Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৮ জুন ২০২৪, ১৪ আষাঢ় ১৪৩১, ২১ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

তদন্ত সমন্বয়হীন অন্ধকারে পুলিশ

প্রকাশের সময় : ১১ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

রফিকুল ইসলাম সেলিম : চট্টগ্রামে পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যাকা-ের ছয় দিন পার হয়ে গেছে। মামলা তদন্তে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি। এখনও খুনি কারা তা চিহ্নিত হয়নি। কেন তাকে নৃশংসভাবে খুন করা হলো সে প্রশ্নেরও জবাব মেলেনি। খুনের রহস্য উদঘাটন ও খুনি চক্রের সদস্যদের চিহ্নিত করতে অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়া হচ্ছে।
আজ যাকে ধরা হচ্ছে, কাল তাকে ছেড়ে দিতে হচ্ছে। কোনো কিছু নিশ্চিত না হয়েই কর্মকর্তারা মন্তব্য করছেন। আজ যা বলছেন, কাল সেখান থেকে সরে গিয়ে বলছেন অন্য কথা। পুলিশের বিরুদ্ধে গ্রেফতার বাণিজ্যেরও অভিযোগ উঠেছে। টাকার বিনিময়ে একজনকে এই মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ডিবি পুলিশের বিরুদ্ধে।
পুলিশসহ ৫টি সংস্থা লোমহর্ষক এই খুনের ঘটনা তদন্ত করছে। তবে অভিযোগ রয়েছে তাদের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। খুনের ঘটনাটি ছিল অত্যন্ত নিখুঁত এবং ক্লুলেস। পক্ষান্তরে মামলা তদন্তে এখনও সমন্বিত কোনো তদন্ত কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে না। দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী একটি স্পর্শকাতর হত্যা মামলার তদন্ত নিয়ে এমন লেজেগোবরে অবস্থা নিকট অতীতে দেখা যায়নি।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম থেকে পদোন্নতি নিয়ে ঢাকায় বদলি হয়ে গেছেন এমন একজন পুলিশ কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, চট্টগ্রামে অসংখ্য ক্লুলেস ও চাঞ্চল্যকর মামলার রহস্য উদঘাটন করেছেন বাবুল আক্তার। অথচ আজ তার স্ত্রী হত্যা মামলা নিয়ে যা হচ্ছে তা অনাকাক্সিক্ষত। ‘এই মামলা ছাড়া আমাদের কি আর কোনো কাজ নেই?’ মামলা তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন পুলিশ কর্মকর্তার এমন প্রশ্নে খোদ সিএমপিতেই তোলপাড় চলছে। চরম অস্বস্তিতে আছেন নগর পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
নন্দিত পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু গত রোববার নগরীর জিইসি মোড়সংলগ্ন ও আর নিজাম রোডে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন। সকালে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে গেলে মোটরসাইকেলে আসা তিন যুবক কুপিয়ে ও গুলি করে তাকে হত্যা করে। ঘটনার পরপর পুলিশের পক্ষ থেকে এই খুনের জন্য জঙ্গিদের দায়ী করা হয়। ঘটনাস্থলের পাশের একটি ভবনে থাকা সিসিটিভি ফুটেজ নিয়ে শুরু হয় তদন্ত। তাতে দেখা যায় তিন যুবক মিতুকে প্রথমে কুপিয়ে ও পরে গুলি করে হত্যা করে মোটরসাইকেলে পালিয়ে যায়। ফুটেজ অস্পষ্ট হওয়ায় ওই তিন যুবককে চেনা যাচ্ছে না। অস্পষ্ট ফুটেজ ধরে শুরু হওয়ায় তদন্তই এখনও অস্পষ্ট রয়ে গেছে। দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি। খুনি চক্রের সদস্য সন্দেহে পুলিশ ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজনকে আটক করে ফের ছেড়েও দিয়েছে। খুনের পরদিন চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ হেফাজতে নেয়।
