পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
ছয় বছর হলো বাবাকে দেখি না। বাবার ছবি নিয়ে ঘুরছি, বাবার সাথে বেড়াতে যেতে পারি না। বাবাকে দেখতে খুব মন চায়। আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিন। আমি বাবার সঙ্গে বেড়াতে যাব। বাবা ছাড়া আমার কিছু ভালো লাগে না। কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিলেন ২০১৩ সালে রাজধানীর বসুন্ধরা থেকে ‘গুম’ হওয়া বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের মেয়ে আফসানা ইসলাম রাইদা। রাইদা আরো বলেন, আমার বয়স যখন মাত্র ৭/৮ বছর তখন আমার বাবা গুম হয়। আমি তখন ক্লাস ফোরে পড়ি। এখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। দীর্ঘ ৬ বছর আমি বাবাকে দেখি না। বাবাকে ছাড়াই কী আমি বেঁচে থাকব? আমি আমার বাবার বুকে নিয়ে ঘুমাতে চাই।
বিভিন্ন সময়ে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক গুম দিবস উপলক্ষে গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনা অনুষ্ঠানে মাইকে যখন রাইদা তার বাবাকে ফিরে পাওয়ার করুণ আকুতি জানাচ্ছিলেন তখন তার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। তার সেই কান্নায় ভিজে যাচ্ছিল সভায় উপস্থিত সকলের হৃদয়। এ সময় কারো কারো গাল বেয়ে নোনা পানি পড়তে দেয়া যায়।
‘মায়ের ডাক’ নামে একটি সংগঠন এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। গুম হওয়া ব্যক্তিদের মায়েদের কান্নায় ভারি হয়ে উঠে জাতীয় প্রেসক্লাবের হল রুম। অনুষ্ঠানে আগতদের প্রত্যেকের একটাই আকুতি- মা-বাবা ফিরে পেতে চায় তার সন্তানকে, স্ত্রী চায় স্বামীর সন্ধান আর সন্তান চায় বাবার মুখ দেখতে। অনুষ্ঠানে আগত ছোট ছোট শিশুরা তাদের বাবার ছবি হাতে নিয়ে সরকারের কাছে আকুতি জানায় ‘বাবাকে ফিরিয়ে দাও’।
এতে গুম হওয়াদের স্বজনরা বক্তব্য তুলে ধরেন। মনে জমানো কষ্টের কথাগুলো বলেন তারা। কি হবে আর কি পাবেন সব ভুলে দীর্ঘদিনের জমানো কষ্ট ভাগাভাগি করেছেন অসহায় মানুষগুলো। সে এক অন্যরকম পরিবেশ। উপস্থিত না থেকে এ ধরনের পরিবেশ অনভুব করা বড়ই কঠিন।
সাতক্ষীরা জেলার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কুখরালি গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর রাশেদ। ২০১৬ সালের ৪ আগস্ট রাত ৯টায় তার ছেলে ডাক্তার শেখ মোখলেছুর রহমান জনিকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গ্রেফতার করেন। এর পরের কিছুদিন ছেলের খবর জানলেও পরবর্তীতে আর কোনো খোঁজ মেলেনি। সভায় আব্দুর রাশেদ বলেন, আমার ছেলেকে গ্রেফতারের পর সাতক্ষীরার কারাগারে রাখা হয়। আমি আর আমার ছেলে বউ সাতক্ষীরার কারাগারে দেখা করতে যাই। সেসময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আমাকে বলেন, তোর রেছলেকে যা বলি তা স্বীকার করতে বল। আমি আমার ছেলেকে বলি, বাবা তুমি যা জানো সব সত্য কথাই বলো। তখন পুলিশ আমাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে পিস্তল দেখিয়ে বের করে দেয়। এরপর থেকে ছেলের আর কোনো খোঁজ-খবর পাইনি। কোথায় আছে, কেমন আছে, কিছুই জানি না। এখনও আমাকে ও আমার পরিবারকে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে, ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। আমার ছেলে তার সন্তানের মুখও দেখতে পারেনি। তাই আমি সরকারের কাছে অনুরোধ করছি, আমার ছেলেকে যেন ফিরিয়ে দেয়া হয়। সে যেন তার সন্তানের মুখটা অন্তত দেখতে পারে।
