দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
সাক্ষ্য না সংবাদ ? ইবাদত-বন্দেগী, ব্যক্তিগতভাবে কোন আমল করা বা ব্যক্তির নিজের বেলায় কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষেত্রে এবং তেমন আমল-ইবাদত বা সিদ্ধান্ত অন্যরাও গ্রহণ করুক- এমনটি চাইলে, সেক্ষেত্রে শরীয়তের বিধি-বিধানে পার্থক্য হয়ে থাকে। যেমন কোন একজনে একা রমযানের চাঁদ দেখতে পেলেন, আর কেউ দেখেননি।( আদদুররুল মুখতার: খ-৩, আলাউদ্দীন হাসকাফী, পৃ-৩৫০, যাকারিয়া বুক ডিপো, ইউ.পি.ভারত, সংস্করণ-১৯৯৬খ্রি.)
সেক্ষেত্রে এই একজনের চাঁদ দেখার সংবাদ/সাক্ষ্য যদি বিধি মোতাবেক সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে গৃহীত না হয়; তা হলে সেক্ষেত্রে দেশের অন্য কারও জন্য রোযা শুরু করা আইনত জরুরী হবে না। তবে তিনি যেহেতু নিশ্চিত দেখেছেন, তাই নিজে অবশ্যই রোযা পালন করবেন। অর্থাৎ নিজের বেলায় আমল বা সিদ্ধান্ত এক ব্যাপার, আর অন্যের বেলায়,পুরো সমাজের বা দেশের সকলের বেলায় তা প্রয়োগ বা প্রযোজ্য হওয়া বা করা ভিন্ন ব্যাপার। সুতরাং এই একজন বা দু’জন যদি একত্রে বা পৃথক পৃথকভাবে চাঁদ দেখেন এবং তা সংবাদ হিসাবে টেলিফোন ইত্যাদির মাধ্যমে অন্যের কাছে পৌঁছান বা পৌঁছে তা আইনত অন্যের জন্য বা দেশের সবার জন্য প্রযোজ্য হয় না। সুতরাং বোঝা গেল অন্যের বেলায় প্রযোজ্য করতে গেলে এবং ১৬ কোটি মুসলিম জনগণের প্রয়োজনে ঘোষণা দিতে হলে, তা অবশ্যই সাক্ষ্য আকারে উপস্থাপিত হতে হবে আর তারই ভিত্তিতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের গৃহীত সিদ্ধান্ত থাকতে হবে। যে কারণে সাক্ষ্য থাকা জরুরী, কেবল সত্য সংবাদ যথেষ্ট নয়। তবে হ্যাঁ, তার বা তাদের এই চাঁদ দেখার সংবাদটি যদি সাক্ষ্য আকারে পৌঁছে থাকে এবং সেই সাক্ষ্যের ভিত্তিতে যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়; তা হলে সেক্ষেত্রে তা অন্যের বেলায় এবং দেশের সকলের ক্ষেত্রে সামষ্টিকভাবে অবশ্য পালনীয় হিসাবে প্রযোজ্য হবে।
‘সত্য সংবাদ’ ও ‘সাক্ষ্য’তে পার্থক্য: কোন বিষয় বা ব্যাপারে একজন বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি মৌখিকভাবে সংবাদ দিলে অথবা টেলিফোন এর মাধ্যমে বললে এবং তার কথা শুনে তাকে চিনতে পারলে; কিংবা পত্রের মাধ্যমে লিখলে আর ওই লেখা পাঠে তাকে সনাক্ত করতে পারলে -সেক্ষেত্রে শ্রোতার আর সেই সংবাদ সত্য হওয়া প্রশ্নে সন্দেহ থাকে না। তাঁর নিজের ক্ষেত্রে পূর্ণ প্রত্যয়ও হয়ে যায় এবং সেই মোতাবেক আমল করা তার নিজের বেলায় জায়েযও হয়ে থাকে। আর সাধারণ লেনদেন/ বিষয়-ব্যাপার প্রশ্নে সারা দুনিয়ার কার্যক্রম এ ভাবেই চলছে। কিন্তু চাঁদের বেলায় কেউ তাঁর এমন বিশ্বাস-প্রত্যয়কে অন্যদের বেলায় প্রয়োগ করতে গেলে এবং এমনটি চাইলে যে, আমার বা আমাদের উক্ত জানা সংবাদ যেন সকলে, সারা দেশের মানুষ মেনে নেয় এবং সে মোতাবেক যেন সকলে (কাজটি) পদক্ষেপ নেয়। তা হলে সেক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়ত ও প্রচলিত আইন মোতাবেক ‘নিয়ম’ হচ্ছে তাতে যেন অবশ্যই ‘সাক্ষ্য আইন’ বা ‘সাক্ষ্য নীতি’ প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং সেটি অনুসৃত হয়। অন্যথায় কোন শাসক বা বিচারক বা কমিটি শুধু নিজ জানা ও নিজ প্রত্যয় মোতাবেক অন্যের ওপর কোন কিছু চাপিয়ে দিতে বা অন্যের বেলায় কোন কিছু বাধ্যতামূলক করতে পারেন না।
