Inqilab Logo

বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ০১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৬ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

বিতর্কিত নির্বাচনের পর পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে

ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বাংলাদেশ নিয়ে বিতর্ক

প্রকাশের সময় : ৯ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্টাফ রিপোর্টার : ইউরোপীয় কমিশনের (ইসি) ভাইস প্রেসিডেন্ট ও নেদারল্যান্ডসের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বার্ট কোয়েনডার্স বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে গঠনমূলক সংলাপে অংশ নিয়ে দেশের স্থিতিশীলতা, গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
স্থানীয় সময় বুধবার (বাংলাদেশ সময় গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২টা ৩ মিনিটে শুরু হয় শুনানি)। ইউরোপীয় পার্লামেন্টে (ইপি) বাংলাদেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার সূচনা বক্তব্যে কোয়েন্ডার্স এসব কথা বলেন। তিনি বাংলাদেশের সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গঠনমূলক সংলাপের তাগিদ দিয়ে বলেন, এখনই এই সংলাপ হওয়া দরকার।
সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া হত্যাকা-গুলো সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করে ডাচ এই রাজনীতিবিদ বলেন, বাংলাদেশে সামগ্রিকভাবে একটি নতুন রাজনৈতিক ও সামাজিক ঐকমত্য দরকার, যাতে করে দেশটিতে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা সংরক্ষিত হবে। কোয়েন্ডার্স বলেন, নির্বিচারে গ্রেপ্তার এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের হয়রানি এখনই বন্ধ করা প্রয়োজন। সহনশীলতার চর্চা ও রাজনৈতিক মতপার্থক্য নিয়ে বিতর্কের পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া নৃশংস হত্যাকা-ের তদন্ত করতে হবে এবং যারা এসব ভয়াবহ হামলার সঙ্গে জড়িত, তাদের খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
বাংলাদেশের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে কোয়েন্ডার্স বলেন, ইইউ বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি সমুন্নত দেখতে চায়। বাংলাদেশের সব নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তার ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, দেশটির বর্তমান পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে ইইউ। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে নিয়মিত সংলাপের মাধ্যমে তাঁরা তাদের পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যাবেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে ভালো স¤পর্ক রয়েছে, বিশেষ করে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও উন্নয়ন নিয়ে। বাংলাদেশের উন্নয়নে ইইউ সহায়তা অব্যাহত রেখেছে। এ স¤পর্ক বিস্তৃত হয়েছে। তবে দেশটির উদ্বেগজনক রাজনৈতিক পরিস্থিতি উন্নয়নের অন্তরায়। ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পর পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া ও দারিদ্র্য দূরীকরণের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রাজনৈতিক ঐকমত্য দরকার।
পার্লামেন্টের মানবাধিকার বিষয়ক সাব কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ক্রিশ্চিয়ান ড্যান প্রেদা বলেন, আমি গত কয়েক সপ্তাহের সহিংসতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। এসবে আক্রান্ত হচ্ছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি ও মত প্রকাশের পক্ষের লোকেরা। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের এসব ঘটনার তদন্ত করার আহ্বান জানাতে তিনি পার্লামেন্টকে বলেন। তিনি আরও বলেন, বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনের পর, বাংলাদেশের অনেক আর্থ-সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি হয়। সেখানে আমরা নির্বাচনী প্রতিনিধিদল পাঠাই। নির্বাচন বয়কটের ফলে বড় ধরনের রাজনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, আমরা স্বীকার করি যে, বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অংশীদার। এটা আমরা ভুলতে পারি না। আমাদের ঢাকার আংশীদারদের সঙ্গে কথা বলা উচিত। রাজনৈতিক পরিস্থিতি উন্নয়নে তাদেরকে আহ্বান জানানো উচিত।
ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বিষয়ক প্রতিনিধিদলের ভাইস চেয়ার নিলা গিল বলেন, অন্তত ১০ জন সেক্যুলার অ্যাক্টিভিস্টকে হত্যা করা হয়েছে ঠা-া মাথায়। এসব হামলার দায় আল কায়দা ও আইসিস স্বীকার করলেও, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ নিয়মিতভাবে এসব গোষ্ঠীর অবস্থান অস্বীকার করে যাচ্ছে। ঝুঁকির মুখে থাকা মানুষদের সুরক্ষা দেয়ার পরিবর্তে, সরকার এসব নৃশংস হত্যাকা-গুলোকে নির্বাচনী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশকে সহিংসতায় নিমজ্জিত হতে দিতে পারি না। তিনি সুপারিশ করেন, সহিংসতা ও উগ্রপন্থা প্রতিরোধে ভারতকে সেতুবন্ধন হিসেবে ব্যবহার করে আমাদের প্রকল্প হাতে নেয়া প্রয়োজন। এর ফলে দেশটিকে উগ্রপন্থার আঞ্চলিক শক্তঘাঁটিতে পরিণত হওয়া ঠেকানো প্রতিহত করা যাবে। দ্বিতীয়ত, চলমান ও একাত্তরের অপরাধের জন্য সরকার ও বিরোধী উভয় পক্ষকে প্রকৃত জবাবদিহিতার আওতায় আসতে হবে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ও বাছবিচারহীন হত্যাকা- বন্ধ করতে হবে।
পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির সদস্য চার্লস ট্যানক মন্তব্য করেন, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির পেছনে সরকার নয়, দায়ী কট্টরপন্থীরা। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের উচিত সমালোচনা কম করে, সহযোগিতা বেশি করা।
ম্যারিয়েট শাকে বলেন, জনগণকে রক্ষার জন্য সরকারের সাধ্যমত সবকিছু করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পার্লামেন্টকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ইস্যুতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নেতৃত্ব যথেষ্ট বলিষ্ঠ ছিল না। ইইউ এ নিয়ে যথেষ্ট বক্তব্য রাখেনি বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তিনি প্রশ্ন রাখেন, কেন আমরা বাংলাদেশ ইস্যুতে পর্যাপ্ত বিবৃতি দেখিনি?
কট্টরপন্থীদের হাতে সাম্প্রতিক হত্যাকা- ও পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রীকে হত্যার কথা উল্লেখ করে দক্ষিণ এশিয়া দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বিষয়ক প্রতিনিধিদলের চেয়ার জ্যঁ ল্যাম্বার্ট বলেন, শক্তিশালী সুশীল সমাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানবাধিকার সুরক্ষাকারী সংগঠনগুলোর ওপর নিপীড়নের কথা বলতে গিয়ে তিনি অধিকার-এর প্রসঙ্গ টানেন। গণমাধ্যম স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে তিনি মন্তব্য করেন, অনেক বেশি সাংবাদিককে কারাগারে যেতে দেখছি আমরা। বক্তব্যের শেষে তিনি বলেন, আমাদেরকে যেমন বাংলাদেশ সরকারকে সহযোগিতা করে যেতে হবে, তেমনি এটাও নিশ্চিত করতে হবে যে, তাদের পদক্ষেপ যেন জনগণের সর্বোত্তম স্বার্থে নেয়া হয়।
উন্নয়ন বিষয়ক কমিটির সদস্য লোলা সানচেজ ক্যালডেন্টি ও এসিপি ইউ জয়েন্ট পার্লামেন্টারি অ্যাসেমব্লি ডেলিগেশনের ভাইস চেয়ার ফার্নান্দো রুয়াসের বক্তব্যে রানা প্লাজা ট্রাজেডির কথা উঠে আসে। সাস্টেইনবিলিটি ক¤প্যাক্টের অধীনে বাংলাদেশ সরকার বেশ কিছু অগ্রগতি করলেও, এখনও অনেক কিছু করা বাকি বলে রুয়াস মন্তব্য করেন। লোলা সানচেজ বলেন, বাংলাদেশের মানবাধিকার উন্নয়নে আমাদের অনেক কিছু করার আছে।
পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির সদস্য ফ্যাবিও ম্যাসিমো ক্যাস্টাল্ডো বলেন, আমরা সহিংসতা বৃদ্ধি প্রত্যক্ষ করছি, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। মানবাধিকার বিষয়ক সাব কমিটির সদস্য জোসেফ ওয়াইডেনহোলজার বলেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বিপজ্জনক গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনাও নাকচ করে দেয়া যায় না। রাজনৈতিক দুই শিবির একে অপরের বিরুদ্ধে লড়ছে। এর ফলে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান পঙ্গু হয়ে পড়েছে। সহিংসতা বাড়ছে। অন্যরা আছে যারা এ পরিস্থিতির সুযোগ নিতে সচেষ্ট। মানবাধিকার রক্ষকদের প্রতি আচরণ খারাপ হচ্ছে। তাদেরকে ভয় দেখানো হচ্ছে, হুমকি দেয়া হচ্ছে। এখনও এসব বন্ধ করা সম্ভব। ইউরোপ এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটি ও মানবাধিকার বিষয়ক সাবকমিটির সদস্য আমজাদ বশির বলেন, সাম্প্রতিক সহিংসতা বাংলাদেশের দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ইতিহাসের কথা মনে করিয়ে দেয়। আমরা অবশ্যই একটি সার্বভৌম দেশের নিজস্ব ব্যাপারে নাক গলাতে পারি না। কিন্তু সহিংসতাকে নিন্দা জানানো ও রাজনৈতিক সংলাপের জন্য উৎসাহিত করার দায়িত্ব আমাদের রয়েছে। বাংলাদেশকে সঠিক পথে ফেরার বাস্তবসম্মত উপায় হলো, দেশটির নেতৃস্থানীয় দলগুলোকে সত্যিকারের নেতৃত্ব দেখাতে হবে যাতে করে দেশটিকে বিপজ্জনক পরিস্থিতি থেকে বের করে আনা যায়। তিনি বলেন, যত দ্রুত সম্ভব তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনই পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের একমাত্র উপায়।
বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে আরও বক্তব্য রাখেন পররাষ্ট্র ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির সদস্য হিল্ডে ভটম্যানস, পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির সদস্য মার্ক দেমেসমেকার, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিষয়ক কমিটির সদস্য মারিয়া অ্যারেনা, পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির সদস্য বাস বেল্ডার, পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির সদস্য এদুয়ার্দ কুকান, পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটি ও মানবাধিকার বিষয়ক সাবকমিটির সদস্য পিয়ের অ্যান্টোনিও পাঞ্জেরি, এম্পøয়মেন্ট ও সোশাল অ্যাফেয়ার্স বিষয়ক কমিটির সদস্য অ্যাগনেস ইয়োঙ্গেরিয়াস।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিতর্কিত নির্বাচনের পর পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