Inqilab Logo

শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

এক আল্লাহর ইবাদত

এ. কে . এম ফজলুর রহমান মুন্শী | প্রকাশের সময় : ৩ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০২ এএম

ধর্মীয় পরিপূর্ণতা ও সংস্কারের ক্ষেত্রে নবুওতে মুহাম্মদী (সা:)-এর প্রাথমিক বড় কাজ ছিল দুনিয়ার ইবাদতখানাগুলো হতে বাতেল উপাস্যদের বাইরে নিক্ষেপ করা এবং এসকল বাতেল উপাস্যের পূজা-অর্চনা চিরতরে মিটিয়ে দেয়া এবং কেবলমাত্র এক আল্লাহর সামনে সকল সৃষ্ট পদার্থের মস্তক অবনত করা। এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট ঘোষণা জারী করা হয়েছে, “আকাশ ও যমীনের সকল মাখলুক সেই মেহেরবান আল্লাহর সামনে গোলাম হয়েই আসবে। (সূরা মরিয়াম) আল্লাহছাড়া না আসমানে এবং না যমীনে এমন কি না আসমানের উপরে এবং না যমীনের নীচে এমন কোন বস্তুু বা পদার্থ আছে, যে মানুষের সেজদা, রুকু ও কেয়ামের হকদার হতে পারে। এবং না তার নাম ছাড়া অন্য কাহারো নামে কোনোও প্রাণীর প্রাণ উৎসর্গ করা যেতে পারে কিংবা বাতেল উপাস্যের জন্য ইবাদত গৃহ নির্মাণ করা যেতে পারে, না এরজন্য নজর মানা যেতে পারে, না তার কাছে দোয়া প্রার্থনা করা যেতে পারে; স্বয়ং সকল ইবাদত কেবলমাত্র আল্লাহরই জন্য এবং সকল আরাধনা কেবল তারই নিমিত্ত হতে হবে।
এজন্যই আল কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, “অবশ্যই আমার সালাত এবং আমার কোরবানী এবং আমার জীবন ও আমার মৃত্যু সবকিছুই এক আল্লাহর জন্যই নিবেদিত, যিনি সমগ্র বিশে^র প্রতিপালক। (সূরা আনয়াম)
একই সাথে অবিশ্বাসীদেরকে মূর্তি, দেবতা, নক্ষত্রসমূহ ও অন্যান্য সৃষ্ট পদার্থের ইবাদত করা থেকে প্রতিনিবৃত্ত করা হয়েছে এবং তাদেরকে সামগ্রিকভাবে বুঝানো হয়েছে যে, সত্যিকারভাবে আল্লাহ ছাড়া অন্য কাহারো ইবাদত হতে পারে না। কিন্তু যখন তাদের উপর এসকল উপদেশ ও বুঝানোর কোন প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব দেখা গেল না তখন ইসলামের নবীর উপর সার্বিক সম্পর্কহীনতার এই ঘোষণা জারি করার নির্দেশ হলো, “বলুন হে কাফের সম্প্রদায়! তোমরা যার অর্চনা কর, আমি তার উপাসনা করি না। আর আমি যার ইবাদত করি, তোমরা তার ইবাদত কর না। আর আমিও তার ইবাদত করব না, যার ইবাদত তোমরা কর। আর তোমরাও তাঁর ইবাদত করবে না, যার ইবাদত আমি করি। তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম এবং আমার জন্য আমার ধর্ম। (সূরা কাফিরূন)

