Inqilab Logo

বুধবার, ০৩ জুলাই ২০২৪, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১, ২৬ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

৪০ হাজার কোটি টাকা দেবে চীন

গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণে ভারতের আপত্তিতে হতাশ বাংলাদেশ

প্রকাশের সময় : ১২ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৩৩ পিএম, ১১ জুন, ২০১৬

সাখাওয়াত হোসেন বাদশা : স্বপ্নের গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণে আশাজাগানিয়া প্রস্তাব দিয়েছে চীন। এই ব্যারেজ নির্মাণে দেশীয় সমীক্ষায় যে ব্যয় ধরা হয়েছে তার চেয়েও ৮ হাজার কোটি টাকা বেশি করতে চায় চীনের প্রতিষ্ঠানটি। এতে করে তাদের ব্যয় দাঁড়াবে ৪০ হাজার কোটি টাকা। তবে প্রকল্পটি নির্মাণে ভারতের আপত্তি এখনও বহাল রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে নানবিধ কূটনৈতিক উদ্যোগ নিয়েও এ ব্যাপারে ভারতের ইতিবাচক কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। ফলে ভারতের অমূলক আপত্তিকে কেন্দ্র করে হতাশ বাংলাদেশ। এদিকে, গঙ্গা ব্যারেজ সমীক্ষায় মোট ব্যয় ৩২ হাজার কোটি টাকা দেখানো হলেও, চীনের কোম্পানি চায়না পাওয়ার যে প্রতিবেদন দিয়েছে তাতে ব্যয় বৃদ্ধির অন্যতম কারণ দেখানো হয়েছে বিদ্যুৎ খাতকে কেন্দ্র করে। চীনের এই প্রতিবেদন গত ২৫ মে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সরকার এই প্রস্তাবে সম্মত হলে চীনের প্রতিষ্ঠান চায়না পাওয়ারের সাথে এই নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর হতে পারে। জানা গেছে, চীনের এই প্রস্তাবনা সরকার কতটুকু গ্রহণ করবে তা নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওপর। ব্যারেজটি নির্মাণ হলে গঙ্গা অববাহিকার ১৬টি নদী নাব্যতা ফিরে পাবে এবং বছর জুড়েই এসব নদীতে পানি থাকবে। এছাড়াও প্রতিবছর সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত ফসল পাওয়া যাবে। ব্যারেজটি নির্মাণকাল ধরা হয়েছে পাঁচ বছর। এদিকে, গঙ্গা ব্যারেজ নিয়ে ভারতের অবস্থান বাংলাদেশের জন্য একেবারেই হতাশাব্যঞ্জক। শুধুমাত্র ভারতের আপত্তির কারণেই এই প্রকল্পটি গত চার বছর ধরে আটকে আছে। অথচ ২০১৪ সালের মার্চেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই প্রকল্পের কাজ উদ্বোধন করার কথা ছিল। কিন্তু ভারতের গ্রীন সিগন্যাল না পাওয়ায় দফায় দফায় প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। সর্বশেষ চলতি বছর মে মাসে এই প্রকল্পের ৬ষ্ঠ দফা মেয়াদ বাড়ানো হয়। চীনের প্রস্তাবনায় সরকার সম্মত না হলে এই প্রকল্পের কাজ কবে শুরু হবে তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছে না। এই প্রকল্পটি নিয়ে ভারতের হাস্যকর আপত্তিটি হচ্ছে- গঙ্গা ব্যারেজ বাস্তবায়ন হলে এর অভ্যন্তরে থাকা পানি উল্টো স্রোতে ভারতীয় অংশে আঘাত হানবে। ফলে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় নদী ভাঙন দেখা দিতে পারে- এমন আশঙ্কার কথা লিখিতভাবে বাংলাদেশকে জানিয়েছে দিল্লী।
এদিকে ভারতের এমন আপত্তির জবাব দিয়েছে বাংলাদেশ। দিল্লীকে লিখিতভাবে জানানো হয়, তাদের এহেন আশঙ্কা ভিত্তিহীন। কারণ, গঙ্গা ব্যরাজের পানি ‘ব্যাক ফ্লো’ হয়ে কোনভাবেই ভারতীয় অংশে আঘাত হানবে না। আর ব্যাক ফ্লো হলেও প্রায় ২শ’ কিলোমিটার দূরে ঢেউ যেয়ে ভারতীয় অংশে ভাঙন ধরানোর প্রশ্নই আসে না। এ জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রয়োজনে যৌথ সমীক্ষা করার প্রস্তাবও রাখা হয়। এরপরও ভারতের সাড়া মেলেনি। যার ফলে বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্নের গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ থেমে আছে।
গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্পটির সমীক্ষা চলাকালে একাধিকবার বলা হয়েছে, রিপোর্ট পেশ করা হলেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই প্রকল্পের কাজ উদ্বোধন করবেন। সমীক্ষা শেষে রিপোর্টও পেশ হয়েছে প্রায় চার বছর। কিন্তু এখন পর্যন্ত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ছয় কোটি মানুষের বেঁচে থাকার স্বপ্ন গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়নি। এই এলাকার মানুষের প্রশ্ন কবে শুরু হবে এই প্রকল্পের কাজ? সরকার দেশের উন্নয়নে নানামুখী প্রকল্প গ্রহণ করলেও এই প্রকল্পটি দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোর অন্যতম বলে মনে করেন দেশের পানি বিশেষজ্ঞরাও। ইতোপূর্বে সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে প্রয়োজনে নিজস্ব অর্থায়নেই গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্পটির জন্য বৈদেশিক সহায়তাও খোঁজা হয়। এ পর্যায়ে মালয়েশিয়া ও চীন আগ্রহ প্রকাশ করে। এরই অংশ হিসাবে চায়না পাওয়া কোম্পানি পৃথক সমীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করে সরকারের কাছে জমা দিয়েছে।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, রাজবাড়ী জেলার পাংশায় এই ব্যারেজ নির্মাণ করা হবে। ব্যারেজটি হবে নীলফামারীর ডালিয়ায় নির্মিত তিস্তা ব্যারেজের আদলে। ব্যারেজ থেকে উজানে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাংখা পর্যন্ত ১৬৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে থাকবে বিশাল রিজার্ভার। যার পানি ধারণক্ষমতা থাকবে ২৯শ’ মিলিয়ন মিটার কিউব। এই পরিমাণ পানি থেকে ব্যারেজের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে ২ হাজার মিলিয়ন কিউসেক মিটার পানি সরবরাহ করা হবে।
প্রকল্পের ডিপিপি থেকে জানা গেছে, ব্যারেজের দুই পাশের আটটি সংযোগ খালের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে এই পানি ছাড়া হবে। এর ফলে গঙ্গানির্ভর ১৬টি নদী শুষ্ক মৌসুমে ফিরে পাবে নাব্যতা। সেইসাথে গঙ্গা অববাহিকার ৫১ লাখ হেক্টর জমির মধ্যে ১৯ লাখ হেক্টর জমি সরাসরি সেচের আওতায় চলে আসবে। আগামী ৫ বছরের মধ্যে এই ব্যারেজ নির্মাণ সম্ভব বলে ডিপিপি’তে উল্লেখ করা হয়েছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এই ডিপিপি অনুমোদন দেয়ার পর তা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায় ২০১৪ সালের জুনে। ব্যারেজের দৈর্ঘ্য ধরা হয়েছে ২১শ’ মিটার। এর গেট থাকবে ৯৬টি। ফিস পাস থাকবে ২টি এবং নেভিগেশন লক থাকবে ১টি। এছাড়াও থাকবে একটি পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এখান থেকে ১১৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ (চীনের প্রস্তাবনায় ১২০ মে.ও.) উৎপাদন হবে। এই ব্যারেজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর মাধ্যমে ১২ মাসই পানির প্রবাহ কন্ট্রোল করা যাবে। যা দেশের আর্থ-সামাজিক ও অর্থনৈতিক খাতে বড় ধরনের বিপ্লব নিয়ে আসবে। দেশ রক্ষা পাবে মরুময়তা ও লবণাক্তের কবল থেকে। পরিবেশে ফিরে আসবে ভারসাম্য। ব্যারেজটি নির্মাণ হলে দেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ মানুষের স্বপ্ন পূরণ হবে। সম্পূর্ণ দেশীয় অর্থায়নে এটি নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে। তবে বৈদেশিক সহায়তা পাওয়া যায় কিনা-এটিও খুঁজে দেখা হবে।
