Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সৎ নিয়তে ব্যবসা করা ইবাদত

গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির | প্রকাশের সময় : ৩ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০২ এএম

সংযম ও আত্মশুদ্ধির মাস মাহে রমজান চলছে। এই মাসে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি মূলত রোজা পালনের তাৎপর্যকেই মূল্যবোধহীন করে ফেলে। শুধু ইসলাম কেন, কোনো ধর্ম বা শাস্ত্রে অপচয়- অপব্যয়, অস্বাভাবিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মতো অন্যায় আচরণ এবং তদুদ্দেশ্যে মুনাফাখোরি মজুদদারি জাতীয় কার্যকলাপ সমর্থন করে না। পণ্যদ্রব্যে ভেজাল, মজুদদারি, মুনাফাখোরি এবং অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে জাতি ধর্ম মত নির্বিশেষে সবার অবস্থান স্পষ্ট। এর বিপরীতে দেখা যায় দেশে এখন খাদ্যপণ্যসহ বিভিন্ন পণ্যে ভেজাল একটি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। পবিত্র মাহে রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের চাহিদা বাড়ে। আর এ সুযোগকে কেন্দ্র করে এক শ্রেণির সুযোগসন্ধানী কালোবাজারি,মজুদদার ও মুনাফাখোর ব্যবসায়ী পণ্য মজুদ রেখে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। মানুষের অযাচিত হস্তক্ষেপ থেকে বাজার প্রক্রিয়া রক্ষার জন্য ইসলাম মজুদদারি,মুনাফাখোরি ও প্রতারণা নিষিদ্ধ করেছে। অধিক মুনাফার প্রত্যাশায় পণ্য মজুদ করাকে ইসলাম অবৈধ ঘোষণা করেছে। হানাফি মাজহাব মতে,নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য মজুদ করা মাকরুহ তাহরিমি (হারাম সমতুল্য)। অন্য মাজহাব মতে,এটি হারাম। কেননা এর ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং বহু মানুষ দুর্ভোগে পতিত হয়। সাধারণ ভোক্তাদের জিমি¥ করে বিত্তশালী হয়ে গেলেও কোনো লাভ নেই। এই সম্পদ দুনিয়ার জীবনেই অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে। রাসূলূল্লাহ (সা:) বলেছেন,কেউ যদি গুদামজাত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে,আল্লাহ তাকে দুরারোগ্য ব্যাধি ও দারিদ্র্য দ্বারা শাস্তি দেন।(ইবনে মাজাহ হাদিস:২২৩৮) মজুদদারি না করে সৎ নিয়তে ব্যবসা করা ইবাদত। এমন ব্যক্তির উপার্জন আল্লাহ তায়ালা বরকতময় করে দেন। তাকে অপ্রত্যাশিত রিজিক দেন। নবীজি (সা.) বলেছেন,‘খাঁটি ব্যবসায়ী রিজিকপ্রাপ্ত হয় আর পণ্য মজুদকারী অভিশপ্ত হয়’(ইবনে মাজাহ-২১৫৩)। ধর্মীয় অনুশাসনে নকল, ভেজাল এবং মজুদদারি, মুনাফাখোরিকে চরম ভাবে ধিক্কার দেয়া হলেও এসব দৈত্য পদ¥া, মেঘনা, যমুনা গোমতি পারের এই জাতিকে জিম্মি করে রেখেছে বছরের পর বছর ধরে।’ নকল, ভেজাল এবং মুনাফাখোরি সম্পর্কে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসনের বিষয়টি অনেকেরই অজানা, আবার যাদের জানা তারা না জানার অভিনয় করে। বিষয়গুলো সবার সজ্ঞান মানসিকতায় আনা দরকার। বেশি মুনাফা অর্জনের আকাঙ্খা, অপব্যয়, অপচয়, আত্মসাতের প্রবণতা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সার্বিকভাবে সব পক্ষের মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। পাশাপাশি এ বিষয়ে মসজিদের ইমাম , মন্দির ও গির্জার পুরোহিতরাও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারেন। মসজিদের ইমাম, মন্দির, প্যাগোডা ও গির্জার পুরোহিতরা নকল, ভেজাল ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বিরুদ্ধে বিশ্বাসী মানুষদের সচেতন করে তুললে সবার মানসিকতার উন্নতি হতে পারে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, যারা এসব নিয়ম-কানুন প্রয়োগ ও প্রতিপালন পরিবীক্ষণের দায়িত্বে, তাদেরও যথাদায়িত্ব পালনে সজাগ ও সক্রিয় হওয়া বা থাকাটা যথাযথ অর্থবহ হওয়ার আবশ্যকতা রয়েছে। উদাহরণ স¦রূপ রমজানে ডালের মূল্যবৃদ্ধির কারণ, একটি পত্রিকার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দেখা যায়,রমজানে দেশে ডালের চাহিদা এক লাখ ৩০হাজার টন। বর্তমানে মজুদ আছে চার লাখ টন,যা দিয়ে সারা বছরের চাহিদা পূরণ সম্ভব। তার পরও রমজানের শুরুতেই বেড়েছে সব ডালের দাম।এ জন্য সিন্ডিকেটকেই দায়ী করছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা, আবার পাইকাররা দুষছে ব্যবসায়ী ও আবহাওয়াকে। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে প্রতি কেজি দেশি মসুর পাঁচ টাকা, আমদানি করা মসুর চার, মুগ তিন ও খেসারি ডালের দাম চার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীরা বলছে, কয়েক দিনে বাড়তি চাহিদার পরিপ্রেক্ষিত বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে মিল মালিকরা। ফলে বাজারে কিছুটা সংকট চলছে, যার প্রভাবে বাড়ছে দাম। পাশাপাশি কিছু মিল মালিক বৃষ্টি ও আবহাওয়া খারাপ থাকার অজুহাত দিচ্ছে।আর আমদানিকারকরা বলছে, গত বছর লোকসানের পর এবার আমদানি কম হওয়ায় সরবরাহ কমেছে বাজারে। পরস্পরের দোষারোপের সংস্কৃতিতে একই সঙ্গে খোঁড়া যুক্তির বন্যায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের সব প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিয়ে দ্রব্যমূল্য বেড়েই চলছে। এমনকি ফুটপাতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর ক্ষুদ্র কেনাবেচার ক্ষেত্রে যে চাঁদাবাজি তার পরিমান কয়েক শ কোটি টাকা। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে এসব বিনিয়োগ ছাড়াই অর্থ উপার্জন জাতীয় কর্মকান্ড প্রভাবক ভূমিকা রাখছে। দুনিয়ার সব দেশে উৎসব বা পার্বণ উপলক্ষে সরবরাহের ব্যাপকতায় দ্রব্যমূল্য বরং প্রতিযোগিতামূলক হয়ে যখন সাশ্রয়ী হয়ে ওঠে, বাংলাদেশে ঘটে ঠিক তার উল্টোটা। ঈদ উৎসব উপলক্ষ করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি যেন দেশের ঐতিহ্যের অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি মজুদ করে রেখে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে মুনাফা লাভের প্রবণতা রুখতে হবে। কেননা,মজুদদারি পরিণতি সম্পর্কে রাসূলূল্লা (সা.) বলেছেন,‘যে মজুদদারি করে সে পাপী।’(সহীহ মুসলিম) ব্যবসায় ঁেধাকা ও প্রতারণা থেকে অব্যশ্যই বিরত থাকতে হবে। দ্রব্যের কোনো দোষ-ত্রæটি থাকলে ক্রেতার সম্মুখেতা প্রকাশ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ই লাভবান হবে এবং তাদের ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত হবে। কোনো প্রকার গোপনীয়তার আশ্রয় গ্রহন করা যাবে না।

