Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ছেলেটি পি মিয়িন্ট

অনুবাদ : হোসেন মাহমুদ | প্রকাশের সময় : ১০ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০২ এএম

বাস থেকে যখন নামলাম, তখন রাত সাড়ে নটা বেজে গেছে। অন্ধকারের মধ্যে রিকশাস্ট্যান্ডের দিকে হাঁটতে শুরু করি।
একজন রিকশাওয়ালাকে পেয়ে গেলাম। সে বলল-
ঃ আপনি রিকশায় উঠে বসুন। একট ুদেরী করুন। আমি আরেকজন যাত্রী পাই কি না দেখি।
তার কথায় রাজি হলাম। আমি যদি একা রিকশা নিয়ে যাই তাহলে ভাড়া লাগবে আট কিয়াত। আর একজন সহযাত্রী পেলে লাগবে পাঁচ কিয়াত। বাস ও রিকশা মিলিয়ে রোজকার ভাড়া কম লাগে না। একজন সাথে গেলে যদি তিন কিয়াত বেঁচে যায়, মন্দ কি?
রিকশাওয়ালা বয়সে কিশোরই বলা চলে। সে চিৎকার করে যাত্রী ডাকতে লাগল-
ঃ আসুন, আর একজন মাত্র, আসুন।
আমি তার দিকে চেয়ে থাকি। আমার স্কুলে পড়া ছেলেরই সমবয়সী হবে সে। তবে আমার ছেলের মত তার স্বাস্থ্য ভালো নয়। একটা সাদা ছেঁড়া জামা তার গায়ে। বাহুর কাছে খানিকটা অংশ উন্মুক্ত হয়ে আছে। যে কোনো লোকের কাছেই তার দরিদ্রাবস্থা ধরা পড়বে, কিন্তু তাকে কোনো নিচু ঘরের ছেলে মনে হয় না।
আমি ভাবতে থাকি, ছেলেটা রিকশা চালানোর কাজ করে কেন? হতে পারে তার বাবা-মা গরিব হয়ে পড়েছে। কিন্তু কিভাবে? তার বাবা কি চাকুরি হারিয়েছে? নাকি মারা গেছে? তার মা কি বেঁচে আছে? পরিবারের লোক সংখ্যা কত? সে কি সবার বড়? আহা! এ বয়সেই কি তার উপর সংসার চালানোর দায়িত্ব এসে পড়েছে?
নিজের ছেলের কথা ভাবতে থাকি। আমার মনে আবেগ উথলে ওঠে। এ যদি আমার ছেলে হত? আমার যদি কিছু হয় আমার ছেলের কি উপায় হবে? এ ছেলেটি এখনো বড় ও শক্তিমান হয়ে ওঠেনি। কিন্তু তাকে রিকশা চালাতে হচ্ছে। তার মা কি করে সহ্য করছে?
ছেলেটির রিকশায় উঠে নিজেকে অপরাধী মনে হয়। আমার নিজের ওজন অনেক। আমাকে নিয়ে রিকশা চালাতেই তার কষ্ট হবে। এখন আরেকজন যাত্রী নিলে সে রিকশা চালাতে পারবে কিনা সন্দেহ। বিশেষ করে কিছুটা গেলে একটু উঁচু পথ আছে। তা বেয়ে সে উঠতে পারবে কি?
ছেলেটি তখনো চিৎকার করে একজন যাত্রী ডাকছে। আমি তাকে বললাম-
ঃ ঠিক আছে, বাদ দাও। আমি একাই যাব।
সে আমার দিকে তাকায়। তারপর কথা না বলে রিকশায় উঠে চাপ দেয় প্যাডেলে । তাড়াহুড়ো না করে শান্ত ভাবে রিকশা চালাতে থাকে সে। বোঝা যায়, রিকশা চালানোর ব্যাপারে সে অভ্যস্ত।
খারাপ না, ভাবতে থাকি আমি। বয়সের তুলনায় তাকে বেশী পরিণত মনে হয়। ভালো, খুবই ভালো। সব কিছুকে মেনে নেয়ার সাহস যাদের আছে তাদের আমি পছন্দ করি। ছেলেটাকে আমার ভালো লেগে যায়। তার কথা জানতে ইচ্ছে করে। জিজ্ঞেস করি-
ঃ কতদিন থেকে রিকশা চালাচ্ছ?