কেন এই ব্যারেজ
ভারত কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বৃদ্ধি এবং সিল্ট ফ্লাসিংয়ের উদ্দেশ্যে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি-ভাগীরথী নদীতে ৪০ হাজার কিউসেক পানি সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা আঁটে। এজন্যই গঙ্গা নদীর উজানে ফারাক্কা নামক স্থানে এই ব্যারেজ নির্মাণ করা হয়। আর ১৯৭৫ সালে তা পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয় এবং চালুর পর থেকে প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে এই ব্যারেজের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করা হয়। ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে তৎকালীন সরকারের সাথে ভারত গঙ্গার পানি ভাগাভাগি নিয়ে ত্রিশ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তি অনুযায়ী, শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ সর্বনিম্ন ৩৫ হাজার কিউসেক পানি পাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে-এই পরিমাণ পানি ভারত বাংলাদেশকে দেয় না এবং চুক্তির গ্যারান্টি ক্লোজ পর্যন্ত মেনে চলে না। ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গানির্ভর নদীগুলো পানি শুন্য হয়ে পড়ে। দেখা দেয় মরুময়তা। পরিবেশেও এর বিরূপ প্রভাব দেখা দেয়। এতে করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাসমূহে দরিদ্রতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। আর অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়ে। দেশকে এই করুণ পরিণতির কবল থেকে রক্ষার জন্যই পাংশায় এই ব্যারেজ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। এ লক্ষ্যে ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি অ্যান্ড ডিটেইল্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ফর গ্যাঞ্জেস ব্যারেজ প্রজেক্ট’-এর আওতায় সমীক্ষা চালানো হয়েছে। ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ডিজাইন কনসালট্যান্ট নামক একটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান এই ব্যারেজ নির্মাণে চূড়ান্ত সমীক্ষা পরিচালনার কাজটি করে। এই প্রতিষ্ঠানটির সাথে পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া ও চীনের বিশেষজ্ঞরাও জড়িত ছিল। সমীক্ষা বাবদ ব্যয় হয় ৪০ কোটি টাকা। বর্তমানে ফারাক্কার প্রভাবে এদেশের ৫ কোটি মানুষ আর্সেনিক ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছে। গঙ্গানির্ভর প্রায় ৪৬ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার গৃহস্থালির পানি সরবরাহ, কৃষি, মৎস্য, বনজসম্পদ, নৌ-চলাচল, শিল্প কারখানা এবং সুন্দরবনসহ দেশের এক-তৃতীয়াংশ বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার।
ব্যারেজের সুবিধা
