Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিয়ন্ত্রণহীন হত্যাকান্ড

প্রকাশের সময় : ৯ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বিশেষ সংবাদদাতা : সারাদেশে একের পর এক হত্যাকান্ড ঘটেই চলছে। এসব হত্যাকান্ডের কোনো কূল-কিনারা হচ্ছে না। গতকাল বুধবারও এর ব্যতিক্রম ছিল না। টাঙ্গাইলে এক অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। চট্টগ্রামে ময়লার ডাম্পিং স্টেশন থেকে উদ্ধার হয়েছে এক নারীর পাঁচ টুকরা লাশ।
দিনাজপুরে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে এক যুবককে। বুড়ীগঙ্গা থেকে উদ্ধার হয়েছে এক নারীর লাশ। যশোর ও বগুড়ায় বন্দুকযুদ্ধে দু’জন নিহত হয়েছে। এর আগে গত তিনদিনে ৯টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী ছাড়াও হিন্দু পুরোহিত, খ্রিস্টান ব্যবসায়ী খুন হওয়ার ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে। একটা খুনের রহস্য উদঘাটন হওয়ার আগেই ঘটে যাচ্ছে আরেকটি। র‌্যাব পুলিশ আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। কিছুদিন আগে এভাবে যখন একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটছিল, তখনও খুনের প্রধান কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল ইসলাম ধর্ম নিয়ে ব্লগে লেখালেখি করায় উগ্রবাদী জঙ্গীরা এসব ঘটাচ্ছে। কিন্তু মন্দিরের পুরোহিত, খ্রিস্টান ব্যবসায়ী, পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী, অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক যে খুন হচ্ছেন তার দায় কার? সরকারের পক্ষ থেকে এসব খুনের ঘটনাকে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র হিসাবে দাবি করা হচ্ছে।
পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে দেশে খুন হয়েছে ১হাজার ৫৬৭। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ২৬৭, ফেব্রুয়ারিতে ২৯১, মার্চে ৩০৭, এপ্রিলে ২৯১ ও মে মাসে ৪২০ জন। এতে দেখা যায়, বছরের প্রথম মাসের চেয়ে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও পঞ্চম মাসে পর্যায়ক্রমে খুনের মাত্রা বেড়েই আসছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার পরিসংখ্যানে চলতি বছরের বিগত পাঁচ মাসে খুনের সংখ্যা ২ হাজারের বেশি হবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০১০ সালে সারাদেশে ৩ হাজার ৯৮৮ জন, ২০১১ সালে ৩ হাজার ৯৬৬ জন, ২০১২ সালে ৪ হাজার ১১৪ জন, ২০১৩ সালে ৪ হাজার ৩৯৩ জন ও ২০১৪ সালে ৪ হাজার ৫১৪ জন খুন হয়েছে। এই হিসাবে সারাদেশে প্রতিদিন গড়ে ১৪-১৫ জন খুন হচ্ছে। আলাপকালে পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ১৬ কোটি মানুষের দেশে খুন হতেই পারে। কিন্তু এখন যা হচ্ছে তা পরিকল্পিত। টার্গেট করে খুনের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। গত বছর ঢাকার গুলশানে ইতালীর নাগরিক তাভেল্লা দিয়ে শুরু হয়েছে। এই টার্গেট করে খুনের ঘটনা বের করা কষ্টকর। একটা ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে আরেকটা ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। এটাকে কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এসব হত্যাকা-ের ক্ষেত্রে আবার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হত্যার দায় স্বীকার করে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস (ইসলামিক স্টেট) বার্তা দিচ্ছে। একটি সাইটে প্রচার করা হচ্ছে। এদিকে, এসব হত্যাকা-ের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এটি দেশ ও সরকারের বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র। এসব ঘটনায় দেশী-বিদেশী চক্র জড়িত। শুরু থেকেই সরকারের পক্ষ থেকে হত্যাকা-ের বিষয়ে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ আছে বলে দাবি করা হলেও পরে ধীরে ধীরে তা ফিকে হয়ে যায়।
