স্বতন্ত্র উৎসব ঈদ
এল ঈদুল ফিতর, এল ঈদ ঈদ ঈদসারা বছর যে ঈদের আশায় ছিল নাক’ নিদ। হ্যাঁ, সুদীর্ঘ
ইসলামী জীবন বিধানে ‘কোরবানি’ একটি মহান ইবাদত। হযরত ইবরাহিম আ. ও তাঁর পুত্র হযরত ইসমাঈল আ.-এর মহান আত্মত্যাগের অনন্য নজির হলো এ ‘পশু কোরবানি’। কোরবান বা কোরবানি শব্দের অর্থ উৎসর্গ বা ত্যাগ। আরবি বর্ষপঞ্জিকার সর্বশেষ মাস ‘জিলহাজ্জ’-এর ১০ তারিখ ঈদুল আজহার দিন ও তার পরবর্তী তিন দিন আল্লাহর উদ্দেশ্যে যে পশু যবেহ করা হয় তাকে কোরবানি বলা হয়। ঈদুল আজহার প্রধান কাজ হচ্ছে ঈদের নামাজ আদায়ের পর আল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু কোরবানি করা। কোরবানি শুধু একটা আনন্দ উৎসবই নয়, এটা ইসলামের অন্যতম একটি নিদর্শন এবং আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশ্যে বিশেষ ইবাদত ও তাঁর সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্য লাভের মাধ্যম। আল কুরআনের বিভিন্ন স্থানে জীবন-মৃত্যু, নামাজসহ অন্যান্য ইবাদতের মতো বিশেষ দিনে পশু জবেহকেও রাব্বুল আলামিনের উদ্দেশ্যেই সম্পাদন করার নির্দেশনা দিয়ে ‘কোরবানির’ তাৎপর্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। আল-কুরআনে ইরশাদ করা হয়েছে, “আপনি বলুন আমার নামাজ, আমার কোরবানি এবং আমার জীবন ও মরণ বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহরই জন্য।” (আনয়াম : ১৬২)।
মানবসৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশ্যে কোরবানি প্রথা চালু হয় এবং আল্লাহ তায়ালা মানব বংশবিস্তারের জন্য হযরত আদম আ.-এর সন্তানদের জন্য ‘বিবাহের’ বিশেষ বিধান জারি করেন। কিন্তু হযরত আদম আ.-এর পুত্র কাবিল সে বিধান লঙ্ঘন করতে চাইলে তাঁর দুই পুত্রের মাঝে মতবিরোধ দেখা দেয় এবং তাদের মতভেদ দূর করার জন্য আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিজ নিজ কোরবানি পেশ করেন। ঐ সময় কোরবানি গৃহীত হওয়ার একটি সুস্পষ্ট নিদর্শন ছিল এই যে, আকাশ থেকে আগুন এসে কোরবানিকে ভস্মীভূত করে দিত। যে কোরবানিকে আগুন ভস্মীভূত করত না, তাকে প্রত্যাখ্যাত মনে করা হতো। হাবিল ভেড়া, দুম্বা ইত্যাদি পালন করত, সে একটি উৎকৃষ্ট দুম্বা কোরবানি করল। কাবিল কৃষিকাজ করত, সে কিছু শস্য, গম ইত্যাদি কোরবানির জন্য পেশ করল। আকাশ থেকে আগুন এসে হাবিলের কোরবানিটি ভস্মীভূত করে দিলো এবং কাবিলের কোরবানি জমিনেই পড়ে রইল। আল্লাহ তায়ালার দরবারে এভাবেই মুত্তাকিদের কোরবানি কবুল হয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করছেন, “আর তাদের কাছে সঠিকভাবে বর্ণনা করো দুই আদম সন্তানের কাহিনী, কেমন করে তারা উভয়ে কোরবানি করেছিল, কিন্তু তা কবুল হলো তাদের একজনের কাছ থেকে। অপরজনের কাছ থেকে তা গৃহীত হলো না। সে বলল, ‘অবশ্যই আমি তোমাকে হত্যা করব।’ অন্যজন বলল, ‘আল্লাহ তো কেবল মুত্তাকিদের পক্ষ হতে কবুল করেন।” (মায়িদা : ২৭)।
মহান আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক জাতির জন্য কোরবানির বিধান নির্ধারণ করেছেন। এ ত্যাগের মাধ্যমে মানবজাতি আল্লাহর একত্ববাদের স্বীকৃতি প্রদান করে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আত্মিক পরিশুদ্ধতা অর্জন করে এবং মনের পশুত্বকে দমন করে তাঁর নৈকট্য লাভ করে থাকে। আল কুরআনে এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হচ্ছে, “আমি প্রত্যেক জাতির জন্য আমরা কোরবানির বিধান দিয়েছে, যাতে তারা আল্লাহর দেয়া চতুষ্পদ জন্তু যবেহ করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। অতএব, তোমাদের আল্লাহ তো একমাত্র আল্লাহ। সুতরাং তাঁরই আজ্ঞাধীন থাকো এবং বিনয়ীগণকে সুসংবাদ দাও। (সূরা হাজ্জ-৩৪)। জাহেলি যুগেও কাফির-মুশরিকরা তাদের মূর্তির নামে পশু কোরবানি করত এবং কোরবানির পশুর গোশত মূর্তির সামনে রাখত ও তার রক্ত মূর্তির ওপর ছিটিয়ে দিত। কিন্তু ইসলামের বিধান হলো একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যেই এবং তাঁর নামেই কোরবানি করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টিকর্তা ও রিজিকদাতা, তিনি কোনো কিছুর মুখাপেক্ষী নন। কোরবানিকৃত পশুর গোশত বা রক্ত তাঁর প্রয়োজন নেই। মূলত এ কোরবানির দ্বারা আল্লাহর একত্ববাদ ও সকল কিছুর একচ্ছত্র মালিকানা প্রতিষ্ঠা ও প্রচার করা হয় এবং শুধু কোরবানিদাতার তাকওয়া ও পরহেজগারিতাই তাঁর কাছে পৌঁছায়। