দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
(পূর্ব প্রকাশিতের পর) যে জন্তুুর দুধ প্রতিমার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হত তাকে বলা হত বাহীরা আর যে জন্তুু প্রতিমার নামে ছেড়ে দেয়া হত তাকে সাইবা বলা হত এবং যে উটনী পর পর মাদী বাচ্ছা প্রসব করত, একেও প্রতিমার নামে ছেড়ে দেয়া হত-এর নাম ওয়াসীলা। আর যে নর উটকে বিশেষ সংখ্যক প্রজননের কাজে ব্যবহার করা হত, একেও প্রতিমার নামে ছেড়ে দেয়া হত-এর নাম ছিল হাম। এসকল জন্তুু কোন কাজে লাগান তাদের কাছে নিষিদ্ধ ছিল।
আবার কখনো কখনো মৃতদের কবরের পাশে, গাভী অথবা বকরী যুবেহ করা হত। কিন্তু ইসলাম মাতম জারির সংস্কার করে এর প্রতিও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং এগুলোকে নাযায়েজ সাব্যস্ত করেছে। রাসূলুল্লাহ (সা:) ইরশাদ করেছেন, “লা আকরা ফিল ইসলামি” অর্থাৎ ইসলামে কবরের সন্নিকটে পশু যবেহ করা যায়েজ নয়। (আবু দাউদ : কিতাবুল জানায়েজ, ২য় খন্ড, ১৪৪ পৃ:)
যাহেলিআতের যুগে আরবে এই দস্তুরও ছিল, মানুষ স্বীয় বদান্যতা ও দানশীলতা এভাবে প্রকাশ করত যে, দুই প্রতিদ্ব›দ্বী পশু কুরবানীর বাজী রেখে কাজ শুরু করতো। এদের একজন একটি উট যবেহ করতো, এর জবাবে প্রতিপক্ষও একটি উট যবেহ করত। এভাবেই প্রতিদ্ব›দ্বীতা চলে আসতো। তাদের মাঝে যার উট শেষ হয়ে যেত কিংবা কেউ পুনর্বার যবেহ করতে অস্বীকার করতো, সে পরাজয়বরণ করতো। পবিত্র ইসলাম এসকল কুরবানী ও জান এবং মাল ধ্বংস করাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। (আবু দাউদ : কিতাবুল আদাহী, ২য় খ: পৃ: ৫) প্রকৃতপক্ষে সুস্বাদু খাদ্য ও পানীয় পরিহার করে রিয়াজত করা এবং কঠিন কষ্ট সহ্য করে ইবাদত করাও ইসলাম অনুমোদন করে না।
বৈরাগ্য ইসলাম নয় :
সাধারণভাবে এই ধারণা করা হয়ে থাকে যে, বান্দাহ নিজের উপর যে পরিমাণ কষ্ট বরণ করে নেয়, ঠিক সে পরিমাণই আল্লাহপাক সন্তুুষ্ট হয়ে থাকেন। আর এটাকেই বড় ইবাদত মনে করা হত। এজন্য মানুষ নিজের দেহের উপরে বড় বড় কষ্টকর কাজ ও অনুশীলন চাপিয়ে দিত এবং মনে করত, যে পরিমাণ দেহকে কষ্ট দেয়া হবে ঠিক সে পরিমাণ রূহ বা আত্মার পবিত্রতা ও বিশুদ্ধতা আসবে। এজন্য গ্রীক দার্শনিকদের মাঝে আশরাফিয়াত এবং খৃস্টানদের মাঝে রূহবানিয়াত এবং হিন্দুদের মাঝে যোগ পালন করা এসকল ভ্রান্ত বিশ্বাসেরই বিষময় ফল হিসেবে দেখা যায়। এদের কেউ গোশত না খাওয়ার অঙ্গীকার করতো, কেউ সপ্তাহ ভর অথবা চল্লিশ দিনে একবার খাদ্য গ্রহণ করতো। কেউ সর্বাঙ্গ উলঙ্গ রাখত, সকল প্রকার লেবাসকে পবিত্রতার অন্তরায় মনে করত। কেউ চিল্লাসহকারে ঠান্ডা জায়গায় নগ্নদেহে অবস্থান করত। কেউ বছরের পর বছর