Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শাহবাগে ছিনতাইকারী ও মাদকসেবীদের আস্তানা

প্রকাশের সময় : ৩০ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

উমর ফারুক আলহাদী : রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম এলাকা শাহাবাগ মোড়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল, বারডেম হাসপাতাল, জাতীয় যাদুকর, পাবলিক লাইব্রেরী, চারুকলা ইনস্টিটিউট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের এ স্থানটিতে নানা কারণে লোকজনের যাতায়াত বেশী থাকে। কিন্তু এখন ওই এলাকাটি ছিনতাইকারী ও মাদকসেবীদের নিরাপদ আস্তানায় পরিণত হয়েছে। শাহবাগ থানার পাশেই এ মোড়ে প্রতিদিনই ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ছেন নগরবাসী। শিশুপার্ক ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এবং রমনাপার্কে দিনভর মাদকসেবী ও ছিনতাইকারীদের জমজমাট আড্ডা থাকে। সন্ধ্যা হওয়ার পর পরই তারা নেমে পড়ে ছিনতাইয়ে। এলাকার ব্যবসায়ীরা এদের নাম দিয়েছেন “টানাপার্টি”, আবার কেউ কেউ বলেন “সন্ধ্যাপার্টি”। এদের দৌরাত্ম্য এখন অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। পুলিশের সামনেই ঘটছে ছিনতাই। পথচারীদের মোবাইল ফোনসেট, মহিলাদের গলার স্বর্ণের চেইন, ব্যানেটিব্যাগ, কানেরদুল এবং ম্যানিব্যাগ ছিনিয়ে নিচ্ছে প্রতিনিয়ত। তারপরেও কোন প্রতিকার নেই। বিশেষ করে মোড়ের দক্ষিণ পাশে ফুলের দোকানের সামনে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পূবালী ব্যাংকের কাছের সড়কে এ চক্র সন্ধ্যা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত তৎপর থাকে। এ অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে গতকাল শাহবাগ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবু বক্কর ইনকিলাবকে বলেন, গত দুইদিন আগে একজন ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমরা নিয়মিত এদের আটকের চেষ্টা করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, যাকে আমরা গ্রেফতার করেছি, প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে সে ও তার সহযোগিরা রমনাপার্কে দিনভর থাকে। সময় ও সুযোগ বুঝে মোড়ে এসে ছিনতাই করে। তিনি বলেন, সোহরাওয়ার্দী পার্কে এখন ছিনতাইকারী মাদকসেবী নেই, পুলিশের অভিযানের কারণে সেখান থেকে এখন এরা পালিয়েছে। তিনি আরো বলেন, কেউ এ ধরনের অভিযোগ করলে অবশ্যই তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ রকম ঘটনার শিকার হয়েছে- এমন তথ্য পেলেও সুনির্দিষ্টভাবে কেউ লিখিত অভিযোগ করেন না। কেউ করলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হয়।
সরেজমিন দেখা গেছে, মাদক সেবনকারীরা সারাদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও রমনাপার্কের ভেতরে থাকলেও সন্ধ্যার পর তারা শাহবাগ মোড়ে বাসস্ট্যান্ডসহ চারপাশে অবস্থান নেয়। পূবালী ব্যাংকের সামনে, বারডেম হাসপাতালের সামনে, ফুল মার্কেটের সামনে ও ওষুধ মার্কেটের সামনে ফুটপাতে ঘোরাফেরা করে। তারা নারীদের টার্গেট করে এবং সাফল্যের সঙ্গে ছিনতাই করে সরে যায়।
সন্ধ্যাপার্টি শাহবাগ এলাকায় টানাপার্টি নামেও পরিচিত। যে কোন দিকে দৌড়ানোর সুযোগ থাকায়, মানুষের ভিড় থাকায় এবং রাস্তায় সার্বক্ষণিক যানজট লেগে থাকায় টানাপার্টির সদস্যরা ছিনতাই করে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে।
বিভিন্ন সূত্র জানায়, সন্ধ্যাপার্টি বা টানাপার্টির ৩০ থেকে ৩৫টি চক্রের দুই শতাধিক মাদকসেবী ও ছিনতাইকারী দিনে রাতে ওই এলাকায় সক্রিয় থাকে। এরা কখনো শাহবাগ মোড়ে কখনো পার্কে আবার কখনো শিশুপার্কের আশপাশেই ঘুরা ফেরা করে। মাদকাসক্ত একটি সংঘবদ্ধ চক্র সন্ধ্যার পর পুরো শাহবাগ মোড় নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে প্রতিদিনই এ কাজ করে যাচ্ছে বলে আশপাশের লোকজন অভিযোগ করেছেন।
