Inqilab Logo

রোববার, ১৬ জুন ২০২৪, ০২ আষাঢ় ১৪৩১, ০৯ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

অনিয়ম পিছু ছাড়ছে না টাকশালে

প্রকাশের সময় : ১০ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

হাসান সোহেল : দীর্ঘ ৮ বছর থেকে অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন কবে শেষ হচ্ছে টাকশালে জিয়াউদ্দীন আহমেদ যুগ। স্বাভাবিক চাকরির মেয়াদ শেষ হলে ২০১৪ সালের ৩ জুলাই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান। গত ৫ এপ্রিল সেই চুক্তির মেয়াদও শেষ হয়েছে। এই কর্মকর্তার চাকরির বয়স আছে মাত্র ৬ মাস। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রহর গুনছিলেন নতুন এমডি কে হচ্ছেন এই নিয়ে। কিন্তু সবকিছু উপক্ষো করে বাংলাদেশ ব্যাংকের আপত্তি সত্ত্বেও একমাত্র অর্থমন্ত্রীর সুপারিশে মাত্র ৬ মাসের জন্য পুনরায় নিয়োগ পাচ্ছেন জিয়াউদ্দীন আহমেদ। আর এই নিয়োগ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, দি সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশন (বাংলাদেশ) লি. নামে এই প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে জিয়াউদ্দিন আহমেদের চুক্তির মেয়াদ পুনরায় বৃদ্ধি করার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। যা এখন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সচিবের স্বাক্ষরের অপেক্ষায় আছে। সচিবের স্বাক্ষর হওয়ার পরই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পাঠাবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের উপ-সচিব মো. রিজওয়ানুল হুদা স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের স্মারক নং- ০৫.১৩২.০১৯ ০০,০০, ০১১, ২০১৪-৩৩৪ (২ এপ্রিল) এর উদ্ধৃতি দিয়ে গত ১৫ মে পূর্বের শর্ত অনুযায়ী আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। যে সুপারিশে ইতোমধ্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সম্মতি দিয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
রিজওয়ানুল হুদা স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, টাকশালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিয়াউদ্দিন আহমেদের বর্তমান চুক্তির মেয়াদ গত ৫ এপ্রিল শেষ হয়েছে। যা ২০১৪ সালের ৩ জুলাই সম্পাদিত চুক্তির অনুরুপ শর্তে যোগদানের তারিখ থেকে তাঁর অবসরান্তে ৩ বছরের অবশিষ্ট সময়ের জন্য অর্থাৎ আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়।
দেশের একমাত্র টাকা ছাপানোর প্রতিষ্ঠানটিতে আলোচিত জিয়াউদ্দীন আহমেদের পুনর্নিয়োগ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে চলছে নানা গুঞ্জন। একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, নানা অনিয়ম, আর্থিক কেলেঙ্কারী ও অফিসের গেস্ট হাউজে কুকুর পালনের মতো ন্যাক্করজনক ঘটনার অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র অর্থমন্ত্রীর ইচ্ছায় আবারো বিতর্কিত এই কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এই কর্মকর্তার নিয়োগ যাতে না হয় সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আগেই আপত্তি দেয়া হয়েছিল।
