দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ঐ আরব যা আল্লাহর ইবাদত সম্পর্কে ছিল অনভিজ্ঞ। ঐ আরব যার কপাল কখনও আল্লাহর সামনে অবনমিত হয়নি। ঐ আরব যার অন্তরে আল্লাহর উপাসনার প্রকৃত আস্বাদ মোটেই ছিল না। ঐ আরব যার রসনা আল্লাহর তাসবীহ ও প্রশংসার আস্বাদ উপলব্ধি করার সঙ্গতিহীন ছিল। ঐ আরব যার চোখের দৃষ্টিতে রাত জাগার প্রকম্পিত প্রতিফলিত হয়নি। ঐ আরব যার আত্মিক শক্তির বিকাশে আল্লাহ প্রদত্ত শান্তি ও নিরাপত্তার অনুভূতি কখনও বিকাশ লাভ করেনি। সেই আরবের লোকেরাই মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর শিক্ষা ও সাহচর্য লাভ করে মুহূর্তের মাঝে এক নতুন জীবন লাভ করেছিল। এমনি করে এক আল্লাহর ইবাদত করা এবং তাঁরই প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হিসেবে বরিত হয়। এতে করে তাদের প্রতিটি কাজের মাঝের মাঝে এখলাস ও আত্মনিবেদন ছাড়া অন্য কোনও সংস্পর্শই অবশিষ্ট ছিল না এবং তাদের অবনত মস্তক আল্লাহর সন্নিধান হতে কখনও উঠানোর প্রবণতা দেখা যেত না। তাদের মনে-মগজে আল্লাহর ও রাসূলের (সা:) প্রেম ও মহব্বত ছাড়া দুনিয়ার কোনও আশা-আকাঙ্খা লক্ষ্য করা যেত না এবং তাদের দৃষ্টি শক্তিতে আল্লাহর কুদরতের প্রাণবন্ত দৃশ্যাবলী ছাড়া অন্য কিছুই প্রতিভাত হত না এবং তাদের দৃষ্টি শক্তিতে আল্লাহর কুদরতের প্রাণবন্ত দৃশ্যাবলী ছাড়া অন্য কিছুই প্রতিভাত হত না এবং তাদের অন্তর জুড়ে বিরাজ করত আল্লাহর স্মরণ ও আল্লাহর জিকিরের শান্তিময় গুঞ্জরণ। তাদের এই অবস্থাকে কবির ভাষায় এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে: “অন্তরের নিষ্প্রাণ অভিব্যক্তির মাঝে নূর ও আলোর যে প্রাণের পরশ লেগেছে তার সংস্পর্শে প্রভাতের সুশীতল সমীরণ এবং প্রতীচ্যের দিক চক্রবালকে সুশীতল করে দিয়েছে।” মূলত : আরবদের মূল অবস্থার কথা তুলে ধরে আল-কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, “এবং যারা আল্লাহকে খুব কম স্মরণ করত।” (সূরা নিসা : রুকু-২১) কিন্তু সত্যের আহবক্ন এবং নবুওতের ফয়েজ ও বরকতের ফলে তাদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটে এবং তারা হেদায়েতের নূরের আলোকে সমুজ্জ্বল হয়ে উঠে এবং এমন এক পর্যায়ে উন্নীত হয় যাদেরকে দুনিয়ার কোনও কায়-কারবার আল্লাহর স্মরণ হতে নিবৃত্ত করতে পারে না।” (সূরা নূর : রুকু-৫) মূলত : উঠতে-বসতে, চলতে-ফিরতে সকল অবস্থায়ই আল্লাহর স্মরণে তারা ছিল বিভোর। যেমন আল-কুরআনে ঘোষিত হয়েছে, “যারা আল্লাহকে উঠতে-বসতে এবং শয়নকালে স্মরণ করে।” (সূরা আলে ইমরান : রুকু-২০)
রাত্রিকালে যখন গাফেল পৃথিবী তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, তখন সে বিছানা হতে উঠে আল্লাহর সামনে সেজদাবনত হয় এবং নিজের মনের গোপন ভেদ প্রকাশে তৎপর হয়। আল-কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, “যাদের দেহের পার্শ্বদেশ রাতের বেলা নিদ্রাচ্ছন্নতা হতে পৃথক হয়ে, ভয় এবং আশার সাথে স্বীয় প্রতিপালককে প্রণিপাত করে।” (সূরা সেজদাহ : রুজু-২) আর যাদের অবস্থা তুলে ধরে অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে “এবং যখন তাদেরকে বলা হয় যে, আল্লাহর সন্নিধানে রুকু কর, তখন তারা রুকু করে না।” (সূরা মুরসালাত : রুকু-২) সুতরাং যাদের অন্তরে এই বিরোধীতার প্রবণতা ছিল, তাদের অন্তরের অবস্থাকে আল-কুরআনে এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে, “এবং যখন তোমাদের প্রতিপালকের নাম স্মরণ করা হয়, তখন যারা আখেরাতের ওপর বিশ্বাস করে না, তাদের অন্তর বিমুখ হয়ে যায়।” (সূরা যুমার) কিন্তু সত্যাশ্রয়ী আল্লাহ প্রিয়দের অবস্থা হচ্ছে এই যে, “তোমরা তাদেরকে দেখবে যে রুকুতে অবনত, সেজদায় নিরত অবস্থায় আল।