তিনি বলেন, আমার ছেলে তো কোনো রাজনৈতিক দল করতো না। আমার ছেলে কোনো জঙ্গি বা সন্ত্রাসীও ছিল না। আমার ছেলে ডাক্তার। তার একটাই অপরাধ, সে গরিব, দুঃখী, অসহায় ও মেহনতি মানুষের চিকিৎসা করে বেড়াতো। আমার ছেলেকে তো গুম করা হয়েছে-ই, একইসঙ্গে তার মামলাটিও গুম করা হয়েছে।
রাজধানীর রামপুরা থেকে নিখোঁজ ছাত্রলীগ নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন তপুর মা সালেহা বেগম বলেন, আমার ছেলে তিন বছর ৭ মাস ধরে নিখোঁজ। যুবলীগের স্থানীয় নেতারা প্রশাসনকে দিয়ে আমার ছেলেকে গুম করে। আমি আমার ছেলেকে ফিরে পেতে হাজারও মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছি। সবাই শুধু আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু আজও আমি আমার ছেলেকে ফিরে পাইনি। আর কতদিন আমি ছেলের অপেক্ষায় থাকব, বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন সালেহা বেগম।
ফেনীর মাহবুবুর রহমান রিপনের মা রওশন আরা বলেন, আমার ছেলে ২০১৪ সালের মার্চের ২০ তারিখে রাতের আঁধারে আমার বাড়ি থেকে ঘরের দরজা ভেঙে কালো পোশাকধারীরা ধরে নিয়ে যায়। তারা আমার বাসা তল্লাশি করে আমার ছেলেকে ধরে নিয়ে যায়। গামছা দিয়ে তাকে পিঠমোড়া করে বেঁধে কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে নিয়ে যায়। আমার ছেলে যুবদলের রাজনীতি করত। যখন রিপনকে ধরে নিয়ে যায়, তখন তার একটি শিশু বাচ্চা রয়েছে। মামলা করতে গিয়েছি। তারা মামলাও নেয়নি। আজও আমি ছেলেকে ফেরত পাইনি। কোনো বিচারও পাইনি।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ‘মায়ের ডাক’-এর সভানেত্রী ও ২০১৩ সালে গুম হওয়া সাজেদুল ইসলাম সুমনের মা হাজেরা বেগমের বড় মেয়ে মারুফা ইসলাম ফেরদৌসী। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন ২০১৩ সালের ২৬ এপ্রিল গুম হওয়া রনি হোসেনের মা আঞ্জুমান আরা বেগম, ২০১৫ সালের ২১ আগস্ট গুম হওয়া সাজ্জাদ হোসেনের মা সাজেদা বেগম, ২০১৯ সালের ১৯ জুন গুম হওয়া ইসমাঈল হোসেনের স্ত্রী নাসরিন আক্তারসহ অনেকেইে। এছাড়া অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিনট, নাসির উদ্দিন এলান ও জোনায়েত সাকী প্রমুখ।
গুম হওয়া ব্যক্তিদের ফেরত দিন -ডা. জাফরুল্লাহ
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, বাংলাদেশে প্রতিটি গুমের বিষয়ে অবশ্যই সরকার জানেন। তার অজানা কোনো গুম নেই। একটা গুমও আল্লাহ করেননি। আল্লাহ যদি কাউকে গুম করতেন, তাহলে তিনি গুমের শিকার সেই আদম সন্তানকে অন্তত জানাজাটা করতে দিতেন। আপনার বাহিনী, ভারতের ‘র’ ও ইসরায়েলের মোসাদ যে গুম করে তা আপনি জানেন কি না, সন্দেহ।