সূত্র মতে, ২০০৮ সালে টাকশালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেন জিয়াউদ্দীন আহমেদ। ২০১৪ সালে সরকারি চাকরির বয়স শেষ হলে তিনি এলপিআরে চলে যান। পরে তাকে ২ বছরের জন্য আবারো চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। সম্প্রতি ওই চুক্তির মেয়াদও শেষ হয়। একাধারে দীর্ঘ ৮ বছর দায়িত্ব পালন করে প্রতিষ্ঠানটিতে স্বেচ্ছাচারিতার অভয়ারণ্য তৈরি করেছেন। প্রতিষ্ঠানটিকে কব্জায় নিতে নিজস্ব বলয় তৈরি করে তাদেরকে দিয়ে সবকিছু পরিচালনা করতেন। তাদের বিরুদ্ধে বলার মতো কারো সাহস না থাকায় চাকরির ভয়ে মুখ বুজে সব কিছু সহ্য করতেন কর্মকর্তারা। সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরদের (ডিজি) চুক্তিভিত্তিক বয়সসীমা ৬২ বছর। জিয়াউদ্দীন আহমেদ একজন নির্বাহী পরিচালক পর্যায়ের কর্মকর্তা। যা ডিজিদের চেয়ে এক গ্রেড নিচে। স্বাভাবিকভাবে এই পদে নিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা ডিজিদের অপেক্ষা বেশী হওয়া কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। সূত্র মতে, ইতোমধ্যে জিয়াউদ্দীন আহমেদের বয়স ৬১ বছর ৫ মাস। ৬২ বছর হতে আর মাত্র ৭ মাস বাকী। এই কর্মকর্তার বিপক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকের আপত্তি উপেক্ষা করে বাকী ৭ মাসের জন্য পুনরায় নিয়োগের সিদ্ধান্ত হবে আত্মঘাতী। অথচ ৭ মাস পর আবার নতুন করে অন্য কাউকে এই পদে নিয়োগ দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, জিয়াউদ্দিন আহমেদকে নতুন করে নিয়োগ দেয়া হবে সরকারের একটি চরম ভুল। অত্যন্ত সংবেদনশীল ও স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠানের প্রধান নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারকে আরও সাবধানী হওয়া অত্যাবশ্যক। এরূপ সিদ্ধান্ত নেয়া হলে দেশের ইতিহাসে স্বল্প মেয়াদের চুক্তিভিত্তি নিয়োগে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হবে। তাদের মতে, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত কার স্বার্থে এই ধরনের জনস্বার্থ বিরোধী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তা বোধগম্য নয়।
টাকশাল নামে পরিচিত এই প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনস্থ। প্রতিষ্ঠানটিতে দীর্ঘদিন থেকে অনিয়ম যেন কোনভাবে পিছু ছাড়ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দেয়া অভিযোগ থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশ বিভিন্ন ব্যাংক নোট তৈরির মেশিন ক্রয়ে বড় ধরনের অনিয়ম নিয়ে এখনো দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান চলছে। এমআইসিআর মেশিন মেরামতের নামে প্রায় কোটি টাকার পার্টস আমদানি দেখিয়ে ভুয়া বিল উঠানো, ১০ লাখ টাকার দুটি রোটারী নাম্বারিং মেশিন ৬০ লাখ টাকা করে ক্রয়, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গ্রাফিক এসোসিয়েটসের সাথে যোগসাজশ করে ২৫/৩০ লাখ টাকার একটি কাটিং ফিনিশিং মেশিন ক্রয় করা হয় ২ কোটি টাকার দিয়ে; বোর্ড সদস্যদের ভুয়া কাগজপত্রাদি দেখিয়ে ৫০/৬০ লাখ টাকার কম্ব পারফরেটিং মেশিন ক্রয় করা হয়েছে ৩ কোটি টাকা দিয়ে। একই সঙ্গে অবৈধ সুবিধা নিয়ে ২০০৩ সালে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকে রাখা দি সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশনের ৩ কোটি টাকার এফডিআর’র তথ্য গোপন করা হয়। ব্যাংকটি অন্য নামে চালু থাকলেও বিনা সুদে এখনও ব্যাংকে টাকাটা ফেলে রাখা হয়েছে। অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে বোর্ড সদস্যরা কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে তৃতীয় কোন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নেয়ার কথা বললেও জিয়াউদ্দীন আহমেদ বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তায় করা হবে এবং সব কিছু ঠিক থাকবে উল্লেখ করে বোর্ডকে বুঝিয়ে নিজ ইচ্ছেমতো নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন। এসবেই শেষ নয়; দশ টাকা মূল্যমানের নোটের ইন্টেগলিও প্রিন্ট