রাহর রেজামন্দি ও অনুকম্পার প্রত্যাশার উন্মুখ।” (সূরা ফাত্হ : রুকু-৪)
সুতরাং নবুওতের সূর্যের সমুজ্জ্বল কিরণ তাদের অপরিচ্ছন্ন অন্তরের আয়নাতে আল্লাহর ভয়ের এমন এক জাওহার পয়দা করে দিয়েছে যাদের সম্পর্কে আল-কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, “তারাই ঐ লোক যাদের সামনে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়, তখন তাদের অন্তরে দেখা দেয় তীব্র প্রবঞ্জন।” (সূরা হজ্জ : রুকু-৫)
কুরআনুল কারীমের এ সকল সাক্ষ্য-প্রমাণ হতে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর আমল এবং শিক্ষা আরবের রূহানী পৃথিবীতে কত বড় বিপ্লব সাধন করেছিল। যে সকল লোক ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল, চাই তারা কৃষি কাজ করুক অথবা ব্যবসা-বাণিজ্য অথবা মেহনত-মজদুরী, কিন্তুু এ সকল পেশার কোন কিছুই তাদেরকে আল্লাহর স্মরণ হতে গাফেল করতে পারত না। হযরত কাতাদাহ (রা:) বলেন, এ সকল লোক (সাহাবিগণ) ক্রয়-বিক্রয় করতেন। কিন্তু যখন আল্লাহর কোনও কাজ বা অনুষ্ঠান হাজির হত, তখন কর্মব্যস্ততা ও পেশা আল্লাহর স্মরণ হতে তাদেরকে গাফেল করতে পারত না; বরং তারা আল্লাহর নির্দেশকে পূণভাবে আদায় করতেন। হযরত ইবনে ওমর (রা:) বলেন, “একবার আমি বাজারে ছিলাম। নামাজের তাকবীর ধ্বনি হতেই সাহাবায়ে কেরাম তৎক্ষণাৎ দোকানসমূহ বন্ধ করে দিলেন এবং মসজিদে প্রবেশ করলেন।” (সহীহ বুখারী : স্থলভাগে তেজারত অধ্যায়)
সাহাবিগণের অধিকাংশই সারা রাত বিনিদ্রভাবে আল্লাহর স্মরণে নিমগ্ন থাকতেন। এমন কি মক্কা মোয়াজ্জেমার নিরাপত্তাহীন রাতগুলোতেও তারা এবাদতে ইলাহীতে নিমগ্ন থাকতেন। আল্লাহর পাক তাদের সম্পর্কেই সাক্ষ্য প্রদান করে ইরশাদ করেছেন, “আবশ্যই তোমার প্রতিপালক জানেন, তুমি দুই-তৃতীয়াংশ রাত এবং অর্ধরাত এবং এক-তৃতীয়াংশ রাতের পরে উঠে যাও এবং তোমার সাথে একটি জামায়াত শয্যা ত্যাগ করে নামাজ আদায় করে।” (সূরা মুয্যাম্মিল : রুকু-২)
ঐ সময়ে সাহাবীদের রাতের নির্জনতা ছাড়া আল্লাহ পাকের এবাদতের সুযোগ কেমন করে হত? দিদারের অনুপম রোশনাই সন্দর্শনে উন্মুখ পবিত্র সত্তাগণ দিনভর এন্তেজারের পর রাতের অন্ধকারের কোনও গোপন ঘাটিতে সমবেত হতেন। একান্ত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে নিজেদের কপালকে আল্লাহর সামনে জমীনে স্থাপন করতেন এবং দীর্ঘ সময় পর্যন্ত সেজদাবনত অবস্থায় পড়ে থাকতেন। রাসূলুল্লাহ (সা:) তাদের এহেন আন্তরিকতাপূর্ণ এবাদত প্রত্যক্ষ করতেন। কুরআনুল কারীমে এই দৃশ্যের বৈশিষ্ট্য এভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, “এবং ঐ শক্তিশালী করুণাময়ের উপর ভরসা করা, যিনি রাতে নামাজ আদায়ের জন্য তোমাদেরকে সজাগ করেন এবং সেজদাবনতদের মাঝে তোমার আসা-যাওয়া প্রত্যক্ষ করেন।” (সূরা শোয়ারা : রুকু-১১)
