ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
শরদিন্দু ভট্টাচার্য্য টুটুল : আমরা যখন মনে মনে চিন্তা করি সকল অন্ধকার ভেদ করে সুন্দরের সাধনায় মেতে উঠব তখনই দেখা যায় আমাদের চিন্তার অভিযাত্রায় অন্ধকার আরও গভীর হয়ে সকল চিন্তার শুভ্রতাকে কালিমালিপ্ত করে তুলছে। আমরা ভাবি, আগামীকালের সকালটা আসুক মঙ্গলের শুভ বার্তা নিয়ে। কোন ধরনের অমঙ্গলের বার্তা যেন আমাদের মনকে হতাশায় নিমজ্জিত করতে না পারে। কিন্তু আমাদের জীবনের বাস্তবটা ভিন্ন হয়ে দেখা দেয়। বাস্তবে দেখা যায়, মঙ্গলময় বার্তা আমাদের সমাজবদ্ধ মানুষের জীবন থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে। সুনামির মত ছুটে এসে আমাদের মগজের শুভ চিন্তাকে যেন একেবারে তছনছ করে ফেলে। আমরা অসহায়ের মতো চেয়ে থাকি। আমাদের কিছুই করার থাকে না। যেন পায়ের তলার মাটি সরে যেতে থাকে। চারপাশের অব্যবস্থা আমাদের জীবনের শুভ বোধও কেড়ে নেয়। আমরা চিৎকার করি অশুভ অন্ধকার থেকে মুক্তি পাবার আশায়। শত চেষ্টা করেও জীবনের সকল হতাশাকে মুছে ফেলতে পারি না। জীবনে চলার পথে চাই মঙ্গলালোকের দ্যুতি। কিন্তু তা আর হয় না। হতাশা আমাদের পিছু ছাড়ে না। কোথা থেকে যেন ঝড়ো বাতাস ধেয়ে আসে চারিদিকের সকল পবিত্র শিখা নিভিয়ে ফেলতে। আমরা আজ বুঝেও কিছু বলতে পারি না। কোথায় যেন একটা ভয় কাজ করে। আমরা এখন দেখেও না দেখার ভান করে ঘুমিয়ে থাকি।
আমরা এখন বাস করছি একটা আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায়। আমরা সভ্যজনরা দাবি করে থাকি, আমাদের মধ্যে এখন কোনকিছুর অভাব নেই। আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি সকল বিপথগামিতার জাল ছিন্ন করে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, আমরা মুখে বলি আধুনিক বিজ্ঞানমনষ্কতা নিয়ে আমাদের আগামীকালের পথচলাকে এগিয়ে নিতে চাই। কিন্তু বাস্তবে আমরা চিন্তা করি অন্যরকমভাবে। বাস্তবে আমাদের জীবনযাপনে আধুনিকতার কোনো ছোঁয়া থাকে না। কুসংস্কার আমাদের বিজ্ঞানমনষ্কতার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাই ভয়ের মধ্যে বাস করে অনৈতিকতাকে অনুসরণ করতে। আমরা আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করি ঠিকই কিন্তু আধুনিকতার মধ্যে যে প্রগতির বার্তা থাকে তা মানতে চাই না। প্রগতির সেই শুভ বার্তাকে আমরা গ্রহণ করতে চাই না বলেই লেখাপড়া করেও আমরা যেন মানুষ হতে পারি না। প্রগতির শুভ বার্তার ভাষা বুঝতে পারি না বলেই আজ আমাদের সমাজ জীবনে হতাশা বিরাজ করছে। সবাই জানেন, যে সমাজের মানুষ চরম হতাশার মধ্যে ডুবে থেকে সকল পুরাতনকে আপন বন্ধুর মতো ভালোবেসে বেঁচে থাকতে চায়, সেই অন্ধ সমাজের মানুষ কখনো সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে না। যুগে যুগে মানুষ যা সত্য, যা সুন্দর তা-ই গ্রহণ করেছে। বেঁচে থাকার তাগিদ থেকেই মানুষ সত্য-সুন্দরের পিছনে দৌড়ায়। মানুষের সুন্দর জীবনের লড়াই কখনো থেমে থাকে না। অনেক কষ্টের পরও মানুষ যখন তার লড়াইয়ে জয়ী হয় তখনই সুখের আনন্দে নতুন কিছু নির্মাণ করে। মানুষ কোনো কিছু স্বপ্নের আহŸানে নির্মাণ করে এবং করেছে বলেই মানুষ আজকের আধুনিক পৃথিবী নির্মাণ করতে পেরেছে।