ঃ বছর খানেক।
ঃ তোমাকে আগে দেখিনি। অবশ্য এত বেশী লোক রিকশা চালায় যে সবাইকে চেনাও সম্ভব নয়। তাছাড়া আমি রোজ রিকশা নেইও না। যেদিন ফিরতে বেশী রাত হয়ে যায়, সেদিনই শুধু রিকশা নেই।
রাস্তার সেই উঁচু জায়গা এসে যায়। সে দ্রæত প্যাডেল ঘোরাতে থাকে যাতে রিকশা সহজে উঠতে পারে।
রিকশাটার যন্ত্রপাতি ভালো আছে মনে হল। বেশী পুরনো হলে গতি মন্থর হয়ে যায়। কিন্তু এটা স্বচ্ছন্দে চলছে। ছেলেটি কোনো কষ্ট ছাড়াই উঁচু জায়গা পেরিয়ে আসে।
মনে মনে ছেলেটির প্রশংসা করতে থাকি। সে খুবই ভালো ছেলে। এ বয়সে শুধু সংসার প্রতিপালনই করছে না, জীবিকা অর্জনের সহায়ক এ রিকশাটিকেও যত্ম করে ঠিক রেখেছে। আমার মনে প্রশ্ন জাগে, এটা কি তার নিজের রিকশা না কি ভাড়ায় চালায়?
মনে মনে আশা করতে থাকি, এটা যেন তার নিজের রিকশা হয়। জিজ্ঞেস করি-
ঃ এটা কি তোমার নিজের রিকশা?
ছেলেটি ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে দেখে। হয়ত আমার আগ্রহটা বুঝতে পারে। সংক্ষেপে বলে-
ঃ হ্যাঁ।
তার জন্য আমার কষ্ট হয়। তার তো এ বয়সে লেখাপড়া করার কথা। সে যদি কঠোর পরিশ্রম করেও পড়াটা চালিয়ে যেতে পারত!
ঃ তুমি কি পড়াশোনা কর? কোন ক্লাসে? ঃ এবার ম্যাট্রিক পাশ করেছি।
এবার আমার বিস্মিত হওয়ার পালা-
ঃ তাই! তা রেজাল্ট কেমন?
সে বলে-
ঃ চারটি বিষয়ে লেটার পেয়েছি।
আমি বলে উঠি-
ঃ বল কি? এত ভালো রেজাল্ট করেও তুমি রিকশা চালাও? কেন, তুমি কি আর পড়াশোনা চালাতে পারছ না? কথা-বার্তায় তো তোমাকে বেশ বুদ্ধিমান মনে হচ্ছে।
ছেলেটি হাসে। বলে-
ঃ আমি সব সময় রিকশা চালাই না। এটা আমাদের নিজের রিকশা। কখনো মন চাইলে রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। এটা আসলে আমার ব্যায়াম। যেহেতু খেলাধুলা আমার ভালো লাগে না, তাই এটাই আমার শরীর ঠিক রাখার উপায়।
ঃ তাহলে এটা তোমাদের পরিবারের রিকশা, তাই না?
ছেলেটি রিকশার গতি কমায়। সম্ভবত তার মনে হয় যে আমার জিজ্ঞাসার প্রেক্ষিতে তার কিছু ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন। সে বলতে থাকে-
ঃ আঙ্কেল! এটা আসলে আমার নিজের রিকশা। আমার আরো চারটি রিকশা আছে যেগুলো ভাড়া দেয়া। যারা ভাড়া নিয়েছে সবাই অল্পবয়সী। তারা এ থেকে যে আয় করে তা দিয়ে পড়াশোনার খরচ চালায়। তাদের কেউ কখনো অসুস্থ হয়ে পড়লে আমি সে রিকশা চালাই। আমি তাদের সবাইকে ভালো করে চিনি। আমাকে ধোঁকা দেয়া সহজ নয়। এই রিকশা চালিয়ে বহু মানুষের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে, আমি মানুষ চিনতে শিখেছি।
তার কথা শুনে নিজেকে বোকা মনে হয়। তার সম্পর্কে আমি যা ভেবেছিলাম সে মোটেও তা নয়। আমি তার দিকে তাকাই। এখন যেন মনে হয় তাকে আমি চিনি। আগে যেন কোথায় তাকে দেখেছি।
ঃ আচ্ছা, তুমি কোথায় থাক?