চাঁদ দেখা প্রশ্নে শরীয়তের ‘সাক্ষ্য নীতি’ যা সম্পর্কে প্রায় পুরো মুসলিম উম্মাহর চার মাযহাবই -হানাফী, শাফেঈ, মালেকী ও হাম্বলী -এবং পূর্বাপর সকল আলেমগণই ঐকমত্য পোষণ করেন, তা নিন্মে উল্লেখ করা হচ্ছে। আলোচ্য এই ‘শরীয়তনির্দেশিত সাক্ষ্য নীতি’র বিবরণের পূর্বে একটা বিষয় স্পষ্ট হওয়া জরুরী, যা ‘সাক্ষ্য’ এর মূল ভিত্তি হয়ে থাকে।
সাক্ষীর উপস্থিতি : একজন বিচারকের ব্যক্তিগতভাবে কোন মামলার একটি বিষয় সম্পর্কে যতই নিশ্চিতভাবে জানা থাকুক এমনকি কোন ব্যাপারে তিনি স্বয়ং প্রত্যক্ষদর্শী ই হোন না কেন, সে নিরীখে বা সেই বিবেচনায় তিনি মামলার রায়/ ফায়সালা দিতে পারবেন না; যে পর্যন্ত না তা নিয়মতান্ত্রিকভাবে ‘সাক্ষ্য আইন’ এর শর্ত মতে, বিধি মোতাবেক প্রমাণিত না হবে। আবার এই সাক্ষ্য প্রশ্নে আদালতে কারও বা কোন পক্ষের টেলিফোননির্ভর বয়ান-বর্ণনাও যথেষ্ট বলে গণ্য হয় না; বরং খোদ সাক্ষীকে আদালতে উপস্থিত হওয়া জরুরী। দুনিয়ার আদালতসমূহের বর্তমান প্রচলিত ‘সাক্ষ্য আইন’ বা নিয়ম পুরোপুরি কুরআন-সুন্নাহ্ ও ইসলামী আইন মোতাবেক চালু আছে। অর্থাৎ সাক্ষীদের বিচারক বা শাসকের তথা আদালতের সামনে উপস্থিত হওয়া অবশ্যই জরুরী; ফোনের মাধ্যমে বা কারও কোন সংবাদের মাধ্যমে -তা যতই নির্ভরযোগ্য সূত্রে হোক- ‘সাক্ষ্য’ হিসাবে যথেষ্ট হবে না।
চাঁদ দেখা’র বা তার ঘোষণা’র কেন্দ্রিয় কমিটি’র সাম্প্রতিক বা ইতোপূর্বেকার ঘটনাপ্রবাহের ক্ষেত্রে, কেবল কমিটির ফায়সালায় ব্যাপকহারে আলেমগণের আস্থা না আসা কিংবা সংশয়হীনভাবে গ্রহণযোগ্য বা আমলযোগ্য না হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে,‘ ঈদ’ এর চাঁদ প্রশ্নে পুরো উম্মতের সর্বসম্মত ফায়সালা হল, তা অবশ্যই সাক্ষ্য প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্থিরীকৃত হওয়া এবং সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়া শর্ত; কেবল সত্য সংবাদ যথেষ্ট নয়। অথচ কেন্দ্রিয় কমিটি শুধু টেলিফোনের মাধ্যমে প্রাপ্ত সংবাদের ওপর আস্থা রেখেই তার ভিত্তিতে চাঁদ দেখার ঘোষণা প্রদান করে থাকেন (মর্মে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে শোনা যায়)। এমন প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয় না যে, সাক্ষী যেন স্থানীয় কমিটি বা কেন্দ্রিয় কমিটির সামনে উপস্থিত হয়ে সাক্ষ্য প্রদান করে; অথবা কমিটির কোন নির্ভরযোগ্য আলেম সদস্য সেই সাক্ষীর কাছে উপস্থিত হয়ে তার কাছ থেকে সামনা-সামনি অবস্থানে সাক্ষ্য গ্রহণ করেন এবং সেই সাক্ষ্যের ভিত্তিতে চাঁদ দেখার ফায়সালা প্রদান করে থাকেন। এমনটি যদি হত সেক্ষেত্রে আর কারও দ্বিমত বা বিরোধ করার কিছুই থাকতো না।
‘সাক্ষ্য নিয়ম’ বা ‘সাক্ষ্য বিধি’র এসব সূ² বিষয়াদি বর্তমান কালের সব আদালতেরও জানা আছে এবং সংশ্লিষ্ট সকলেই এসব মেনে চলেন। তবে সাধারণ মানুষ এসব সূ² পার্থক্য সহজে বুঝতে পারে না বিধায় তারা ভালো-মন্দ নানান আলোচনা-সমালোচনায় জড়িয়ে পড়ে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।