নবী করিম (সা.) বলেন,‘অধিক কসম খাওয়ার প্রবণতা ব্যবসায় কাটতি বাড়ায়, কিন্তু বরকত দূর করে দেয়।’(সহিহ বোখারি ও মুসলিম) তাই ব্যবসার ক্ষেত্রে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহন করলে ব্যবসায়ী এবং ক্রেতা উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে জন্যই রাসুল (সা.) ব্যবসায়ীদের মিথ্যা পরিহার করার জন্য বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। ব্যবসায় মিথ্যা কসম ইসলামে নিষিদ্ধ হওয়ায় মিথ্যা কসমকারী ব্যবসায়ীদের কঠোর পরিণতি সম্পর্কে হাদিসে সাবধানের বাণী উচ্চারিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘তিন শ্রেণীর লোকের সাথে আল্লাহ কিয়ামতের দিন কথা বলবেন না ও তাদের প্রতি দৃষ্টি দেবেন না এবং তাদেরকে পবিত্রও করবেন না। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। হযরত আবু যার রা:বললেন, হে আল্লাহর রাসূল সা:! কারা নিরাশ ও ক্ষতিগ্রস্ত ? তিনি সা: বললেন, টাখনুর নিচে কাপড় পরিধানকারী, উপকার করে খোটা প্রদানকারী এবং ঔই ব্যবসায়ী যে মিথ্যা শপথ করে তার পণ্য বিক্রি করে’(সহিহ মুসলিম ও মিশকাত)। মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি মজুদ করে রেখে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে মুনাফা লাভের প্রবণতা থেকেও বেঁচে থাকতে হবে। কেননা,মজুদদারি পরিণতি সম্পর্কে রাসূলূল্লা (সা.) বলেছেন,‘যে মজুদদারি করে সে পাপী।’(সহীহ মুসলিম) ব্যবসায় ঁেধাকা ও প্রতারণা থেকে অব্যশ্যই বিরত থাকতে হবে। দ্রব্যের কোনো দোষ-ত্রæটি থাকলে ক্রেতার সম্মুখেতা প্রকাশ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ই লাভবান হবে এবং তাদের ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত হবে। কোনো প্রকার গোপনীয়তার আশ্রয় গ্রহন করা যাবে না। রাসূলূল্লাহ (সা.) পণ্যে ভেজাল দিয়ে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে দ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে দিতে নিষেধ করার পাশাপাশি এর পরিণতিও উল্লেখ করেছেন। বিশিষ্ট সাহাবি হযরত আবু হুরায়রা রা: হতে বর্ণিত, ‘একদা নবি করিম সা: কোনো এক খাদ্যস্তূপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি খাদ্যস্তূপে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে দেখলেন তাঁর হাত ভিজে গেছে। তিনি সা: বললেন, হে খাদ্যের মালিক ! ব্যাপার কি ? উত্তরে খাদ্যের মালিক বললেন, হে আল্লাহর রাসূল সা:! বৃষ্টিতে তা ভিজে গেছে। রাসূলুল্লাহ সা: তাকে বললেন, তাহলে ভেজা অংশটা শস্যের উপরে রাখলে না কেন? যাতে ক্রেতারা তা দেখে ক্রয় করতে পারে। নিশ্চয়ই যে প্রতারণা করে সে আমার উম্মত নয়।’ (সহিহ মুসলিম ও মিশকাত) সর্বোপরি বলা যায়, আমরা মুসলিম হিসেবে ইবাদত-বন্দেগি যেমন ইসলামী অনুশাসন মেনে করি, তেমনি ব্যবসায়ও ইসলামী অনুশাসন মেনে করব।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