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, “এগুলোর (কোরবানির পশুর) গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, কিন্তু পৌঁছে তাঁর কাছে তোমাদের মনের তাকওয়া। এমনিভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের বশ করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা আল্লাহর মহত্ত¡ ঘোষণা করো এ কারণে যে, তিনি তোমাদের পথ প্রদর্শন করেছেন। সুতরাং সৎকর্মশীলদের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন।”(সূরা হাজ্জ-৩৭)। এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে, “আল্লাহ তায়ালা না তোমাদের আকৃতির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন আর না তোমাদের মালের প্রতি তাকান, বরং তোমাদের অন্তর আমলসমূহের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন।” (মুসলিম : ২৫৬৪)।
মহান আল্লাহ তায়ালা হযরত ইবরাহিম আ. ও তাঁর পুত্র ইসমাঈল আ.-এর মাধ্যমে মানবজাতিকে চতুষ্পদ জন্তু কোরবানির বিধান দেন। পিতা-পুত্র উভয়েই আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ ও ধৈর্যশীলতার মাধ্যমে সুস্পষ্ট কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। চতুষ্পদ জন্তু কোরবানি মূলত একটি প্রতীকী কোরবানি, যার মাধ্যমে মানবজাতি আল্লাহর একত্ববাদের বিধান বাস্তবায়ন করে নিজেকে আল্লাহর ইচ্ছার সামনে সমর্পণ করার মাধ্যমে সৎকর্মশীল বান্দাহ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। এ প্রসঙ্গে আল-কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, “অতঃপর যখন তার ছেলে তার সাথে চলাফেরা করার মতো বয়সে উপনীত হলো তখন ইবরাহিম বলল, হে প্রিয় বৎস, আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে আমি যবেহ করছি, অতএব তোমার কী অভিমত? পুত্র বলল : হে আমার পিতা, আপনাকে যে আদেশ করা হয়েছে তা বাস্তবায়ন করুন। ইনশা আল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। অতঃপর যখন তারা উভয়েই আত্মসমর্পণ করল এবং ইবরাহিম তার পুত্রকে কাত করে শুইয়ে দিলো তখন আমি তাকে আহ্বান করে বললাম, যে ইবরাহিম, তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছ- এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই এটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আর আমি তাকে মুক্ত করলাম এক মহান যবেহের বিনিময়ে।” (আস-সাফফাত-১০২-১০৭)।
ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম হজ। হাজের মৌসুমে যারা হজ ও ওমরাহ একসাথে আদায় করে তাদের আল্লাহর শুকরিয়াস্বরূপ চতুষ্পদ জন্তু কোরবানি করতে হয়। আল-কুরআনে কোরবানির এ পশুগুলোকে ‘আল্লাহর বিশেষ চিহ্ন বা নিদর্শন’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হজের বিভিন্ন বিধিবিধান ইহরাম পরিধান করা মাথা মুন্ডন করা; ও বিভিন্ন স্থান কা‘বা, সাফা-মারওয়া পাহাড়, মিনা, আরাফা, মুযদালেফার মতো ‘কোরবানির এ পশু’ও ইসলামের অন্যতম নিদর্শন। আল-কুরআনে এ পশুকে ‘হাদী’, ‘বুদন’ ও তার বিশেষ চিহ্নকে ‘কালাঈদ’ বলে উল্লেখ করে তাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। হজে ‘পশু কোরবানি’ এতটাই গুরুত্ব বহন করে যে, কোনো কারণে পশু কোরবানি করতে না পারলে পরিবর্তে রোজা ব্রত পালনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
মানবজাতির মতো এ পশু আল্লাহর বিশেষ সৃষ্টি এবং এ সৃষ্টির মাধ্যমে তারা দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ ও আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে থাকে। ইসলামী বিধানে পশুর সকল অধিকার সংরক্ষণ করে যবেহের সময় তাদের প্রতি অমানবিক আচরণ বর্জন করে ‘ইহসান’ করতে বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত শাদ্দাদ ইবনে আস রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন : আমি আল্লাহর রাসূল সা.-কে বলতে শুনেছি : আল্লাহ তায়ালা সকল বস্তুর ওপর ইহসান ফরজ করেছেন। অতএব, যখন তোমরা হত্যা করবে, তখন উত্তম পন্থায় হত্যা করবে আর যখন যবেহ করবে, তখন উত্তম পন্থায় যবেহ করবে। আর তোমাদের প্রত্যেকেরই ছুরিতে ধার দিয়ে নেয়া উচিত এবং যবেহকৃত জন্তুকে ঠান্ডা হতে দেওয়া উচিত (নাসায়ী)।
তাই আসুন, ইসলামের বিধানানুযায়ী ‘পশু কোরবানি’ করে আল্লাহর একত্ববাদ ও শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করি এবং এ মহান ইবাদতের মাধ্যমে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।