এই ব্যারেজ নির্মাণ হলে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা, কুষ্টিয়া, যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, নড়াইল, খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ, শরিয়তপুর, মাদারীপুর জেলার ১৬টি নদীর পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে এবং লবণাক্ততা থেকে রক্ষা পাবে। এতে করে এখানকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব হবে। ব্যারেজটি নির্মাণ হলে গঙ্গানির্ভর এলাকার মানুষের জীবিকার প্রসার, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন তথা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সাধন হবে। বাঁচবে সুন্দরবনের বনজসম্পদ। এই ব্যারেজের মাধ্যমে বছরজুড়েই পানি ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। বর্তমানে যেসব ব্যারেজ রয়েছে তার মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে ৩ থেকে ৪ মাস পানি ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তাও আবার বৃষ্টি না হলে সমস্যা দেখা দেয়। জানা যায়, মনু ব্যারেজ, তিস্তা ব্যারেজ, মহুরি ব্যারেজ, কেআইপি এবং জিকে প্রকল্পের মাধ্যমে যে সেচ ব্যবস্থা চালু রাখা হয়েছে-তার সুবিধা কৃষকরা পেয়ে থাকেন ৩ থেকে ৪ মাস। আর পাংশায় বিকল্প গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণ হলে বছরজুড়েই পানি সরবরাহ করা সম্ভব হবে। মধ্য জুলাই থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত ৩ মাস অর্থাৎ বর্ষা মৌসুমে ব্যারেজের সবগুলো গেটই খুলে রাখা হবে স্বাভাবিক পানি প্রবাহের জন্য। মধ্য অক্টোবর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পানি রিজার্ভারে আটকানো হবে। এরপর শুষ্ক মৌসুমে এই পানি ছাড়া হবে।
প্রকল্প থেকে আয়
এই প্রকল্প থেকে বছরে ৭ হাজার ৩শ’ কোটি টাকা আয় আসবে। দীর্ঘমেয়াদে এই আয় আরও বৃদ্ধি পাবে। আর এই প্রকল্পে বিনিয়োগ উঠে আসতে সময় লাগবে মাত্র ৫ বছর। প্রকল্পটির গ্রস এরিয়া ৫১ লাখ হেক্টর। যা দেশের মোট এলাকার ৩৭ শতাংশ। এর মধ্যে ২৯ লাখ হেক্টর জমি কৃষি কাজে এবং ১৯ লাখ হেক্টর জমি বোরো চাষের আওতায় আনা হবে। যার ফলে বছরে ২৫ লাখ মেট্রিক টন বাড়তি ধান এবং ১০ লাখ টন অন্যান্য ফসল উৎপাদন হবে। মৎস্য উৎপাদন হবে ২ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন। এই প্রকল্পটি না হওয়ার কারণে প্রতি বছর ১১ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্থ হয় বিভিন্ন কারণে। এছাড়াও প্রতি ৫ বছর অন্তর যে খরা দেখা দেয় এতে করে গঙ্গানির্ভর এলাকার মানুষের মাঝে অর্থনৈতিক দুরাবস্থা নেমে আসে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে যেখানে চাষাবাদের এলাকা বৃদ্ধি পাবে, সেখানে বর্তমানে শুষ্ক মৌসুমে পানি না পাওয়ায় চাষাবাদের এলাকার পরিমাণ এসে দাঁড়িয়েছে মোট জমির ১৬ শতাংশ। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে গড়াই, হিসনা, চন্দনা ও জিকে পাম্পের জন্য ৭শ’ কিউসেক মিটার, গড়াই হাইড্রোপাওয়ারের জন্য ৩শ’ কিউসেক মিটার এবং গঙ্গা ব্যারেজের জন্য ১ হাজার কিউসেক মিটার মোট ২ হাজার কিউমেক মিটার পানি গঙ্গা নির্ভর এলাকাসমূহে পৌঁছে দেয়া সম্ভব। এই পানি পৌঁছানো হবে ব্যারেজের দুই পাশের আটটি সংযোগ খালের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে।
ভারতের আপত্তি
এই ব্যারেজ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হলে ইতোপূর্বেও ভারত একাধিকবার আপত্তি দিয়েছে। ভারতের আপত্তির কারণে এই ব্যারেজ নির্মাণের উদ্যোগ বারবার ভেস্তে গেছে। এমনকি ভারতের কারণে কোনো দাতা দেশ ও সংস্থাও এ খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখায়নি। এরপরও পানি উন্নয়ন বোর্ড এই প্রকল্পের হাল ছাড়েনি। বর্তমান সরকারের প্রথম মেয়াদে এই প্রকল্পের সমীক্ষা শেষ করে ডিপিপি চূড়ান্ত করা হয়। ২০১৪ সালের মার্চে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, ভারত সম্মত না হওয়ায় সরকার এই প্রকল্পের কাজ শুরু করতে পারছে না। এ নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আমরা গঙ্গা ব্যারেজ বাস্তবায়ন করতে চাই। প্রয়োজনে তা ভারতে সাথে নিয়ে হলেও করবো।
