ্ত হত্যার পর উন্মুক্ত হতো না।
রাসূল (সাঃ) এর তিনটি পুত্র সন্তান কোন এক অপ্রকাশ্য আধ্যাত্মিক শক্তির কারণে শাহাদৎ প্রাপ্ত হলে, তিনি বাধ্য হয়ে তাঁর চাচাতো ভাই আলীর সাথে তার মেয়ে ফাতেমার বিবাহ দিয়ে বংশের ধারা ঠিক রাখেন। এখান থেকেই সৈয়দ বংশের উৎপত্তি। এই সৈয়দ বংশকে ধ্বংস করার জন্য ঘটলো কারবালা। উদ্দেশ্য যে মোহাম্মদীর জন্ম হয়েছে একে অংকুরে শেষ করা যাতে আগামী পৃথিবীতে মোহাম্মদী না থাকে। ইব্রাহীমি রোজ কেয়ামত পর্যন্ত চলে। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় জয়নুল আবেদীন (সাধক কুলের মাথার মুকুট) বেঁচে গেলেন। বাকী সব শহীদ হলেন ১০ই মহররম শুক্রবার কারবালার মরু ভূমে।
জোহরের নামাযে সেজদা রত অবস্থায় ইমাম হোসেইনকে ১০ই মহররম শুক্রবার শহীদ করা হয়। গলা কেটে ছিন্ন পবিত্র মস্তক বর্শা ফলকে বিদ্ধ করে দামেস্কে ইয়াজিদের নিকট পাঠানো হয়।
এ অসম ও অন্যায় যুদ্ধের পূর্বে এজিদ বাহিনী পানিকে রাজনৈতিক ঘৃন্য অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে। তিন দিন ধরে ইমাম হোসেন শিবিরে একটুও পানি নেই। অনাহার ক্লিষ্ট; পিপাসার্ত ছোট ছোট শিশু, আপনজন ও সঙ্গী সাথীদের করুন মুখের দিকে চেয়ে বীর পুরুষ ইমাম হোসেন এর চোখে ও পানি এলো। তিনি বুঝতে পারলেন নিশ্চিত মৃত্যুর হাতে আমরা। ইব্নে যিয়াদ চার হাজার সৈন্য নিয়ে ফোরাত নদী ঘিরে ফেলেছে। পানির জন্য শিশু সন্তানরা আত্ম চিৎকার করছে, শিবিরে পানির জন্য হাহাকার উঠেছে।
এ প্রসঙ্গে এসে স্মরণ করতে হয় সেদিন ইব্রাহীম পুত্র ইসমাইলের জন্য এরূপ কঠিন পরিস্থিতিতে পানির ব্যবস্থা হয়েছিল জমজম কুপ সৃষ্টির মাধ্যমে। আর সেদিন মোহাম্মদী সন্তানদের জন্য একটু পানির ব্যবস্থাও হয় নাই। কিন্তু কেন? শিরকেটে এত নৃশংস ভাবে হত্যা করে বর্শা ফলকে গেঁথে নিয়ে যাওয়া এটাও কি ঠেকানো যেত না? কিন্ত কেন?
প্রেমিক কবি নজরুল তাই লেখেছেন ঃ
“ফোরাতের পানিতে নেমে ফাতেমা দুলাল কাঁদে
অঝোর নয়নে রেÑ
দু’হাতে তুলিয়া পানি ফেলিয়া দিলেন অমনি
পাড়লি কি মনে রে ।।
দুধের ছাওয়াল আসগর এই পানি চাহিয়ে রে
দুশমনের তীর খেয়ে বুকে ঘুমাল খুন পিয়েরে;
শাহীর নওশা কাশেম শহীদ এই পানি বিহনে রে।।”
রাসূল দোয়া করলে যদি তাঁর সাহাবার মৃত সন্তানদ্বয় জীবিত হতে পারে, তবে তিনি কি পারতেন না নিজ সন্তানকে ফিরিয়ে আনতে? পারতেন, কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় সেদিন রাজী ছিলেন। ইব্রাহীম নবী তার একটা সন্তান কুরবানী করেছেন, আর রাসূল; আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উম্মতের কল্যাণে তিনটি পুত্র সন্তান দান করেছেন।
রাসূল (সাঃ) এর প্রিয় সন্তানদের নৃশংস ভাবে শহীদ করে যে কারবালার সূচনা করেছিল এজিদ, তার অভিশাপে সারা বিশ্বে আজও অশান্তি বিরাজমান। যুগে যুগে তাই বহু কারবালা সংঘটিত হয়ে চলেছে। এর সমাপ্তি যে কবে হবে কে জানে? আমাদের মনে হয় ততদিন নয় যত দিন না বিশ্ব মানব বিশেষ করে মুসলমানরা; মোহাম্মদ (সাঃ) এর বংশধরদের সঠিক মূল্যায়ন করে সেদিনের ভুলের ক্ষমা চেয়ে “মোহাম্মদীতে” আশ্রয় নিবে; ততদিন কারবালার অভিশপ্ত ছোবল হতে মুক্ত হতে পারবে না।
কারবালার পানি নিয়ে যে দুঃখজনক ও নির্মম রাজনীতির সূচনা এর পরিণতিও ভোগ করতে হবে বিশ্ব মানবকে। তাই আজ পানি বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিরোধের কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়েছে। ফলে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছে অন্যদেশগুলো। বলা হচ্ছে পৃথিবীতে পানি নিয়ে যত যুদ্ধ বিগ্রহ হয়েছে ধর্ম নিয়ে এত হয়নি।
প্রখ্যাত পরিকল্পনা বিদ পিটার গেলইক বলেছেন ঃ
আন্তঃরাষ্ট্রীয় রাজনীতিতে পানি ক্রমশই একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হচ্ছে। পৃথিবীর এই মৌলিক প্রাকৃতিক সম্পদটিকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে ভৌগলিক, রাজনৈতিক রণ কৌশল। পানি পরিণত হয়েছে এখন সবচেয়ে বড় মরণাস্ত্রে। বিশ্ব ব্যাংকের পানি সম্পদ বিষয়ক প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসমাইল সেরাজেলদিন বলেছেন ঃ “চলতি শতাব্দীতে যতগুলো যুদ্ধ হয়েছে তার অধিকাংশ জ্বালানী তেলকে কেন্দ্র করে। কিন্তু আগামী শতাব্দীর যুদ্ধ হবে পানি সম্পদকে কেন্দ্র করে।” আগামীতে পানির সদ্ব্যবহার ও ন্যায় সংগত বন্টন করা না হলে পানির এমন অকাল পড়ে যাবে। বিশ্বের কমপক্ষে ২০০ কোটি লোক কোন না কোন ভাবে পানি সংকটে আক্রান্ত। পানি নিয়েই সৃষ্টির সূচনা, আর পানি নিয়েই যে পৃথিবী ধ্বংসের কিছু একটা ঘটবে না তা বলা যায় না। প্রকৃতি গত ভাবেই হউক বা মানুষ দ্বারা সৃষ্ট কোন অন্যায় কারনেই হউক এ রকম একটা কিছু ঘটতে পারে। সময়ই সেটা বলে দিবে। পানি, রাজনীতির কৌশল হয়ে আর একটা কারবালার পুনরাবৃত্তি ঘটে কি না আমরা সে দিকে উৎকন্ঠার সাথে চেয়ে রইলাম।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।