Inqilab Logo

রোববার, ০৭ জুলাই ২০২৪, ২৩ আষাঢ় ১৪৩১, ৩০ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

কালশী ট্র্যাজেডির ২ বছর কেন এই বে-ইনসাফ?

প্রকাশের সময় : ১৪ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্টালিন সরকার : তরুণী ফারজানার কথা মনে পড়ে? হাতে পায়ে মাথায় ব্যা-েজ! পরিবারের ৯ জনকে হারানো গোটা শরীর আগুনে ঝলসে যাওয়া ফারজানার ছটপটানির দৃশ্য? কালশী ট্রাজেটির কথা মনে পড়ে? বাইরে থেকে ঘর তালাবন্ধ করে এক সঙ্গে ৯ জনকে পুড়িয়ে মারার লোমহর্ষক ঘটনা! শবে বরাতের রাতে ওটা কি মর্মান্তিক ঘটনা ছিল নাকি উল্লসিত কা-? পিঁপড়ের বাসায় আগুন দেয়ার মতোই পুড়িয়ে মারা হলো এক পরিবারের ৯ জনসহ ১০ মানুষকে। সভ্যতা বিবর্জিত এ বিভৎষ্য ঘটনার পর রাষ্ট্রের ভূমিকা কি? আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনী কি যথাযথ ভূমিকা পালন করেছে? কালশী হত্যাকা-ের মামলা নিয়ে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর আগ্রহ নেই কেন? একজন হত্যার ঘটনায় গোটা দেশ তোলপাড়; পুলিশ-র‌্যাব-বিজিবি-আনছার যৌথ বাহিনীর সঁড়াশি অভিযানে হাজারে হাজার গ্রেফতার হচ্ছে; অথচ এক সঙ্গে ১০ জনকে পুরিয়ে মারার ঘটনায় আইন শৃঙ্খলাবাহিনী নীরব! কালশীর বিহারী পল্লীর ওরা ১০ জন কি আদম সন্তান ছিল না? দস্যুরা সুন্দরবনের বাঘ-হরিণকে হত্যা করলে তাদের ধরতে যে ভাবে হুলুস্থুর করা হয়; হেলিকপ্টারে অভিযান পরিচালনা করা হয়; সেখানে ১০ জন মানুষকে পুড়িয়ে মারার পরও অপরাধীদের ধরতে কোনো পদক্ষেপ নেই? দুই বছরেও মামলার অগ্রগতি নেই? রাষ্ট্রের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব কি শুধু বনের বাঘ-হরিণের না মানুষের? নাগরিকের মধ্যে সমতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার তথা ইনসাফ প্রতিষ্ঠার অঙ্গিকার নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছি। সেই ইনসাফের দেশে জনগণের প্রতি রাষ্ট্রের কেন এই বে-ইনসাফ!
রাজধানীর মিরপুরের কালশী ট্র্যাজেডির ২ বছর আজ। ১০ হত্যার এই ঘটনায় হত্যাসহ ৬টি মামলা করা হলেও আসামি ধরার কোনো অগ্রগতি নেই। মামলার ফাইল যেন লালফিতায় বন্দী। বস্তীর যারা হামলার শিকার হয় পুলিশ বাদী হয়ে তাদের বিরুদ্ধেই মামলা করেছে। এই ৬ মামলায় মোট ৩ হাজার ৭১৪ জনকে আসামি করা হয়। যাদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ ওঠে তাদের কাউকে ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ পর্যন্ত করেনি পুলিশ গত দুই বছরে। উল্টো এমপির নির্দেশে ভিকটিম ক্যাম্পবাসীকে হয়রানী করা হয়। মূলত স্থানীয় এমপির লোকজন তথা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের নেতা হওয়ায় পুলিশ ঘটনার সাথে জড়িত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি; আগ্রহ দেখায়নি। ঘটনার দিন ক্ষতিগ্রস্থদের অনেকের বিরুদ্ধে দেয়া হয়েছে একাধিক মামলা। এমনকি রেহাই পায়নি পুলিশের গুলিতে নিহত ব্যক্তিও। তাকেও আসামি করা হয়েছিল। দিবসটি উপলক্ষে বাংলাদেশ বিহারী পূনর্বাসন সংসদ (বিবিআরএ) মীরপুর-১০ নম্বর গোল চত্বরে মিছিল ও সমাবেশের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। প্রখ্যাত চিন্তাবিদ বদরুদ্দিন উমরের জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলসহ বাম রাজনৈতিক দল ও কিছু সংগঠন কর্মসূচি পালন করবে। মিরপুরের কালশীর কুর্মিটোলা বিহারী ক্যাম্পে আগুনে পুড়ে মারা যায় ৯ জন। পরে একজন মারা যায় পুলিশের গুলিতে। সে রাতে প্রাণে বেঁচে যান তরুণী ফারজানা। পরিবারের কর্তা ইয়াসিন আলী সে রাতে অন্যত্র থাকায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান। সেদিন বাঁচলেও ভয়াবহ ওই ঘটনার আড়াই মাস পর এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় ইয়াসিন। শরীরে পোড়া ক্ষত ও মনের নিদারুণ যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছে ওই পরিবারের একমাত্র সদস্য ফারজানা। বয়ে বেড়াচ্ছেন কালশী ট্র্যাজেডির সেই ভয়াবহ স্মৃতি।
