Inqilab Logo

রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বাজেট বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে

প্রকাশের সময় : ১৫ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এবিসিদ্দিক

বাজেট ঘোষণার পরপরই অর্থনীতিবিদ, সরকার, বিরোধী রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন মহল থেকে কথা উঠেছে, ‘প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়ন কঠিন হবে’। আসলে কি তাই? টাকা বা অর্থ খরচ করা খুবই সহজ, রোজগার করা কঠিন। আর এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। বাজেট বাস্তবায়ন কঠিন হয় না কোনো সরকারের আমলেই। ধুমধাম টাকা খরচ হয়। জনগণের টাকা খরচ করতে অসুবিধা কোথায়? বাজেটের অর্থের জোগান দেয় দেশের জনগণ। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের মাধ্যমে আসে টাকা। বাস্তবতা হলো এদেশের কুলি মজুর, রিকশাচালক থেকে শুরু করে সবাই ট্যাক্স দেয়। কথা আরও পরিষ্কার করে বলা দরকার। কোন পণ্য কিনতে গেলে দিতে হয় ভ্যাট, আর এটা সর্বস্তরের ভোক্তা সাধারণ দিয়ে থাকে। যাক সে কথা। বাজেটের অর্থ দুটি খাতে খরচ হয় (১) অনুন্নয়ন খাতে (২) উন্নয়ন খাতে। উন্নয়ন খাত বলতে সাধারণত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বলে থাকি। আর এডিপির চিত্রটাও ভিন্ন। যেমনÑ
চলতি অর্থবছরের দশ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন হয়েছে ৫০ শতাংশ। দুই মাসে কি ৫০ শতাংশ বাস্তবায়ন সম্ভব? পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, গত পাঁচ বছরের মধ্যে নি¤œ পর্যায়ে রয়েছে এডিপি বাস্তবায়ন। দশ মাসে মোট ব্যয় হয়েছে ৪৭ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে জিওবির অর্থ (সরকারের নিজস্ব অর্থ) ব্যয় হয়েছে ২৯ হাজার ৯৮১ কোটি টাকা (৪৮ শতাংশ), প্রকল্প সাহায্যের অর্থ ব্যয় হয়েছে ১৫ হাজার ১৮২ কোটি (৫২ শতাংশ) আর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগের খরচ হয়েছে ১ হাজার ৯৫২ কোটি টাকা (৬৭ শতাংশ)।  চলতি অর্থবছরের মূল এডিপির আকার ছিল ৯৭ হাজার কোটি টাকা যা পরে কাটছাঁট করে ৯৩ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। দশ মাসে কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বাস্তবায়নের হার হচ্ছেÑ স্থানীয় সরকার বিভাগ ৬২, বিদ্যুৎ বিভাগ ৬০, সেতু বিভাগ ৪১, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ৫৫, সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ ৫২,স্বাস্থ্য ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ৩৮, রেলপথ মন্ত্রণালয় ৪৩, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ৪৮, গৃহায়ন ও পূর্ত মন্ত্রণালয় ৪১, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ৪৩, জ¦ালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ ৫৯, কৃষি মন্ত্রণালয় ৫৮, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ৩৪, ডাক ও টেলিযোগযোগ মন্ত্রণালয় ৬৭, স্বরাষ্ট্র ৬০, শিল্প মন্ত্রণালয় ১৮ শতাংশ, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ ৬৯ শতাংশ বাস্তবায়ন করতে পেরেছে। এ ছাড়া অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো ৫৫ শতাংশ বা তার নিচেই সীমিত  রয়েছে। এডিপিতে দুর্নীতি ভরপুর। যার ফলে এখন আর দাতা সংস্থাগুলো উন্নয়ন কাজে টাকা দিতে চায় না।