সে হেসে জবাব দেয়-
ঃ বড় বাজারের কাছে, গুডউইল স্টোরে।
সাথে সাথে আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। গুডউইল স্টোর একটি পরিবারের মালিকানাধীন মার্কেট যেখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি দোকান। পরিবারের সদস্যরাই সেগুলো চালায়। তাদের সবাই এ ছেলেটির মতই সম্পদশালী। সেখানে আছে একটি রেস্তোরাঁ, একটি মিনি সুপার মার্কেট, চা ও স্ল্যাক্স বিক্রির দোকান, একটি ভিডিও ভাড়া দেয়ার দোকান এবং একটি ফটো কপির দোকান। আমি তার সম্পর্কে মারাত্মক ভুল ধারণা করেছিলাম। যাহোক, ধৈর্য না হারিয়ে তাকে প্রশ্ন করে চলি।
ঃ তোমরা কয় ভাই-বোন?
ঃ পাঁচজন। আমি সবার ছোট। আমার বড় ভাই বাবা-মার সাথে রেস্তোরাঁয় কাজ করে। ওটা হল আমাদের মূল পারিবারিক ব্যবসা। অন্য দোকানগুলো করা হয়েছে আমরা বড় হওয়ার পর। সুপারমার্কেটটা আমাদের বড় বোনের। ভিডিও শপ মেজো ভাইয়ের। চায়ের দোকান আমার আরেক বোনের। আর আমি চালাই ফটোকপির দোকান। তবে ছোটবেলা থেকেই রিকশাগুলো আমার।
আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করি-
ঃ ছোটবেলা থেকেই ওগুলো তোমার। তার মানে তুমি কি এখন আর ছোট নও?
সে হেসে বলে-
ঃ এটাই সত্য আঙ্কেল। দশ বছর বয়সে আমি প্রথম রিকশা কিনি।
মনে হল, আমি যেন পেটে একটা ঘুঁষি খেলাম।
আমি একজন লেখক। শিক্ষা ও অর্থনীতি, কঠোর পরিশ্রমের প্রয়োজনীয়তা, অগ্রগতি লাভ, ভালো ব্যবসার কৌশল প্রভৃতি বিষয় নিয়ে বহু বছর ধরে লিখে আসছি। শত শত প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছি যার কোনো কোনোটির ভিত্তি আন্তর্জাতিক সাময়িকী ও সংবাদপত্র। আমি চেয়েছি আমাদের তরুণ প্রজন্ম এগুলো শিখুক। এখন এই ছেলেটির কথা শুনে আমি বিস্মিত। নিজেকে আমার অপদস্থ বলে মনে হচ্ছে । আরো মনে হচ্ছে, ছেলেটি অবশ্যই গোপনে আমাকে উপহাস করছে।
বাড়ির গেটে পৌঁছে গিয়েছিল রিকশা। বলি-
ঃ বাছা, রিকশা রাখ। এসে গেছি।
পকেটে হাত দিয়ে দেখি দশ কিয়াতের একটি নোট রয়েছে। তাকে বলি-
ঃ আমার কাছে ভাংতি নেই। তুমি এটা রাখ। বাকিটা দিতে হবে না।
ঃ না, না, তাই কি হয়। দাঁড়ান দেখছি।
সে পকেট হাতড়ে একটি দুই কিয়াতের নোট বের করে এনে আমার হাতে দেয়। মুহূর্তের জন্য তাকায় আমার দিকে। বলে-
ঃ কিছু মনে করবেন না আঙ্কেল। আপনি আমার ব্যাপারে আগ্রহ বোধ করেছেন। তাই বলা দরকার যে আমি যখন রিকশা চালাই বা আমার ফটোকপির দোকানে কাজ করি , সব সময়ই ন্যায্য প্রাপ্যটাই নেই। ইচ্ছে করে বা ভুল করেও কখনো বেশি টাকা নেই না। এমনকি কেউ বখশিস দিলেও নেই না।
একই ভাবে আমি কখনোই পাওনার চেয়ে বেশি কখনোই কাউকে দেই না, একটি কিয়াত বা এটি পায়াও নয়। আপনি তো সেই প্রবাদটির কথা জানেনঃ তুমি এক কিয়াতের যত্ম কর, হাজার হাজার কিয়াত তোমার যত্ম করবে। আমি এটা মেনে চলি।