জীবনভর নিজেকে দাঁড় করিয়ে রাখত, কিংবা বসে থাকত এমনকি শয়ন করা ও নিদ্রা যাওয়া হতে পরিপূর্ণভাবে দূরে থাকত। কেউ নিজের একহাত দাঁড় করিয়ে রাখত যেন তা শুকিয়ে যায়। কেউ জীবনভর অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বা গর্ত ও গুহায় লুকিয়ে থাকত। এভাবেই তারা আল্লাহর পরিচয়ের আলো তালাস করতো। একাকীত্ব গ্রহণ করে, দুনিয়ার সম্পর্ক পরিত্যাগ করে, স্ত্রী, পুত্র পরিবার-পরিজনদের সাহচর্য ত্যাগ করে, আল্লাহর মহব্বতের মিথ্যা দাবী করতো। কিন্তু নবুওতে মুহাম্মদী (সা:) এগুলোর মুখোশ উন্মোচন করে দেয় এবং পরিষ্কারভাবে ঘোষণা করেন এসকল কাজকর্ম একটিও ইবাদত নয়।
সুপেয় ও সুস্বাদু আহার্যবস্তুু পরিত্যাগ করলে মূল সত্যের আস্বাদ লাভ করা যায় না। এমনকি আমাদের দুশ্চিন্তা ও দ্বিধাগ্রস্ততা আল্লাহর সন্তুুষ্টি লাভের কারণও হতে পারে না। তাছাড়া বান্দাহদের অমানবিক দু:খ-কুষ্টের ফলে আর। আল্লাহপাক আরাম বোধ করেন না। ছেলে-মেয়ে, জায়া-জননীর প্রতি বিরূপ মনোবৃত্তি পোষণ করলে আল্রাহর ভালবাসা কাহারো নসীব হয় না। মূলত: আল্লাহর মনোনীত ধর্ম বান্দাহর শক্তির বতির্ভূত কোন কিছু তার উপর আরোপ করে না। আল-কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, “আল্লাহ পাক কাহারো উপর শক্তির বহির্ভূত বোঝা চাপিয়ে দেন না।” (সূরা বাক্বারাহ ” শেষাংশ)
ইসলামের সিয়াম সাধনা এমন একটি ইবাদত যাকে অস্বভাবী কষ্টের প্রতিরূপ কল্পনা করা যেতে পারে। কিন্তুু ইসলাম এক্ষেত্রে অসংখ্য আসানীর ব্যবস্থা রেখেছে। আল-কুরআনে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে-“আল্লাহ পাক তোমাদের আসানী কামনা করেন, তিনি তোমাদের প্রতি কাঠিন্য আরোপের প্রত্যাশা করেন না।” (সূরা বাক্কারাহ: ২৩) অনেকের ক্ষেত্রে হজ্জ আদায় ও কষ্টকর ব্যাপার ছিল। কিন্তু আল্লাহ পাক একে সহজ করে দিয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, “যার পথ চলা ও রাহা খরচের সামর্থ্য আছে, তার উপরই হজ্জ ফরজ।” (সূরা আলে ইমরান : ১০)
অতএব এক আয়াতে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন-“আল্লাহপাক তোমাদের ধর্মীয় জীবনে কোনরকম অসুবিধার অবকাশ রাখেননি।” (সূরা হজ্জ : ১০)
এ সম্পর্কে রাসূলে পাক (সা:) বলেছেন, “এই দ্বীন সহজ ও আসান। যে ব্যক্তি স্বীয় শক্তি ও সামর্থ্যরে দ্বারা এই দ্বীনের মোকাবেলা করবে, তাহলে অবশ্যই সে এর কাছে পরাভূত হবে।” (সহীহ বুখারী, সুনানে নাসাঈ এবং জামউল কাওয়ায়েদ ১ম খন্ড- ২০ পৃ:)
অপর এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন- “আমাকে সহজ, সরল, আসান এবং সমুজ্জ্বল হানিফী দ্বীনসহ প্রেরণ করা হয়েছে।” (মাসসাদে; ইবনে হাম্বল, ৫ম খন্ড ২৬৬ পৃ:)