স্থানীয় দোকানীরা জানান, “ছিনতাইর ঘটনা দিনের পর দিন চলে আসছে। এখানে কখন ছিনতাই হয় তা বুঝা সম্ভব নয়। ঘটনার পর ভুক্তভোগীদের চিৎকার ও কান্নাকাটি শুনে বাঝা যায় “কাম” হয়ে গেছে।” দোকানের লোকজন জানান, অনেক সময় দেখা গেছে পুলিশ ফুটপাতের চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছেন, এমন সময় ছিনতাই হয়ে গেছে। তারা বলেন, মোড় ঘেঁষেই রয়েছে শাহবাগ থানা এবং মোড়েই রয়েছে পুলিশ বক্স। উল্লেখ করার মতো পুলিশ সদস্য সার্বক্ষণিক সেখানে থাকে। পুলিশের উপস্থিতি সত্ত্বেও সন্ধ্যার পর টানাপার্টির এ দৌরাত্ম থেমে নেই। সচেতন মানুষের মাঝে এ নিয়ে নানা প্রশ্নের জন্ম দেখা দিয়েছে।
গত ১৭ জানুয়ারি সাজেদা বেগম (৪৫) নামের এক মহিলা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে এসেছিলেন ছোট বোনকে দেখতে। রাত সাড়ে ৮টার দিকে শাহবাগ মোড়ে পূবালী ব্যাংকের সামনে আসা মাত্র কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই একজন তার কানের দুল টেনে নিয়ে যায়। কানের লতি ছিড়ে গেলে কান থেকে ফোটা ফোটা হয়ে রক্ত ঝড়তে থাকে। পরে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়।
একই দিন প্রায় একঘণ্টা পর ফুলের মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা শিউলী আক্তারের (৩২) কানেরও দুলও একইভাবে নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। এই চক্রটি পরিচিত সন্ধ্যাপার্টি নামে। শাহবাগ মোড়ে প্রতিদিনই নানা বয়সী মহিলা ও তরুণীরা এভাবে সন্ধ্যাপার্টির খপ্পরে পড়ছেন। এই ‘পার্টিম্যানরা’ কানেরদুল, হাতেরবালা, আংটি, মোবাইল ফোন, ভ্যানিটিব্যাগ ও জিনিষপত্র ছিনতাই করে নিয়ে যাচ্ছে।
বংশালের বাসিন্দা সাজেদা বলেন, ‘সঙ্গে তার বোনরাও ছিল। ছিনতাইকারীরা দুলটি এমনভাবে নিয়ে যায় যে, কেউ ধারণাও করতে পারেনি। দুল না হয় গেলো কিন্তু শারীরিক যে ক্ষতি হয় তার কি হবে? শরীর থেকে অনেক রক্ত গেছে।’
আর শিশুপার্কে মেয়েদের নিয়ে বেড়াতে এসে একই ধরনের পরিস্থিতির শিকার হন মোহাম্মদপুর গজমহলের বাসিন্দা শিউলী। তার বাম কান থেকে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার টাকা মূল্যের দুলটি নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) একটি সূত্র বলছে, গত মঙ্গলবার রাত সোয়া ৭টার দিকে মিরপুর বাংলা কলেজের একছাত্রী তার বন্ধুকে নিয়ে শাহবাগে রাস্ত পার হচ্ছিলেন। সন্ধ্যাপার্টির এক সদস্য তার ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে মুহূর্তের মধ্যে চলে যায়। ব্যাগটি এমনভাবে ছো মেরে নেয়া হয় যে, এর ফিতা দিয়ে ছাত্রীর হাতের বেশ কিছু অংশ ছিলে যায়। পরে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা দেয়া হয়।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, প্রায় প্রায়দিনই এ ধরনের রোগী হাসপাতালে আসে। সাধারণত সন্ধ্যার পরই তাদের দেখা যায়। এরা সবাই নারী এবং বেশিরভাগই শাহবাগ মোড়ে সন্ধ্যা পার্টির হাতে জিনিস খোয়ানোর সময় নানাভাবে জখম হয়ে চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে আসেন। সবাই প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে চলে যান। কেউ বিষয়টি পুলিশকে জানানোর প্রয়োজন অনুভব করেন না।
তবে থানার একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদককে জানায়, যারা একটু সচেতন বা ওপর মহলে লোকজন আছে কেবল ওই ভুক্তভোগীরাই থানায় আসেন এ ধরনের অভিযোগ করতে। বেশিরভাগই আসেন না। কেননা, তদন্ত করে সন্ধ্যা পার্টির সদস্যদের পাওয়া যায় না। কেউই তাদের ব্যাপারে সঠিক তথ্য দিতে পারে না। মূলত এ কারণে পুলিশ এ ধরনের ঘটনার তদন্তের ব্যাপারে তেমন গুরুত্ব দেয় না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শাহবাগে ছিনতাইকারী ও মাদকসেবীদের আস্তানা
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