মদীনা মুনাওয়ারার আগমন করার র সর্বপ্রথম যে নির্দেশ রাসূলুল্লাহ (সা:) এর জবান হতে প্রচারিত হয়েছিল, তাহলো, “হে লোক সকল! দরিদ্রদেরকে আহার্য দান কর এবং একে অন্যের প্রতি সালাম সম্ভাষণ জানাও এবং ঐ সময়ে নামাজ পাঠ কর, যখন মানুষ ঘুমে অচেতন থাকে। (জামে তিরমিজী)
কোন কোন সাহাবী দৃঢ়তা সহকারে এই নির্দেশের উপর আমল করেছেন যে, তারা রাতে শয়ন করাকেই বর্জন করেছিলেন। পরিশেষে রাসূলুল্লাহ (সা:)-কে এ সকল লোকের প্রতি মধ্যম পন্থা অবলম্বন ও ভারসাম্য রক্ষার নির্দেশ দিতে হয়েছিল। হযরত ওসমান বিন মাজউন (রা:) রাতভর নামাজে নিরত থাকতেন। রাসূলুল্লাহ (সা:)-তাকে লক্ষ্য করে বললেন, “ওসমান! তোমার উপর তোমার দেহেরও হক আছে। সুতরাং নামাজও আদায় করবে এবং নিদ্রাও যাবে।” (আবু দাউদ : নামাজের ইচ্ছা অধ্যায়)
হযরত আবু হুরায়রা (রা:) রাতকে তিন ভাগে ভাগ করেছিলেন। প্রথম ভাগে তিনি নিজে নামাজ পড়তেন। দ্বিতীয় ভাগে তাঁর স্ত্রী এবং তৃতীয় ভাগে তাঁর খেদমতগারগণ নামাজ আদায় করতো। এভাবে পর্যায়ক্রমে তারা একে অন্যকে জাগিয়ে দিতেন। (সহীহ বুখারী) হযরত আবদুল্লাহ বিন আমর (রা:) সারা রাত নামাজ পড়তেন। রাসূলুল্লাহ (সা:)-এ কথা জানতে পেরে তার কাছে গমন করে তাঁকে নসিহত করলেন। (সহীহ বুখারী : কিতাবুস সাওম) হযরত আবু দারদা (রা:)-এর অবস্থাও ছিল তদ্রুপ। তিনি সারা রাত নামাজে অতিবাহিত করতেন। হযরত সালমান ফারসী (রা:) ছিলেন তাঁর ধর্মীয় ভাই। এক রাতে তিনি তাঁর গৃহে মেহমান হলেন। রাতে যখন হযরত আবু দারদা এবাদতের জন্য উঠতে চাইলেন, তখন হযরত সালমান ফারসী (রা:) তাঁকে নিষেধ করলেন। রাতের তৃতীয় প্রহরে যখন সবাই নিঝুম হয়ে পড়েছিল, তখন হযরত সালমান ফারসী (রা:) তাঁকে জাগিয়ে দিলেন এবং বললেন, এখন হচ্ছে নামাজের সময়। (সহীহ বুখারী : কিতাবুস সাওম)
এমন কোনও সাহাবী ছিলেন না, যিনি ইসলাম গ্রহণ করার পর এক ওয়াক্তের নামাজও কাযা করেছেন। এমনকি যুদ্ধের সময় এবং ঘোর সঙ্কটকালেও তাঁরা এই ফরজ হতে গাফেল থাকতেন না। একজন সাহাবীকে রাসূলুল্লাহ (সা:) কোন এক বিপদ মুহূর্তে কোথাও প্রেরণ করেছিলেন। যখন তিনি মঞ্জিলে মাকসুদের সন্নিকটে উপস্থিত হলেন, তখন আসরের ওয়াক্ত হয়ে গিয়েছিল। তিনি ভয় করছিলেন যে যদি কোথাও দাঁড়িয়ে আসর নামাজ পড়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন, তাহলে সুযোগ হাত ছাড়া হয়ে যেতে পারে। আর যদি আসরকে দেরীতে আদায় করেন, তাহলে আল্লাহর হুকুম পালনে দেরী হয়ে যাবে। এই সমস্যার সমাধান তিনি এভাবে করলেন যে, তিনি ইশারায় নামাজ আদায় করছিলেন এবং সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। (আবু দাউদ) কঠিন হতে কঠিনতর সঙ্কটকালেও তারা নামাজ তরক করতেন না। এমনকি রুগ্নাবস্থায়ও তারা অন্যের উপর ভর করে মসজিদে উপস্থিত হতেন। (নাসারী : কিতাবুল ইমামাহ)। বিশেষ করে তারা যে আন্তরিকতা, নম্রতা ও একাগ্রতার সাথে নামাজ আদায় করতেন, এর দৃশ্য খুবই প্রাণস্পর্শী ও প্রভাব বিস্তাকারী হিসেবে দেখা দিত। হযরত আবু বকর (রা:) যখন নামাজে দাঁড়াতেন, তখন এতই ভীত-বিহবল হয়ে পড়তেন যে, এ দৃশ্য কাফের মহিলা এবং শিশুদের মাঝেও প্রভাব বিস্তার করতো। (চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।