জীবন-ধর্মে বৈরাগ্য রূহবানিয়াত ও যোগ সাধনার প্রবর্তন যত সৎ উদ্দেশ্যেই করা হোক না কেন তবুও সত্যিকার দ্বীনের শিক্ষা এটা নয়। আর তা দ্বীনের সার্থে সামঞ্জস্য রক্ষা করতে একান্তই অপারগ। ইসলাম একারণেই এসকল কার্যক্রমকে বেদআত হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আল-কুরাআনে ইরশাদ হচ্ছে, “খৃস্টানরা রুহবানিয়াত নামক একটি বেদআত প্রথার উদ্ভব ঘটায়, কিন্তু আমি তাদেরকে আল্লাহর সন্তুুষ্টি লাভের প্রত্যাশা ছাড়া একাজের নির্দেশ দেইনি। কিন্তুু তারা বৈরাগ্য বা রুহবানিয়াতের মর্যাদাও রক্ষা করেনি।” (সূরা হাদীদ : ৪)
প্রকৃতপক্ষে ঐ সকল লোক যারা উত্তম আহার এবং বৈধ সৌন্দর্যমন্ডিত পোশাক নিজেদের উপর হারাম সাব্যস্ত করেছিল, তাদের প্রতি আল্লাহ পাক সন্তুুষ্টি হবেন এমন ধারণা নিতান্তই ভুল। স্বয়ং আল্লাহ পাকই তাদেরকে জিজ্ঞেস করছেন, “বলে দিন, আল্লাহর দেয়া বান্দাদের জন্য পবিত্র রিজিক ও আল্লাহর পছন্দনীয় সুন্দর পোশাক-পরিচ্ছদ কে হারাম সাব্যস্ত করেছে?” (সূরা আ’রাফ : ৪)
ইসলাম এই ব্যাপারে এমন দৃঢ়তা ব্যক্ত করেছে যে, একবার রাসূলে পাক (সা:) কোন এক স্ত্রীর মনে সান্ত¦না দানের লক্ষ্যে মধু না খাওয়ার শপথ করেছিলেন। আল্লাহপাক তাঁর প্রিয় হাবীবকে তা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলেন- “হে প্রিয় নবী! আল্লাহপাক আপনার জন্য যা হালাল করেছেন, তা স্বীয় স্ত্রীদের মন:তুষ্টির জন্য কেন হারাম করেছেন? আল্লাহ পাক ক্ষমাশীল মেহেরবান।” (সূরা তাহরীম : ১)
সাহাবীদের মাঝে কোন কোন ব্যক্তিত্ব খৃস্টান পাদ্রীদের প্রভাব কিংবা নিজেদের আন্তরিক প্রশান্তির জন্য একাকীত্ব বরণ ও উপাদেয় পানাহার বর্জন ও কঠিন রিয়াজত মোজাহাদার ভিতর দিয়ে জীবন অতিবাহিত করার অভিলাষ করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা:) তাদেরকে একাজ হতে প্রতিনিবৃত্ত করে বললেন-“আমি এহেন শরীয়ত নিয়ে আগমন করিনি।”
কুদামা বিন মাজউন ও তাঁর একবন্ধু একবার দরবারে নববীতে হাজির হয়ে আরজ করল, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাদের মাঝে একজন চিরকুমার থাকা ও বিয়ে-শাদী না করার সংকল্প করেছেন। অপর একজন জীবনভর গোশত না খাওয়ার ইচ্ছা করেছে।” একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা:) ইরশাদ করলেন,-“আমি ত উভয়টিই পালন করে যাচ্ছি। গোশত ভক্ষণ করছি এবং বিবাহিত জীবনও যাপন করছি। এই উত্তর শ্রবণ করে প্রশ্নকারী দু’জনই নিজেদের সংকল্প পরিহার করলো।” (সহীহ বুখারী : কিতাবুস সওম) হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা:) একজন যাহেদ এবং আবেদ সাহাবী ছিলেন। তিনি একবার এই শপথ করলেন যে, দিনে রোজা রাখবেন এবং রাতভর ইবাদত-বন্দেগী করবেন। রাসূলুল্লাহ (সা:) তা জানতে পেরে তাঁকে লক্ষ্য করে বললেন, “হে আবদুল্লাহ! তোমার উপর তোমার দেহেরও হক আছে, তোমার চোখেরও হক আছে, এমনকি তোমার স্ত্রীরও হক আছে। মাসে তিন দিন রোজা রাখাই যথেষ্ট।” (আবু দাউদ : কিতাবুস সালাত)