‘ফিজিবিলিটি স্টাডি অ্যান্ড ডিটেইল্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ফর গ্যাঞ্জেস ব্যারেজ প্রজেক্ট’ নামক এই প্রকল্পটি চারদলীয় জোট শাসনামলে ২০০৫ এর ১৮ এপ্রিল অনুমোদন হয়। প্রকল্পটির মূল মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০০৪-০৫ থেকে ২০০৭-০৮ সাল পর্যন্ত। পরবর্তীতে এর মেয়াদ বাড়িয়ে তা ২০১০ এর জুন পর্যন্ত নেয়া হয়। এরপর পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের জন্য একই বছর আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দু’বছরের শাসনামলে এই প্রকল্প সমীক্ষার কাজ বন্ধ রাখা হয়েছিল।
চায়না পাওয়ার কোম্পানির প্রস্তাব
বিকল্প গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনৈর কোম্পানি চায়না পাওয়ার এগিয়ে এসেছে। চীনের ‘থ্রি গর্জিয়াস’ ড্যাম নির্মাণকারী এই প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে বিকল্প গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণের জন্য একটি প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। চীনের দেয়া ওই প্রতিবেদনে গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণে দেশীয় সমীক্ষা রিপোর্টের সাথে একমত পোষণ করা হয়েছে। ব্যারেজটি নির্মাণ হবে হার্ডিঞ্জ ব্রীজ থেকে ৫৮ কিলোমিটার ভাচিতে। চায়না কোম্পানির প্রস্তাবনায় প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় বৃদ্ধির বড় একটি অংশ খরচ হবে জাতীয় গ্রীডের সাথে সংযুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে। বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদন ও এখারকার ১২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণ করে জাতীয় গ্রীডে নিতে যে পরিমাণ ব্যয় হবে-সেই খরচ সমীক্ষা রিপোর্টে ধরা ছিল না। চায়না পাওয়ারের সাথে সরকারের সর্বশেষ বৈঠক হয় ২০১৫ এর ২৪ মে। চলতি বছরের শুরুতে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি প্রতিনিধি দল চীন সফর করে আসে। চলতি বছরের ২৫ মে চায়না পাওয়ার কোম্পানি পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে একটি প্রতিবেদন দাখিল করে। পাউবো’র এ সংক্রান্ত কমিটি চায়না পাওয়ার কোম্পানির প্রস্তাবনাটি মতামতসহ পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। পাউবো’র মতামতে বলা হয়, চায়না পাওয়ারের প্রস্তাবনাটি সঠিক। সরকার চায়না পাওয়ারের সাথে চুক্তির বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে।
পানি সম্পদ মন্ত্রীর বক্তব্য
এ ব্যাপারে পানি সম্পদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ইনকিলাবকে বলেন, গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্প আমরা করবো। এ সংক্রান্ত সমীক্ষার কাজ শেষ হয়েছে। এ প্রকল্পের কাজের উদ্বোধন বিলম্ব হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা ভারতকে সাথে নিয়েই এই প্রকল্পের কাজ শুরু করতে চাই। চীনের একটি কোম্পানির পক্ষ থেকে থেকে দেয়া প্রতিবেদনের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরা প্রকল্পটির জন্য বৈদেশিক সহায়তা খুঁজছি। আমরা আশা করি, ভারত এই প্রকল্পে অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করবে।
ফিরে দেখা