পরে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। পুলিশ কমিশনার মো. ইকবাল বাহার বলেছেন, তাদের কাছ থেকে কিছু পাওয়া যায়নি। গতকাল শুক্রবারও বায়েজিদ বোস্তামি থানার শীতলঝর্ণা এলাকা থেকে একজনকে আটক করে পাঁচলাইশ থানা পুলিশ। পরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দেওয়া হয়। মনির হোসেন নামে আরও একজনকে আটক করে তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সংস্থা। তবে তার বিষয়েও শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
গতকাল বিকেলে নগরীর জামালখান এলাকা থেকে জঙ্গি সন্দেহে এক রিকশা চালককে আটক করে পুলিশ। সেখানে মিতুর খুনিদের গ্রেফতার দাবিতে মানববন্ধন চলছিল। আর তখন রিকশা নিয়ে বারবার এলাকায় ঘুরছিল ওই যুবক। তাকে লোকজন আটক করে পুলিশে দেয়। তার আগে হত্যাকা-ে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের চালক সন্দেহে একজনকে আটক করা হয়। তাকেও গতকাল ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
হাটহাজারী থেকে আবু নসর গুন্নু নামে একজন মাজারের খাদেমকে আটক করা হয়। তাকে দশ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হয়। আদালত জানতে চান কোন তথ্যের ভিত্তিতে তাকে আটক করা হয়েছে তার প্রমাণসহ আদালতে উপস্থাপন করতে হবে। মামলার তদন্তকারী কর্মকতা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক রাকিব উদ্দিন আদালতের অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি। এ বিষয়ে আগামীকাল রোববার শুনানির দিন ধার্য করা আছে। গুন্নুকে হাটহাজারীর স্থানীয় একটি মাজারের বিরোধে একপক্ষ পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে তার পক্ষের লোকজন। তাদের দাবি পুলিশ ত্রিশ লাখ টাকার বিনিময়ে তাকে এই মামলায় ফাঁসানোর চক্রান্ত করছে। তবে পুলিশের দাবি তারা সুস্পষ্ট তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে তাকে আটক করেছে। খুনের ঘটনায় সে ওই এলাকায় থেকে খুনিদের সহযোগিতা করেছে বলেও দাবি তাদের।
ঘটনা তদন্তে পুলিশের হাতে অন্যতম ক্লু ছিল একটি কালো মাইক্রোবাস। পুলিশের দাবি সিসিটিভির ফুটেজে দেখা গেছে খুনের সময় জিইসি মোড়ের কাছে ওই মাইক্রোবাসটি দাঁড়িয়ে ছিল। হত্যাকা- শেষে সেটি খুনিদের মোটরসাইকেল অনুসরণ করে পালিয়ে যায়। মিডিয়ায় এমন খবর আসার পর ওই মাইক্রোবাসের চালক জানে আলম বুধবার রাতে মাইক্রো নিয়ে পুলিশের কাছে হাজির হন। তিনি দাবি করেন ঘটনার সময় তিনি ওই এলাকা অতিক্রম করছিলেন মাত্র। খুনের সাথে তার কোনো সর্ম্পক নেই। তারপরও পুলিশ তাকে আটকে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করে। জানা গেছে তাকেও যেকোন সময় ছেড়ে দেওয়া হবে।
বাবুল আক্তার জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বলে উগ্র জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীগুলোকেই সন্দেহের তালিকার প্রথমে রেখে শুরু থেকে তদন্ত চালিয়ে আসছে পুলিশ। পরে ওই তালিকায় শিবিরও উঠে আসে। বাদ যায়নি সোনা, মাদক ও অস্ত্র চোরাকারবারিরাও। সেই তালিকা ছোট করে আনার কাজেও তেমন কোনো অগ্রগতির তথ্য পুলিশ দিতে পারেনি।
সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অপারেশন) দেবদাস ভট্টাচার্য্য বলেন, পুলিশ সুপারের স্ত্রীর হত্যাকারীদের খুঁজতে পুলিশের সকল ইউনিট কাজ করছে। যথাযথ প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত স্পষ্ট কিছু বলা যাবে না। তিনি বলেন, বাবুল আক্তার অনেক বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন। তাদের মধ্যে অনেকেরই আন্তর্জাতিক যোগাযোগ রয়েছে। তাই সব বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
বাবুল আক্তারকে তদন্তভার দেওয়ার দাবি
সাহসী পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারকেই মাহমুদা খানম মিতু হত্যাকা-ের তদন্তভার দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন মিতু হত্যার প্রতিবাদ ও খুনিদের গ্রেফতারের দাবিতে আয়োজিত মানববন্ধনের বক্তারা। গতকাল বিকেল তিনটায় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। মিতু হত্যাকা-ের পরপরই জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ইভেন্ট খুলে এ মানববন্ধনের প্রচার চালানো হয়। কয়েকশ’ তরুণ-তরুণীসহ নানা বয়সী মানুষ মানববন্ধনে অংশ নেন। মানববন্ধন চলাকালে বক্তব্য দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগের অধ্যাপক ড. জিনবোধি ভিক্ষু, সামাজিক সংগঠন ময়ূরাক্ষীর তফজ্জল নিপু, আলো দেখাবোই’র স্বপন মোল্লা, স্বপ্ন ও আগামী’র মো. ইব্রাহিম, লিও মেহবুব আলী, ইসমাইল আজাদ, চট্টগ্রাম সাংস্কৃতিক পরিষদের এসএম ফরিদুল আলম, হৃদয়ে বায়ান্ন’র মো. মুবিন, হাটহাজারী কলেজের সাবেক ভিপি খোরশেদ আলম, জাহেদুল ইসলাম, পূর্বাশার আলো’র ফয়সাল বিন কাসেম, ডা. আরকে রুবেল, মো. নুরুল হুদা, পুলিশ পরিবারের পক্ষে তারেক আজিজ, শফিক সোহাগ প্রমুখ। সঞ্চালনায় ছিলেন মানববন্ধনের উদ্যোক্তা এহসান বিন দিদার।
বক্তারা বলেন, পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যাকা-ের পর এক সপ্তাহ হতে চলছে অথচ পুলিশ প্রকৃত খুনিদের জাতির সামনে হাজির করতে পারেনি। এ অবস্থায় এ জনপদের মানুষ বিশ্বাস করে, সাহসী পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারকেই মিতু হত্যাকা-ের তদন্তভার দিলে হত্যাকা-ের প্রকৃত রহস্য যেমন দ্রুত উন্মোচিত হবে তেমনি খুনিরাও ধরা পড়বে। তারা অবিলম্বে মিতু হত্যা মামলার তদন্তভার পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারকে দেওয়ার দাবি জানান।
জঙ্গি সন্দেহে রিকশা চালক আটক
এদিকে মানববন্ধন চলাকালে জঙ্গি সন্দেহে এক যুবককে ধরে পুলিশে সোপর্দ করেছে জনতা। ওই যুবক রিকশা চালিয়ে বেশ কয়েকবার মানববন্ধনের সামনে দিয়ে ঘোরাফেরা করছিলেন। কোতোয়ালি থানার এএসআই তোজাম্মেল হক ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ফুল প্যান্ট ও গেঞ্জি পরা ওই যুবকের পিঠে ব্যাগ ছিল। রহস্যজনক আচরণ করছিলেন ওই রিকশাচালক। এরপর স্থানীয় কয়েকজন তরুণ ওই রিকশাচালককে আটক করে টহল পুলিশের সোপর্দ করে। এ সময় ব্যাগ তল্লাশি করে পুলিশ কিছু না পেলেও রিকশার যাত্রী বসার গদির নিচে দুটি ছোরা, একটি পেন ড্রাইভ পাওয়া যায়। এ সময় ওই রিকশাচালক নিজের বাড়ি টাঙ্গাইল বলে জানালে অন্যান্য প্রশ্নের উত্তরে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলে। কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) নূর আহমদ জানান, প্রেসক্লাবের সামনে থেকে জঙ্গি সন্দেহে এক রিকশাচালককে আটক করা হয়েছে। তাকে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: তদন্ত সমন্বয়হীন অন্ধকারে পুলিশ
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