চট্টগ্রামে পুলিশের এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু খুন হওয়ার দিনেই সিএমপি কমিশনার স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আজ রাতের মধ্যেই একটা সুখবর দিতে পারবো। তিন দিন পর তাঁর মুখেই শোনা গেল, তদন্তের তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। আলোচিত হত্যাকা-ের পর সরকারের পক্ষ থেকেই দাবি করা হয়, এ বিষয়ে অনেক তথ্যই সরকারের হাতে রয়েছে। অথচ তাদের নাম-ধাম যেমন প্রকাশ করা হয় না, তেমনি ধরাও হয় না। এসব কারণেই এ ধরনের চাঞ্চল্যকর হত্যাকা-ে যাদের মাঝেমধ্যে ধরে রিমান্ডে আনা হয় তারা আদৌ প্রকৃত খুনি কিনা তা নিয়েও জনমনে যথেষ্ট সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষ কেউ আর নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারছেন না। সবার মধ্যে এক ধরনের আতংক বিরাজ করছে। ঢাকার বেশ কয়েকজন বাসিন্দা তাদের শঙ্কা ও ভয়ের কথা জানিয়েছেন। মিরপুর ৬নং সেকশনের বাসিন্দা মাহবুবুর রহমান বলেন, যেভাবে একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটছে তাতে কখন যে কে খুন হবে তা কেউ বলতে পারে না। আমরা সাধারণ মানুষ এ নিয়ে শঙ্কিত হবো এটাই স্বাভাবিক। তিনি বলেন, এসব খুনাখুনির ঘটনার বাইরে আমরা দখলদার, চাঁদাবাজি, জুলমবাজদের মধ্যে বসবাস করছি। ঈদকে সামনে রেখে চাঁদাবাজি শুরু হয়েছে। কে কখন টার্গেট করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করবে-তা কেউ জানে না। যাত্রাবাড়ীর দনিয়া এলাকার ব্যবসায়ী শামীম বলেন, এভাবে আর কতোদিন? যেখানে একজন এসপির স্ত্রী সন্তান নিরাপদ নয় সেখানে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কোথায়। রামপুরা বনশ্রী এলাকার বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী সারোয়ার মুর্শেদ বলেন, খুব আতঙ্কের মধ্যে আছি। এভাবে চলতে থাকলে মানুষ কিভাবে ব্যবসা করবে, কিভাবে ঘর থেকে বের হবে। মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি দিতে না পারলে এর দায় দায়িত্ব সরকারকেই বহন করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, বাংলাদেশে জঙ্গি আছে এটি প্রমাণ করার জন্য দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র চলছে। এর অংশ হিসেবে এসব হত্যাকা- ঘটানো হচ্ছে। কারা কোন ঘটনা ঘটিয়েছে সেটা আমরা সুনির্দিষ্টভাবে আরও কিছুদিন পরে বলতে পারব। তবে আমরা হত্যার কৌশল ও সার্বিক বিবেচনায় মনে করছি, এসব হত্যাকা-ে জঙ্গিরা জড়িত। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু গত মঙ্গলবার বিবিসিকে বলেন, গোপন সংগঠনগুলো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। নরম লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়ে তারা বোঝাতে চাইছে সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। গুপ্তহত্যা ঠেকানো দুরূহ কাজ উল্লেখ করে তথ্যমন্ত্রী বলেন, এজন্য সরকারবিরোধীরা দায়ী। সাবেক আইজিপি এমএ কাইয়ুম মনে করেন, দেশে গণতন্ত্র না থাকলে, জঙ্গিবিরোধী কর্মকা-ে সবাইকে সম্পৃক্ত করা না গেলে সন্ত্রাস দমনে ফলপ্রসূ রেজাল্ট পাওয়া যাবে না। দেশে গণতন্ত্রের সুবাতাস বইতে হবে। গণতন্ত্র না থাকলে অপশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নিয়ন্ত্রণহীন হত্যাকান্ড
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