লেখার শুরুতেই বলেছিলাম আমরা যখন মনে মনে চিন্তা করি সকল অন্ধকার ভেদ করে সুন্দরের সাধনায় মেতে উঠব তখনই দেখা যায় আমাদের চিন্তার সকল অভিযাত্রায় অন্ধকার আরও গাঢ় হয়ে ওঠে। আজ যদি আমরা দেশের সকল সংবাদপত্রের দিকে চোখ মেলে তাকাই তাহলে বুঝতে পারবো, আমরা দেশবাসী কতোটা গভীর অন্ধকারে আকণ্ঠ ডুবে আছি। সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়েছে, এখন দেশের খোলা বাজারে সরকারি ওষুধপত্র পাওয়া যাচ্ছে। অভিযান জরিমানা চললেও বন্ধ হচ্ছে না এসব ওষুধের বেচাকেনা। অভিযোগ করা হয়েছে, বিভিন্ন হাসপাতাল ও সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান থেকে দেশের জনসাধারণের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য যে ওষুধ সরকার থেকে দেয়া হয় তা এখন বাজারের বিভিন্ন ওষুধের দোকান কিংবা ফার্মেসিতে চলে যাচ্ছে। প্রকাশিত সংবাদে আরও বলা হয়েছে, ওষুধের বড় বাজার মিটফোর্ডে এসব সরকারি ওষুধ সবচেয়ে বেশি পাওয়া যাচ্ছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ও পুলিশ কিছুদিন পর পর অভিযান চালিয়ে অপরাধীদের অর্থাৎ সরকারি ওষুধ রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জেল-জরিমানা করা হচ্ছে। তারপরও দেখা যাচ্ছে। এমন হীনকর্মে জড়িত ব্যক্তিরা তাদের কুকর্ম থেকে কিছুতেই বিরত হচ্ছে না। খোলাবাজারে ঠিকই সরকারি ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে। অভিযানকালে কোটি কোটি টাকা মূল্যের সরকারি ওষুধ উদ্ধারও করা হচ্ছে। সংবাদ অনুযায়ী, গত ৪ মাসে ওই মার্কেটে র্যাব ৬১টি অভিযান চালায় অপরাধীদের ধরার জন্য। র্যাব অভিযান চালিয়ে সরকারি ওষুধ কেনাবেচার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের দুই কোটি এগারো লক্ষ টাকা জরিমানা করেছে। তারপরও সরকারি ওষুধ খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হল, খোলাবাজারে যেভাবে সরকারি ওষুধ পাচার হচ্ছে কিংবা যারা পাচার করছে তারা নিশ্চয়ই সাধারণ মানের অপরাধী কিংবা পাচারকারী নয়। তাদের পিছনে নিশ্চয়ই আমাদের সমাজের একশ্রেণীর রাঘববোয়াল জড়িত আছেন। সাধারণ অপরাধীরা তখনই ভয়ংকর হয়ে ওঠে, যখন তারা বুঝতে পারে শত অপরাধ করেও তাদের পাপের কোন শাস্তি হবে না। তাই বলছিলাম, সরকারি ওষুধ খোলাবাজারে বেচাকেনার সাথে যারা জড়িত তাদের ধরে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, তোমরা কোথা থেকে এসব ওষুধ সংগ্রহ করছ তখন তারা ঠিকই বলবে তারা কিভাবে এবং কোন কোন ব্যক্তি তাদের কাছে