হযরত ওসমান বিন মাজউন (রা:)ছিলেন একজন বিশুদ্ধ চিত্তের অধিকারী সাহাবী। তিনি দিনে এবং রাতে ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকতেন। স্ত্রীর সাথে কোন সম্পর্কই রাখতেন না। দিনে রোজা পালন করতেন এবং রাতভর ইবাদত বন্দেগীতে অতিবাহিত করতেন। রাতে কখনো নিদ্রা যেতেন না। একদিন রাসূলে পাক (সা:) তাকে ডেকে বললেন- “হে ওসমান। কেন তুমি আমার তরীকা হতে দূরে সরে “গেছ? উত্তর করলেন, আল্লাহর শপথ! আমি দূরে সরে যাইনি, আমি আপনার তরীকাকেই তালাশ করছি।”
রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন, “আমি নিদ্রাও যাই, নামাজও আদায় করি এবং মহিলাদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই। হে ওসমান! আল্লাহকে ভয় কর। তোমার পরিবার-পরিজনদের, মেহমানদের, তোমার জানেরও তোমার উপর হক আছে। সুতরাং তুমি রোজা ও রাখ, ইফতারও কর, নামাজও পাঠ কর এবং নিদ্রাও যাও।” (আবু দাউদ: কিতাবুস সালাত)
বাহেলা গোত্রের একজন সাহাবী ইসলাম গ্রহণ করে স্বীয় গোত্রে প্রত্যাবর্তন করলেন। তারপর তিনি আহার করা ছেড়ে দিলেন এবং একটানা রোজা রাখা শুরু করলেন। এক বছর পর তিনি যখন রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর খেদমতে হাজির হলেন, তখন তার চেহারা এমন পরিবর্তিত রূপ ধারণ করেছিলো যে, রাসূলে পাক (সা:) তাঁকে চিনতে পারলেন না। তখন তিনি নিজের নাম বললে রাসূলুল্লাহ (সা:) বলরেন, তুমিত সুঠাম দেহের অধিকারী ছিলে? তোমার চেহারা এমন হয়ে গেল কেন? তিনি আরজ করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনার সাথে সাক্ষাৎ করে প্রত্যাবর্তনের পর আমি একটানা রোজা রেখে চলেছি। রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন, তুমি নিজের প্রাণকে কেন আজাবে নিপতিত করছ। রমজান মাস ছাড়া প্রতিমাসে একটা রোজাই যথেষ্ট। তিনি এরচেয়ে বেশী রোজা পালন করার অবিলাষ ব্যক্ত করলেন। রাসূলুল্লাহ (সা:) তাঁকে মাসে দু’দিন রোজা রাখার অনুমতি দিলেন। তিনি এরচেয়েও বেশীদিন রোজা রাখার আবেদন করলেন। রাসূলুল্লাহ (সা:) তাঁকে তিনদিন রোজা রাখার অনুমতি দিলেন। তিনি এরচেয়ে বেশীদিনের আরজী পেশ করলেন। রাসূলুল্লাহ (সা:) তাঁকে মর্যাদাপূর্ণ মাসে (মহররম, রজব, জ্বিলকদ, জিলহজ্জ) রোজা রাখার অনুমতি দিলেন। (আবু দাউদ) (চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।