২০১৪ সালের ১৩ জুন। সেদিন ছিল শবে বরাত। হাজার বছরের পূর্ন রজনী। ওই রাতে কালশী কুর্মিটোলা বিহারি ক্যাম্পের ছেলেরা আতশবাজি করছিল। হঠাৎ করে অন্য একটি পক্ষ থেকে রাস্তায় বেরিয়ে উল্লাস শুরু হয়। এক পর্যায়ে দুই পক্ষ্যের মধ্যে শুরু হয় ঝগড়া ও মারামারি। রাতেই বিষয়টি মীমাংসা হয়ে যায়। এ দিকে অন্যরা রাতে ইবাদত বন্দেগি করে যে যার মতো ঘুমিয়ে পড়েন। কেউ কেউ ভোররাতে (১৪ জুন) ভোরে ফজরের নামাজ আদায় করে ঘুমাতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এমন সময় লালমাটিয়া বস্তির কয়েকটি ছেলে বিহারি ক্যাম্পের সামনে আতশবাজি ফুটাতে শুরু করে। এতে বিহারী ক্যাম্পের ছেলেরা ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের ধাওয়া করে। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে আবার ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া শুরু হয়ে যায়। পাশে আগে থেকে অবস্থানরত আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা উভয় পক্ষকে ধাওয়া দিয়ে তাড়িয়ে দেয়। একপর্যায়ে সেখানে বিপুল পুলিশের সমাগম ঘটে। সংঘর্ষের প্রায় ২ ঘণ্টা পর পুলিশ, আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী বিভিন্ন সংগঠনের বিপুল নেতাকর্মী ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তখন পুলিশ মুহুর্মুহু গুলি, রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। হঠাৎ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও পুলিশ ক্যাম্পে ঢুকে ব্যাপক ভাঙচুর শুরু করে। একপর্যায়ে পুলিশের উপস্থিতিতে তরুণরা ক্যাম্পের আই ব্লকের মোহাম্মদ ইয়াসিনের ঘরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিলে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে আগুন। বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে দেয়ায় ঘরে থাকা সবাই দগ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। পরে ক্যাম্পের বাসিন্দা, ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা প্রায় দেড় ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। পরে ঘর থেকে একে একে ৯টি লাশ উদ্ধার করা হলে বিহারিরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তাদের বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করতে গুলী চালালে পুলিশের গুলিতে মারা যায় আরো একজন। পুলিশ লাশের কাছে যেতে চাইলে শুরু হয় তুমুল সংঘর্ষ। দিনভর সংঘাত-সংঘর্ষের পর বিকেলে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হতে থাকে। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ ক্যাম্পের একাধিক বাসিন্দাকে ধরে নিয়ে যায়। এ ঘটনা শুধু দেশের মিডিয়ায় নয়, বিবিসি, সিএনন, আলজাজিরাসহ বিশ্বের প্রভাবশারী মিডিয়াগুলোতে গুরুত্ব সহকারে প্রচার করা হয়। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংঘঠনগুলো তীব্র প্রতিবাদ করে। সেদিন যারা মারা যান তারা হলেন, বেবি আক্তার, মেয়ে শাহানা (২৬), আফসানা (১৯), রোকসানা (১৬), যমজ দুই ছেলে লালু ও বুলু, বড় ভাই আশিক ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী শিখা, নাতনী মারুফ। পুলিশের গুলিতে নিহত হন আজাদ (৩৫)। পরিবারের ১০ সদস্যকে হারিয়ে আগুনে পোড়া ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছে ফারজানা। সেও আগুনে পুড়ে গুরুতর আহত হয়। দীর্ঘ ৩ মাস চিকিৎসাধীন থাকার পর ফারজানা সুস্থ হয়। এখনো তার শরীরে রয়েছে কালশীর ভয়াবহতার অসংখ্য চিহ্ন। ফারজানা শরীরের সেই ক্ষতের পাশাপাশি মনের যন্ত্রণা নিয়েই খালা সাহিদা ও খালু আসলাম খানের মোহাম্মদপুর মার্কেট ক্যাম্পের বাসায় বসবাস করছে।
বিশ্বে মানবাদিকারকে যখন সবচেয়ে অধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে; তখন কালশির লোমহর্ষক হত্যাকা- কোনোভাবেই হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। রাজধানীর বুকে এই ধরণের হত্যাকা-ের ঘটনায় সাধারণ মানুষকে চরমভাবে আতংকিত। ওই ঘটনায় নেপথ্য নায়ক হিসেবে স্থানীয় সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জুয়েল রানা ও পুলিশের নাম আসায় ঘটনার জড়িতেদের গ্রেফতারে পুলিশের আগ্রহ নেই। ১০ জনকে পুড়িয়ে ও এক জনকে প্রকাশ্য গুলি করে হত্যার ঘটনায় গোটা বিশ্ব তোলপাড় হয়েছে। অথচ প্রশাসন এবং বিবেকবানরা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে দুই বছর ধরে। ওরা বিহারী বলেই কি তাদের বিচার পাওয়ার অধিকার নেই? বিহারিরা রিফিউজি নয়; ওরাও মানুষ এমন ভাবনায়ই ওদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। তা না হলে উন্নয়ন, গণতন্ত্র, আইনের শাসন সবকিছু মুখ থুবড়ে পড়ে যাবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কালশী ট্র্যাজেডির ২ বছর কেন এই বে-ইনসাফ?
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