পুনরায় চালু করে অর্থনৈতিক ক্ষতি এবং ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কমিশন খাওয়ার অভিযোগ রয়েছে জিয়াউদ্দীন আহমেদের বিরুদ্ধে। সূত্র মতে, নকল প্রতিরোধে উচ্চমূল্যমানের নোটে অফস্টে প্রিন্ট ও ইন্টেগলিও প্রিন্ট করা হয়। কিন্তু দশ টাকার নোট নিম্ন মূল্যমানের এবং এটি নকল হওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় সাবেক ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসাদুজ্জামান খান বোর্ডের অনুমতি নিয়ে অতিরিক্ত খরচ বাঁচাতে ইন্টেগলিও প্রিন্ট বাদ দেন। অথচ জিয়াউদ্দীন আহমেদ এসে ইন্টেগলিও প্রিন্ট চালু করেন। যার মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বড় ধরনের কমিশন গ্রহণ করেন।
এদিকে রিসার্চ ও কোয়ালিটি কন্ট্রোল শাখার কালি-কাগজের মান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে রসায়নে উচ্চ ডিগ্রীধারী ৩ কর্মকর্তাকে সরিয়ে মানবিক শাখায় পাশ করা নিজের লোককে দিয়েই নিম্নমানের কাগজ-কালির মান নির্ণয় করিয়ে নিয়েছেন। একই সঙ্গে মহাহিসাব নিরীক্ষক দপ্তর থেকে আসা বিভিন্নœ অনিয়মের অডিট আপত্তি মিটানো হয় ঘুষ দিয়ে। যাও আবার কমকর্তা-কর্মচারীদের শিক্ষা সহায়তা তহবিলের টাকা থেকে কর্তন করে। এছাড়াও জিয়াউদ্দীন আহমেদের বিরুদ্ধে কর্পোরেশনের বৃক্ষ নিধন, নিজে এবং আত্মীয়-স্বজনকে প্রদান করে লেকের মাছ হরিলুট, দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করা শ্রমিকদের হাজিরা দেখিয়ে টাকা আত্মসাৎসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে।
জিয়াউদ্দীন আহমেদ বিভিন্ন অনিয়মে ব্যস্ত থাকায় প্রতিষ্ঠানের সঠিক তদারকিতে ছেদ পড়ে। আর তাই প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনেও ধসে নামে। অথচ গত এক বছরেই প্রতিষ্ঠানটিতে শতাধিক লোক নিয়োগ ও কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে নতুন মেশিন ক্রয় এবং মেরামত করা হয়। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৯-১০ অর্থ বছরে ব্যাংক নোট উৎপাদন করা হয় ১২৫৫ দশমিক ৭১ মিলিয়ন, যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরে কমে ১০৭৭ দশমিক ৪৪৯ মিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। সর্বশেষ চলতি অর্থবছরের (২০১৫-১৬) প্রথম ১০ মাসে তৈরি নোটের পরিমাণ আরও কমে দাঁড়িয়েছে ৭৪১ দশমিক ২৬৫ মিলিয়নে।                     
সূত্র মতে, এসব অনিয়ম ঢাকতে আরও কিছু সময় দরকার হওয়ায় অর্থমন্ত্রীকে অনুরোধ করে আবারো নিয়োগ পাওয়ার পাঁয়তারা করেন জিয়াউদ্দীন আহমেদ। আর তাই এসব অনিয়মরে সুরহা না করেই পুনরায় এই বিতর্কিত ব্যবস্থাপনা পরিচালককেই নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।
টাকশালের সদ্য বিদায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিয়াউদ্দীন আহমেদ ইনকিলাবকে বলেন, পুনর্নিয়োগের বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। এমনকি এ সম্পর্কে আমার সাথে কেউ যোগাযোগও করেনি। তবে কিছু কর্মকর্তা আমাকে ফোন করে বলে ‘স্যার আপনিই হচ্ছেন এমডি’। তাদেরকে আমি বলেছি, এ সম্পর্কে কিছুই জানি না। চাকরির বয়সের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৬/৭ মাস আছে চাকরির বয়স। তারপরও সরকার দায়িত্ব দিলে বা যোগ্য মনে করলে আমি দায়িত্ব পালন করবো। অনিয়মের বিষয়ে তিনি বলেন, দুদকে তদান্তাধীন বিষয়টি সুরহা হয়ে গেছে। অন্যান্য অনিয়মের বিষয়ে তিনি বলেন, একটি গোষ্ঠী তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: অনিয়ম পিছু ছাড়ছে না টাকশালে
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