বাহ্যিক রেওয়াজের অপ্রয়োজনীয়তা :
আল্লাহর ইবাদত এবং বন্দেগীর সময় দেহ ও প্রাণের বাইরের কোনও জিনিসের প্রয়োজন নেই। না সূর্য উদয় ও এর প্রতি তাকানোর প্রয়োজন আছে। না দেবতা, দেবী, বুযুর্গ এবং অলীদের চিত্রগুলোকে সামনে রাখার দরকার আছে। না দরিয়ার গমন করে পানি ছিটানোর প্রয়োজন আছে। না সামনে অগ্নিকুন্ড জ্বালানোর দরকার আছে। না সামনে মোমবাতি জ্বালানোর হুকুম আছে। না ঘণ্টা ও সিঙ্গা ফুঁকার প্রয়োজন আছে। না লোবান ও বিভিন্ন প্রকার সুগন্ধি দ্রব্য জ্বালানোর প্রয়োজন আছে। না স্বর্ণ এবং রৌপ্যের সুনির্দিষ্ট বরতন রাখার দরকার আছে। না নির্দিষ্ট প্রকার কাপড়ের প্রয়োজন আছে, বরং এসকল বাহ্যিক রেওয়াজ ও শর্তাবলী থেকে ইসলামী ইবাদত সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র। এরজন্য শুধু কেবল একপ্রন্থ পবিত্র দেহাবরণ এবং পবিত্র মনের প্রয়োজন। কিন্তু যদি দেহ ও লেবাসের পবিত্রতা অর্জনে কখনো অক্ষম হয়ে যায়, তাহলে অপারগতার ক্ষেত্রে তাও মাফ করা হয়েছে।
ইসলামে ইবাদতের জন্য আল্লাহ এবং বান্দাহর মাঝে কোন নির্দিষ্ট বংশ, কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তিত্বের সাহায্য ও সংশ্লিষ্টতা এবং মধ্যস্থতার প্রয়োজনীয়তা নেই। মোহাম্মদ (সা:) প্রবর্তিত ধর্মে না হিন্দুদের মতো ব্রাহ্মণ আছে, না পুরোহিদ আছে না পূজারী আছে। না ইহুদিদের মতো গল্পকার আছে, না পাদ্রী আছে, না সংসার বিবর্জিত আছে ব্যক্তিত্ব আছে। না হযরত হারুন (আ:) এর বংশোদ্ভুত হওয়ার শর্ত আছে। না খৃস্টানদের মত ইবাদত আদায় করার লক্ষ্যে পাদ্রী ও বিভিন্ন ধর্মীয় পদাধিকারীর স্থান আছে, না পাসীয়ানদের মত দস্তুুর ও নিয়মনীতি এবং উপাসনা পদ্ধতির প্রয়োজন আছে। মোটকথা, ইসলামের ক্ষেত্রে প্রত্যেক বান্দহ তার পরওয়ারদিগারের প্রতি স্বয়ং নিজেই আরজি পেশ করে এবং মনের কথা নিজেই বলে, এমনকি নিজেই প্রার্থনার বস্তু উপস্থাপিত করে। এ কারণে প্রত্যেক মুসলমান নিজে নিজেই ধর্মগুরু, নিজে নিজেই গল্পকার, নিজে নিজেই ধর্মীয় নেতা, আইন প্রয়োগকারী এবং কর্তব্য সম্পাদনকারী। ইসলামের বিধান হচ্ছে এই যে, “তোমরা আমাকে আহ্বান কর, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব। আল কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে- “উদউনী আসতাজ্জিব লাকুম” অর্থাৎ “তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের প্রার্থনা কবুল করব।” (সূরা মু’মিন)

বাইরের আকর্ষণ ভিত্তিহীন :
অধিকাংশ মাযহাব নিজেদের ইবাদত বন্দেগীকে আকর্ষণীয় ও প্রভাবশালী এবং চিত্তাকর্ষক করার জন্য বাইরের আকর্ষণ ধার করে থাকে। এজন্য কোথায়ও সিঙ্গার কুৎকার, কোথাও নৃত্যগীত, কোথাও বাদ্যযন্ত্রের ঝংকার, কোথাও শঙ্খ ও ঘণ্টাধ্বনি, আবার কোথাও হৈ-হুল্লোড়, সোরগোলের সমারোহ দেখা যায়। কিন্তু দ্বীনে মুহাম্মদীর সহজ, সরল ও পবিত্রতার মাঝে এগুলোর কোনও অবকাশ নেই। বরং মানুষের অন্ত:করুণকে আকর্ষণীয় করার জন্য মনের নিবিষ্টতা রূহের সক্রিয় গুঞ্জরণ ছাড়া অন্য কোন বাইরের আকর্ষণ ও চিন্তা-ভাবনার সুযোগ ইসলামে নেই। যাতে করে আল্লাহ ও বান্দাহর মাঝে ভাবের আদান-প্রদান সঠিক শুদ্ধভাবে বাইরের ছোঁয়াচহীন পূর্ণ আন্তরিকতা ও বিশ^স্ততার সাথে পরিসাধিত হতে পারে এবং পবিত্র ও নির্মল পরিবেশ গড়ে উঠতে পারে।