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৯ সালে ওয়ারপো এবং যৌথ নদী কমিশন ৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারণ করে জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে একাধিকবার তাগিদ দিয়েছিল। ১৯৬১ সাল থেকে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ চলছে। প্রকল্পটি যাতে না হয় এ লক্ষ্যে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ভারত জাতীয় স্বার্থবিরোধী প্রস্তাবও রেখেছিল। ওই প্রস্তাবনায় ভারত ব্রহ্মপুত্রের উজানে যোগিগোপা ব্যারেজ করে ২০০ মাইল লম্বা খালের মাধ্যমে ১ লাখ কিউসেক পানি নিয়ে ফারাক্কার উজানে গঙ্গায় ফেলার কথা বলেছিল। আধামাইল চওড়া এই সংযোগ খালটি গভীরতা ধরা হয়েছিল ৩০ ফুট। শুকনা মৌসুমে যেখানে ব্রহ্মপুত্রে ১ লাখ ৩০ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহ থাকে; সেখান থেকে ১ লাখ কিউসেক পানি নেয়া হলে এই নদীর অবস্থা গঙ্গার চেয়েও ভয়াবহ হবে-এটা আঁচ করতে পেরেই ওই সময় ভারতীয় প্রস্তাবটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। পরবর্তীতে ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে শুষ্ক মওসুমে গঙ্গার পানিকে ভারত একতরফাভাবে প্রত্যাহার করা শুরু করে। এতে করে গঙ্গা নির্ভর বাংলাদেশের সকল নদ-নদী নাব্যতা হারিয়ে ফেলে। দেখা দেয় মরুময়তা।
ফারাক্কার এই ভয়াবহতা কাটিয়ে তুলতে ১৯৮০ সালে জিয়া তালবাড়ীয়ায় এই প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। পরবর্তীতে বেশ কয়েকটি সমীক্ষার পর পাংশায় গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণের সুপারিশ করা হয়। ওই সুপারিশমালায় বলা হয়, গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে গড়াইসহ ১৬টি নদী নাব্যতা ফিরে পাবে। সেইসাথে দূর হবে এই অঞ্চলের লবণাক্ততার আগ্রাসন এবং ফিরে আসবে ফারাক্কার প্রভাবে বিনষ্ট হয়ে যাওয়া প্রাকৃতিক ভারসাম্য। গঙ্গা ব্যারেজের প্রথম সমীক্ষা চালানো হয় ১৯৬১ সালের অক্টোবরে।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ওয়াপদা মেজর প্রজেক্ট অন দ্য গ্যাঞ্জেস শীর্ষক এই সমীক্ষা চালায়। ওই সমীক্ষা রিপোর্টের ভিত্তিতে ৪ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় নির্ধারণ করে ১৯৭০ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গঙ্গা ব্যারেজের প্রাথমিক কাজের জন্য ৫ কোটি টাকা (রুপি) বরাদ্দ করেছিলেন। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের আড়াই মাইল ভাটিতে এই ব্রিজ নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল। অজ্ঞাত কারণে ১৯৭৪ সালে গঙ্গা ব্যারেজ সার্কেল গুটিয়ে ফেলা হয়।

 



 

Show all comments
  • Khalilur Rahman ১২ জুন, ২০১৬, ১:৪২ এএম says : 0
    Thank you for great news
    Total Reply(0) Reply
  • shamsulhoque ১২ জুন, ২০১৬, ৪:১৭ এএম says : 0
    please try. to be success. by diplomatic way
    Total Reply(0) Reply
  • Mohammad Faruk ১২ জুন, ২০১৬, ১:০০ পিএম says : 0
    ভারত আমাদের কেমন বন্ধু সবাই এখন দেখ
    Total Reply(0) Reply
  • গাজী সালাহ উদ্দিন ১২ জানুয়ারি, ২০১৭, ১০:১৮ এএম says : 0
    দাদাবাবুরা সাথে থাকুক আর না থাকুক, আমারা এই ব্যারেজ চাই অনাগত ভবিষ্যৎ র জন্য
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ৪০ হাজার কোটি টাকা দেবে চীন
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