সরকারি ওষুধ পাচার করেছে খোলাবাজারে বিক্রির জন্য। তখন যদি পাচারকারীদের ধরা যায় এবং তাদের আইনের আওতায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা যায় তাহলে ঠিকই রাঘববোয়ালদের নাম বেরিয়ে আসবে। শুধু অভিযান চালিয়ে কিংবা জরিমানা করে দুর্বৃত্তদের নিবৃত্ত করা যাবে না। আমাদের এই রাষ্ট্র ব্যবস্থায় একশ্রেণীর রাঘববোয়াল আছেন, যারা আমাদের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। তারা থাকেন ক্ষমতার খুব কাছাকাছি। তাদের কেউ কিছু বলার সাহস করে না। কেননা তারা সকলকেই ভাগ দেন। একবার চিন্তা করে দেখুনতো একটা মার্কেটে র্যাব কর্তৃক ৬১টি অভিযানের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা জরিমানা করার পরও খোলাবাজারে সরকারি ওষুধের বেচাকেনা চলছে। রাষ্ট্রও দুর্বৃত্তদের নিয়ন্ত্রণ করতে কিংবা থামাতে পারছে না। তার মানে কি? তার মানে হচ্ছে যে, যে টাকা জরিমানা করা হয় তারা হয়তো বা তার অনেক অনেক গুণ বেশি টাকার সরকারি ওষুধ বেচাকেনা করে লাভ করে থাকে। এই জরিমানার টাকা তাদের কাছে কিংবা অপরাধীদের কাছে কোন ব্যাপারই নয়। তাই এখানে যে কথা বলতে চাই আর তা হল। সরকারি ওষুধ বাজারে পাচার বন্ধ করতে হলে মূল জায়গায় রাষ্ট্রকে হাত দিতে হবে। মূল জায়গায় অর্থাৎ বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালসহ যেখান থেকে ওষুধ পাচার হয়ে বাজারে আসছে সেখানে যদি হাত দেয়া হয় তাহলে হয়তো অপরাধীদের থামানো কিংবা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। মূল পাচারকারীদের ধরে ধরে শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থা করলে এবং যাদের বলা হয়ে থাকে সমাজের অনিষ্ট সাধনকারী বড়কর্তা কিংবা বড় কর্তাদের রক্ষাকারী সমাজের সেইসব রাঘববোয়াল যারা কেবল দুর্বৃত্তদের পক্ষে থেকে নিজের লাভ পকেটে ভরে থাকে তাদেরও যদি চিহ্নিত করা যায় এবং শাস্তি দেয়া যায় তবেই দেখা যাবে খোলাবাজারে সরকারি ওষুধ পাচার করার সাহস কেউ পাচ্ছে না। আমাদের সবচেয়ে দুর্ভাগ্য হল যে, ক্ষমতার আশপাশে থেকে যারা রাষ্ট্র ও জনগণের ক্ষতিসাধন করে থাকে তাদের আমরা খুব সম্মান করে থাকি। তাদের কিছু বলার কিংবা তাদের সমাজ সংসার থেকে উচ্ছেদ করার সাহস আমরা পাই না। এসব ক্ষমতাবান নিজেদের মনে করেন, তারা আইনের ঊর্ধ্বে। তাদের শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা কারও নেই। তবে আমরা যেদিন এসব নষ্টদের বিচার করে শাস্তি দিতে পারবো সেদিনই দেখা যাবে সরকারি ওষুধ পাচার হয়ে বাজারে বিক্রির জন্য আসছে না। সেদিন আমরা এটাও বুঝতে পারবো আমাদের চোখের সামনে থেকে সকল অন্ধকার দূর হয়ে গেছে এবং আমরা প্রভাত আলোর কোমল স্পর্শে পবিত্র হয়ে আলোর ঝর্ণাধারায় সাঁতার কাটছি।
লেখক: কবি, গল্পকার ও আইনজীবী
কালীবাড়ী রোড, হবিগঞ্জ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।