তিনি আরো বলেন, এখনও সময় আছে অতীতের ভুলের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চান। গুম হওয়া ব্যক্তিদের তাদের পরিবারের কাছে ফেরত দিন। গুম হওয়া ব্যক্তিদের যদি তাদের পরিবারের কাছে ফেরত দিতে পারেন তাহলে পরিবারগুলো আপনাদের ক্ষমা করবে। আল্লাহ আপনাদের ক্ষমা করবে। অন্যথায় কারও কাছেই আপনারা ক্ষমা পাবেন না।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বর্তমান সরকারকে ‘হৃদয়হীন’ উল্লেখ করে বলেন, গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের কান্নায় এই সরকারের হৃদয় নড়েও না, গলেও না। এই সরকার একটি পাষন্ড সরকার। যে সরকার দেশের ১০ কোটি ভোটারের ভোট রাতের অন্ধকারে লুট করতে পারে সেই সরকারের কাছে কোনো কাকুতি-মিনতি করে লাভ হবে না। এই সরকারের জনগণের সরকার নয়। তাই এই সরকার জনগণের কথা শোনে না। এদেশে যেদিন জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে সেদিনই সকল গুম আর খুনের বিচার করা সম্ভব হবে। একটি স্বাধীন নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করে সকল গুমের তদন্ত করারও দাবি জানান তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, দেশের প্রতিটি গুমের সঙ্গে সরকার জড়িত। সরকার কোনোভাবেই এই দায় এড়াতে পারে না। সরকারের কাছে প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, সরকার যদি গুমের সঙ্গে জড়িত না-ই থাকত তাহলে কেন এতগুলো পরিবারে কান্নার শব্দ তারা শুনছে না। পরিবারগুলোর বর্ণনা দেয়া মতে প্রতিটি গুমের সময়ে সরকারি গাড়ি কিংবা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাকে বা তাদের গাড়ি ব্যবহার হল কীভাবে? এছাড়া প্রতিটি ঘটনার পরে থানাই বা সাধারণ ডায়েরি নিতে অপারগতা প্রকাশ করে কেন? সরকার যদি গুমের সঙ্গে জড়িত না-ই থাকে তাহলে স্বাধীন কমিশন গঠন করে এতগুলো গুমের ঘটনা তদন্ত করছে না কেন?
তিনি আরো বলেন, গুম একটি অপরাধ যা, হত্যা বা খুনের চেয়েও নিষ্ঠুর ও ভয়াবহ। কেননা গুম হওয়া ব্যক্তির পরিবার সারাজীবনই অবর্ণনীয় কষ্ট নিয়ে চলেন। পরিবার গুম হওয়া স্বামী কিংবা সন্তানের কোনো খোঁজ পায় না। অনেক পরিবার আছে যারা কারো কাছে কোনো অভিযোগ করবে না, শুধু লাশটি ফেরত চায় অথবা নিখোঁজ ব্যক্তির শুধু সন্ধান চায়।
ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আকমল হোসেন বলেন, আজকে এখানে আমরা সবাই কান্না শুনছি। মায়েদের কান্না শুনছি। একটা ফ্যাসিস্ট সরকার, নির্যাতক রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি। এর বিকল্প রাজনৈতিক ব্যবস্থা না এলে এ কান্না থামবে না।
জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকিম বলেন, গত কয়েক বছর ধরেই এ অনুষ্ঠানে আসি। কিন্তু আজকে অনেককেই দেখতে পাই না। কারণ তারা স্বজনদের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে পরপারে চলে গেছেন। অথচ বিচার দেখে যেতে পারেননি।
বিএনপির নিখোঁজ নেতা ইলিয়াস আলীর ছেলে আবরার ইলিয়াস বলেন, আর কত অপেক্ষা করব আমরা। আমার বাবাসহ সকল গুম ও নিখোঁজ ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দিন। বাবার জন্য মা আজ অসুস্থ হয়ে পড়ে রয়েছেন। তিনি এ অনুষ্ঠানে আসতে পারেননি। অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, প্যারিসভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটসের তথ্যানুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশে গুমের শিকার হওয়া ৫০৭ জনের মধ্যে ৬২ জনের লাশ পাওয়া গেছে। ২০১৮ সালে দৈনিক গড়ে ৮ জন মানুষ গুম হয়েছে। আর এ বছরের প্রথম তিন মাসে গুম হয়েছে ১২ জন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।