অনুন্নয়ন খাতের শেষ নেই। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, গাড়ি, বাড়ি, গাড়ির তেল খরচ, যাতায়াত ভাতা, অবসর ভাতা আরো কত কিছু। যেমনÑ নতুন জাতীয় বাজেটে অনুন্নয়ন খাতে রাজস্ব ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৭ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে অফিসারদের বেতন ৬ হাজার ৯১০ কোটি, কর্মচারীদের বেতন ২২ হাজার ৯১ কোটি, ভাতাদি ২৩ হাজার ৮৬৯ কোটি, সরবরাহ ও সেবা ২৭ হাজার ১৩৯ কোটি, মেরামত ও সংরক্ষণ ৬ হাজার ৭০০ কোটি, মেয়াদি ঋণের সুদ ১৫ হাজার ২৮৯ কোটি, চলতি ঋণের সুদ পরিশোধ ২ হাজার ৬১২ কোটি, জাতীয় সঞ্চয় পত্রের সুদ ১৬ হাজার ৭৩৬ কোটি, ডাক বীমার সুদ ৪ কোটি, অন্যান্য সুদ ১ কোটি, বৈদেশিক ঋণের ওপর সুদ ১ হাজার ৭১১ কোটি, ভর্তুকি ও প্রণোদনা ১৭ হাজার ৭২৯ কোটি, সাহায্য ও মঞ্জুরি ৪৩ হাজার ৯১১ কোটি, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের চাঁদা ৬৬ কোটি, ঋণ ও অগ্রিম মওকুফ ৪ কোটি, অবসর ভাতা ও আনুতোষিক ১৬ হাজার ৯১৫ কোটি, রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য ৫৯৬ কোটি, স্থানান্তর ও সমন্বয় ৭ কোটি, থোক বরাদ্দ ২ হাজার ৫৩৮ কোটি আর উন্নয়ন রাজস্ব ৫৭৯ কোটি টাকা অনুন্নয়ন খাতের ব্যয়। এ ছাড়াও কিছু অনুন্নয়ন ব্যয় আছে। নতুন বাজেটে এডিপি ও এডিপিবহির্ভূত কিছু প্রকল্প ব্যয়সহ মোট উন্নয়ন খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাথ ১২ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা। ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকার জাতীয় বাজেটের বাকি সবটাই অনুন্নয়ন খাতে ব্যয় হবে। এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে একসময় জাতীয় বাজেটে সর্বাধিক ব্যয় ধরা হতো বা ব্যয় করা হতো শিক্ষা, স্বাস্থ্য এসব খাতে। আর সরকার ঋণনির্ভর হয়ে পড়ায় এখন ব্যয় বেড়েছে ঋণের সুদ পরিশোধে। যেমন নতুন সার্বিক বাজেটের সর্বোচ্চ বরাদ্দ (১৫ দশমিক ৬ শতাংশ) শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে, তার পরের খাতই হচ্ছে ঋণের সুদ পরিশোধ (১১ দশমিক ৭ শতাংশ)। আবার অনুন্নয়ন বাজেটের ক্ষেত্রে ঋণের সুদ পরিশোধে সর্বাধিক ব্যয় ধরা হয়েছে (১৭ দশমিক ৫ শতাংশ) যেখানে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ব্যয়ের হার ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ। অর্থনীতিবিদরা বাজেট বাস্তবায়নের বিষয়ে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করে থাকেন যেটি হলো রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়া। রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না ঠিকই, তবে প্রতিবছরই আদায় পরিমাণ বাড়ছে। যেমনÑ নতুন অর্থবছরে রাজস্ব প্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৮ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা যা সংশোধিত বাজেটে কমে এসে দাঁড়ায় ১ লাখ ৭৭ হাজার ৪০০ কোটি টাকায়। ২০১৪-১৫ বছরে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা। নি¤œ-মধ্যবিত্তরা সরকারকে সবচেয়ে বেশি কর দেয়। যেমন মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট সব শ্রেণীর মানুষ দেয়। সব শ্রেণী বলতে নি¤œ-মধ্যবিত্তরা বেশি। এ খাত থেকে সর্বোচ্চ রাজস্ব আদায় হয়। নতুন অর্থবছরে এখাত থেকে প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৭২ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এ খাতে আদায় ধরা হয়েছিল ৬৪ হাজার ২৬২ কোটি টাকা। আপনি-আমি পণ্য ক্রয় করতে গিয়ে ঠিকই ভ্যাট দেই, কিন্তু ব্যবসায়ীরা যদি সরকারের ঘরে তা জমা না দেন তবে সেটা ক্রেতার দোষ নয়। যারা ভ্যাট আদায় করেন তারা যদি দোকানির সাথে সুসম্পর্ক রাখেন সেটা তো আপনার-আমার দোষ নয়। আমার এক বন্ধু আছে কর কমিশনার। গত ২৪ বছরের বন্ধু। তার কিছুই কিনতে হয় না। পানির বোতল, ভোজ্য তেল, টিস্যু, যাকাতের কাপড় থেকে শুরু করে সবই চলে আসে। তিনি বিশ্রাম নেবেন, এর জন্য একটি উন্নত মানের হোটেলে একখানা রুম বরাদ্দও আছে। আর চাই কি? আর অন্যান্য বিষয় নাই বা বললাম। যাক সেসব কথা। বাজেট বাস্তবায়ন খুবই সহজ। দশ মাসে এডিপি বাস্তবায়ন ৫০ শতাংশ হলেও দুই মাসে আরো ৫০ শতাংশ না হলেও ৪৫ শতাংশ তো হবেই। টাকা ব্যয়ের ধুম পড়ে যাবে। ‘সরকারি মাল দরিয়ামে ঢাল’, এই তো।
লেখক : সাংবাদিক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাজেট বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে
আরও পড়ুন