স্থান বিশেষের কড়াকড়ি :
একমাত্র ইসলাম ছাড়া অন্যান্য মাযহাবগুলো ইট এবং চুনা পাথরের চার দেয়ালে বন্দী হয়ে আছে। সেখানে পূজামন্ডপ ছাড়া পূজা হয় না, আগুনশালার বাইরে প্রণিপাত হয় না, গীর্জা ছাড়া প্রার্থনা হয় না, মূর্তি ছাড়া অর্চনা চলে না। কিন্তু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা:)- এর প্রবর্তিত ধর্ম ব্যবস্থায় না কোন দেয়ালের প্রয়োজন আছে, না মেহরাব ও মিম্বরের আবশ্যকতা আছে। এই দ্বীন মনোজ্ঞ প্রাসাদ, মন্ডপ, বেদী, গীর্জা ও হর্ম্য হতে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র। এই যমীনের প্রতিটি অংশেই ইসলামী ইবাদত প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, সবখানেই ইবাদত করার সুযোগ আছে। এমন কি দুনিয়া জোড়াই মুসলমানদের ইবাদতখানা সুবিস্তৃত। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা:)-ইরশাদ করেছেন, “আমাকে আল্লাহপাক এমন কিছু’ বৈশিষ্ট এনায়েত করেছেন যে, যা আমার পূর্বে অন্য কোনও পয়গাম্বরকে দেয়া হয়নি। এর মাঝে একটি হচ্ছে এই যে, আমার জন্য সারা ভু-মন্ডলকে সিজদার স্থল করে দেয়া হয়েছে। (বুখারী : কিতাবুস সালাত) সুতরাং তুমি আরোহী হও, চাই পদব্রজে চল, শান্তিময় ফুল বাগানেই থাক, কিংবা হাঙ্গামামুখর কর্মক্ষেত্রে, স্থলভাগে হও অথবা পানিরাশিতে, যমীনেই থাক, চাই আকাশে জাহাজেই থাক, চাই রেলযানে। সবখানেই তুমি আল্লাহর ইবাদত করতে পার। সর্বত্রই তুমি বিনয়াবনত সেজদা আদায় করতে পার। এমনকি তুমি যদি ভিন্ন ধর্মের এমন ইবাদতখানায়ও পৌঁছে যাও, যেখানে মূর্তি ‘বিগ্রহ সাজানো রয়েছে, তা যদি তোমার সামনে না থাকে, তাহলে সেখানেও তুমি তোমার উপর অপরিহায্য ইবাদত-আদায় করতে পার। (বুখারী : কিতাবুস সালাত)
বিভিন্ন ধর্মে নির্দিষ্ট ইবাদত পালন করার জন্য বিভিন্ন দিক ও বিভিন্ন বস্তুর প্রতি মুখ করে দাঁড়ানোর আবশ্যকতা লক্ষ্য করা যায়। সুতরাং মুসলমানদেরকে একটিমাত্র দিকে সংঘবদ্ধ করার লক্ষ্যে যেন তারা একত্ববাদের মূল চেতনা নিজেদের মাঝে প্রতিফলিত করতে পারে তজ্জন্য মুসলমানদের কোনও একটি দিককে নির্দিষ্ট করার আবশ্যকতা নেই। এরজন্য শুধুমাত্র মসজিদে ইব্রাহীমকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে। যাতে করে বিভিন্নতার আবিলতা অপসারিত হয় এবং একই কেন্দ্রবিন্দুতে উপনীত হওয়া সহজতর হয়। তাছাড়া মসজিদে ইব্রাহীমী এক আল্লাহর ইবাদতের প্রথম স্থান বা মাকাম। (চলবে)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