Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জঙ্গি বিরোধী অভিযান শেষ : ১৪ হাজারে জঙ্গি ১৯৪

প্রকাশের সময় : ১৮ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:০৫ পিএম, ১৭ জুন, ২০১৬

ইনকিলাব রিপোর্ট : দেশজুড়ে পুলিশের জঙ্গিবিরোধী বিশেষ অভিযান শেষ হয়েছে। এতে মোট গ্রেফতার হয়েছে ১৪ হাজার ৫৫২জন।  সাত দিনের এই অভিযানে ১৯৪ জন জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। অভিযানে দুর্ধর্ষ কোনো জঙ্গি গ্রেফতার হয়নি। এমনকি গত ১৮ মাসে উগ্রপন্থীদের ৪৭টি হামলায় যে ৪৯ জন নিহত হয়েছেন, তাতে জড়িত কাউকে গ্রেফতারের কথা জানাতে পারেনি পুলিশ। আগে থেকে ঘোষণা দিয়ে পরিচালিত এ অভিযান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। অভিযানে পুলিশের বিরুদ্ধে গ্রেফতার বাণিজ্যের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, অভিযানের নামে একদিকে সরকার বিরোধীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে, অন্যদিকে গ্রেফতার বাণিজ্যও চলছে। বাম সংগঠনগুলোও অভিযানের বিরোধিতা করেছেন। এমনকি খোদ সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যেও এ নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দেখা গেছে। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান অভিযানে গণগ্রেফতারের সমালোচনা করে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ এনেছেন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এবং বিভিন্ন বিদেশি দূতাবাসগুলোও এই অভিযান বন্ধ করার আহবান জানিয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) গতকাল এক বিবৃতিতে অপরাধের সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ ছাড়াই বাংলাদেশে নির্বিচারে গণগ্রেফতার বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। জঙ্গিবিরোধী অভিযান সম্পর্কে জানতে গত বুধবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা স্টিফেনস ব্লুম বার্নিকাট। ‘এত বেশি সংখ্যক’ গ্রেফতার নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলেন, এবারের অভিযানে ১৩ হাজারের ওপরে গ্রেফতার করা হয়েছে, তার মধ্যে জঙ্গি সন্দেহে আনুমানিক দু’শ’ মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এত বড় একটা সংখ্যার বিপরীতে যখন দু’শ’ মানুষ গ্রেফতার হয় জঙ্গি সন্দেহে, তখন আমাদের মনে সন্দেহ জাগে যে তাহলে এই অভিযানের মূল উদ্দেশ্য কী ছিল? তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, টার্গেট কিলিং ও জঙ্গিবাদ দমনেই সারাদেশে বিশেষ অভিযান চালানো হয়েছে। এ অভিযানে কোনো ধরনের পুলিশি গ্রেফতার বাণিজ্য হয়নি। তিনি দাবি করেন, এ অভিযান মানুষের মধ্যে স্বস্তি এনে দিয়েছে।
গত ৫ জুন চট্টগ্রামে খুন হন পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু। নৃশংস এ খুনের ঘটনার পর পরই সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় এ ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে জেএমবি। র‌্যাব, পুলিশসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা জেএমবির সূত্র ধরে তদন্ত শুরু করে। ঘটনার তিন দিনের মাথায় এ নিয়ে কিছুটা আশাবাদ শোনা গেলেও পরে সবই আরো দশটা মামলার মতোই হারিয়ে যায়। এখনও পর্যন্ত সেই তদন্তের কোনো আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। পুলিশ সুপারের স্ত্রী হত্যার পর গত বৃহস্পতিবার পুলিশ সদর দপ্তরে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হকের নেতৃত্বে সভা হয়। সেখান থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয়, ১০ জুন শুক্রবার থেকে দেশব্যাপী জঙ্গিবিরোধী অভিযান শুরু হবে। তবে বাবুল আক্তারের স্ত্রীকে হত্যার পর থেকে দেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন ১৩ জন। তাদের মধ্যে সন্দেহভাজন জঙ্গি নিহত হয়েছেন পাঁচজন। বাকিরা ছিনতাইসহ অন্যান্য সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িত বলে দাবি করছে পুলিশ। ১০ জুন অভিযান শুরুর পর প্রথম চারদিন গ্রেফতারের সংখ্যা প্রকাশ করা হলেও এ নিয়ে যখন দেশে বিদেশে সমালোচনা শুরু হয়। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি শুরু থেকেই এর সমালোচনা করে বলেছে পুলিশ টার্গেট করে বিএনপি নেতাকর্মীদের বাসা বাড়িতে হানা দিয়ে তাদেরকে গ্রেফতার করছে। জামায়াতে ইসলামীরও একই অভিযোগ। অভিযানের ৫ দিনের মাথায় দেশের কারাগারগুলো ভরে যায়। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। সরকারের শরীক বাম সংগঠনগুলোও এ অভিযানের সমালোচনা করে। এমনকি খোদ সরকার দলীয় এমপি, নেতাকর্মীরাও এ অভিযান নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ছিলেন। জঙ্গিবিরোধী অভিযান এক পর্যায়ে গণগ্রেফতারে রূপ নিলে সরকারের উপর বিভিন্ন মহল থেকে চাপ আসতে থাকে। এক পর্যায়ে গত বুধবার থেকে পুলিশ সদর দপ্তর সারাদেশে মোট গ্রেফতারের সংখ্যা তাদের বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশ করা বন্ধ রাখে। কেবল জঙ্গি সন্দেহে গ্রেফতারকৃতদের সংখ্যা প্রকাশ করা হয়। অভিযানে নিরীহ মানুষকে জঙ্গি সন্দেহে ধরে আবার পরে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। বগুড়ায় আটক কয়েকজনকে ছেড়ে দেয়ার জন্য খোদ সরকারদলীয় নেতারাই সুপারিশ করেছেন এমনও নজির আছে। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী শুরু থেকে দাবি করছে, বিরোধী দলকে দমন-নিপীড়ন করতে এ অভিযান চালানো হয়। ঈদের আগে পুলিশকে বাণিজ্য করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে পুলিশ এ ধরনের অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করে আসছে। গতকাল  শুক্রবার এসব অভিযোগের মধ্যেই শেষ হয়েছে পুলিশের সপ্তাহব্যাপী সাঁড়াশি অভিযান। এ অভিযানে শেষ পর্যন্ত কত গ্রেফতার করা হয়েছে তা নিয়ে পুলিশ গত দুদিন আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো তথ্য দেয়নি। তবে পুলিশ সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা কামরুল আহছান লস এঞ্জেলেস টাইমসকে জানান, অভিযানে ১৪৫৫২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে জঙ্গি সন্দেহে গ্রেফতার হয়েছে মোট ১৯৪জন। পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, এর মধ্যে জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) ১৫১ জন, জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশে ৭জন, হিযবুত তাহরিরের ২১ জন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) ৬জন, আনসার আল ইসলামের ৩জন, আল্লাহর দলের ৪জন, হরকাতুল জিহাদের একজন ও আফগানিস্তান থেকে ফেরত একটি জঙ্গি সংগঠনের একজন সদস্য রয়েছেন। পুলিশের পাঠানো বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, প্রথম দিনে জঙ্গি সন্দেহে ৩৭, দ্বিতীয় দিনে ৪৮, তৃতীয় দিনে ৩৪, চতুর্থ দিনে ২৬, পঞ্চম দিনে ২১ জন ও ষষ্ঠ দিনে ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। অভিযানে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে গতকাল শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ধরা পড়েছে ১৭ জঙ্গি। এদের কাছ থেকে একটি পাইপগান, একটি শাটারগান, দুটি ককটেল, একটি রামদা, একটি চাপাতি ও ১৪টি উগ্রপন্থী বই উদ্ধার করা হয়েছে।  
চট্টগ্রামে ১৬৯ জন গ্রেফতার
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, চট্টগ্রামে তিন কথিত জঙ্গিসহ শেষ দিনের অভিযানে ১৬৯ জনকে আটক করা হয়েছে। জঙ্গি সন্দেহে আটকৃতরা হলো জুলফিকার আলী, আলাউদ্দিন রুবেল ও মুহিবুল আলম। এনিয়ে এক সপ্তাহের অভিযানে চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলায় ২০৪৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) রেজাউল মাসুদ জানান, আটক তিন জঙ্গি বাংলাভাইয়ের সঙ্গে কাজ করতো। এখন তারা নিজ নিজ এলাকায় অবস্থান করে শক্তি সঞ্চয় করছিল। তিনি জানান, সাঁড়াশি অভিযানে ১৬৯ জনকে আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে পরোয়ানাভুক্ত ১৫১ জন, নিয়মিত মামলার ৪ জন, জামায়াতের ১ জন, পুলিশ অ্যাক্টে ৩ জন ও অন্যান্য অভিযোগে আটক ৮ জন আসামি রয়েছেন।  
রাজশাহীতে আটক ৪৪
রাজশাহী ব্যুরো জানায়, গত বৃহস্পতিবার গভীর রাত থেকে শুক্রবার ভোর পর্যন্ত নগরীর বিভিন্ন স্থানে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ অভিযান চালিয়ে ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিসহ মোট ৪৪ জনকে আটক করেছে। নগরীর চার থানা পুলিশ ও ডিবি অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করে।
সহকারী পুলিশ কমিশনার ও নগর পুলিশের মুখপাত্র ইফতেখায়ের আলম জানান, গত বৃহস্পতিবার গভীর রাত থেকে পুলিশের অভিযানের অংশ হিসেবে নগরীর চার থানা পুলিশ ও ডিবি পুলিশ অভিযান চালিয়ে ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিসহ মোট ৪৪ জনকে আটক করে। এরমধ্যে বোয়ালিয়া মডেল থানা ১৯, রাজপাড়া থানা ১২, মতিহার থানা ৬, শাহমখদুম ৪ এবং ডিবি পুলিশ ৩ জনকে আটক করেছে। আটক ৪৪ জনের মধ্যে ১৭ জন ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি রয়েছে।
পটুয়াখালীতে শিবির নেতাসহ আটক ৩
পটুয়াখালী জেল সংবাদদাতা জানায়, আজ ভোররাতে পটুয়াখালী সদর থানা পুলিশ শহরের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে পটুয়াখালী জেলা ছাত্রশিবির দক্ষিণের সভাপতি আ. রব (২৪) এবং ছাত্র শিবিরের সাথী সদস্য আরীফ (২২)কে গ্রেফতার করেছে। এ ছাড়াও ঢাকায় ইতিপূর্বে জঙ্গি কানেকশনে গ্রেফতারকৃত জামিনপ্রাপ্ত রোকনুজ্জামান (৩০)কে গ্রেফতার করেছে। রোকনুজ্জামানের বাড়ি পটুয়াখালীর ছোট বিঘাই গ্রামে।
সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তারিকুল ইসলাম জানান, তাদের বিরুদ্ধে নাশকতা পরিকল্পনার অভিযোগ রয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জঙ্গি বিরোধী অভিযান শেষ : ১৪ হাজারে জঙ্গি ১৯৪
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