এই ছেলেটি খুব সহজে ও ভদ্রভাবে আমাকে একটি শিক্ষা দিল। আমি তাতে খুশিই হয়েছি। বলি-
ঃ ঠিক আছে, তোমার কথা মানছি। তুমি অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছেলে। শুভরাত্রি। তুমি এখন বাড়ি ফিরে যাবে তো?
ঃ না আঙ্কেল। এখনো আরেকটি ট্রিপ দেয়ার মত যথেষ্ট সময় আছে। আপনি তো জানেন, রোদের সময়ই খড় শুকাতে হয়।
সে রিকশাস্ট্যান্ডের দিকে রওনা হয়।
আমি মনে মনে বলিঃ তোমরা তরুণরা রিকশা চালাও, ব্যাংক স্থাপন কর, ব্যবসা সম্প্রসারিত কর, চিন্তা ও পরিকল্পনা কর, রোদের সময় খড় শুকাও, বিত্তবান হও, সমৃদ্ধি লাভ কর এবং এগিয়ে যাও।
বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করি। আমার ছেলে এখন বইয়ের উপর ঝুঁকে আছে। আমি কি তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেব ও রিকশা চালানো শুরু করতে বলব? আমার স্ত্রীকে কি শুধু ঘরের বৌ হয়ে না থেকে একটি নুডলস বা চায়ের দোকান খোলার হুকুম দেব? কিছু একটা অবশ্যই করতে হবে।
কিন্তু আমি যে এসব করব, এগুলো যদি আমার বিপক্ষে চলে যায়? আমি যেন কল্পনার চোখে দেখতে পেলাম যে আমি প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় মাতাল হয়ে যাতে বাড়ি না ফিরি সে জন্য আমার স্ত্রী চিৎকার করে চলেছে। সুতরাং আমার চিন্তার রাশ টেনে ধরি। বাড়ি ফেরার সময় আজ আমার জীবনের যে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেল সে ব্যাপারে কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে চুপচাপ ঘরে ঢুকে যাই।
*মিয়ানমারের লেখক ও রাজনীতিক পি মিয়িন্ট ১৯৪৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন চিকিৎসক ও ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত এ পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। পরে তিনি পুরোদস্তুর রাজনীতিক হয়ে ওঠেন। বর্তমানে তিনি দেশের তথ্যমন্ত্রী। পি মিয়িন্ট আগে মিয়ানমার প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এবং দি পিপলস এজ জার্নালের প্রধান সম্পাদক ছিলেন। ফিকশন, ননফিকশন ও অনুবাদ মিলিয়ে তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৭টি। তার এ গল্পটি ১৯৯১ সালে ইন খন পিয়িন্ট সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়। পরে এটি ‘এজ ওল্ড ডিফারেন্সেস’ নামে ইংরেজিতে অনূদিত হয় ও তার গল্প সংকলন লু থোন পায়িট সি ইয়াং থু মায়ার ( ভোগ্য পণ্যের ব্যবসায়ীরা ও অন্যান্য গল্প) গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়। গ্রন্থটি ১৯৯৫ সালে মিয়ানমারের জাতীয় সাহিত্য পুরস্কার লাভ করে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন