Inqilab Logo

শুক্রবার ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১, ২৮ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

তিন দিনে ৯ খুন জনমনে উদ্বেগ উৎকন্ঠা

প্রকাশের সময় : ৮ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৪৪ পিএম, ৭ জুন, ২০১৬

উমর ফারুক আলহাদী : প্রকাশ্যে দিবালোকে কুপিয়ে, গুলি করে খুন। কর্মস্থলে কিংবা বাসায় গিয়ে গলা কেটে হত্যা। বাসা থেকে তুলে নেয়ার পর কথিত “বন্ধুক যুদ্ধের” নামে বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-। কোনটাই থেমে নেই। পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। গত ৩ দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৯ জনকে গলা কেটে, কুপিয়ে, গুলি করে এবং শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। গতকাল রাজধানী ও রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বন্ধুকযুদ্ধে ৪ জন নিহত হয়েছে। এসব ঘটনায় জনমনে ছড়িয়ে পড়ছে নানা উদ্বেগ-উৎকন্ঠা এবং আতঙ্ক। আইন-শৃংখলার ঘটছে চরম অবনতি। ফলে ঘরে বাইরে কোথাও নিরাপত্তা নেই মানুষের। এমনটিই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, একটি হত্যাকা-ের কূল-কিনারা হতে না হতেই ঘটছে আরো একটি হত্যাকা-। প্রকাশ্য দিবালোকে ধারালো চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ও গুলি করে ফিল্মি স্টাইলে হত্যা করা হচ্ছে নাগরিকদের। থামানো যাচ্ছে না মৃত্যুর মিছিল। দুর্বৃত্তরা নতুন পদ্ধতিতে খুনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। অথচ সরকার ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, দেশের আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি ভাল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, এসব চাঞ্চল্যকর হত্যাকা-ের পেছনে বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থা ও দেশের বিশেষ মহলের মদদ রয়েছে।
অন্যদিকে, মানবাধিকার সংগঠনের নেতা-কর্মী, বিশিষ্ট আইনজীবী এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞরা এ জন্য সরকার ও আইন-শৃংখলা বাহিনীর চরম ব্যর্থতাকেই দায়ী করছেন। তাঁরা বলছেন, একের পর এক ভয়ঙ্কর হত্যাকা- ঘটছে, কিন্তু তাদের শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে পারেনি আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা। বরং অনেক সময় ঢালাওভাবে দায়সারা মন্তব্য করা হচ্ছে। ফলে আড়ালেই থেকে যাচ্ছে খুনীরা। র‌্যাব-পুলিশকে চ্যালেঞ্জ করে খুনীচক্র ক্রমাগত অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠছে। এমন মন্তব্য করেছেন মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবীরা। সর্বশেষ পুলিশ সুপার বাবুল আকতারের স্ত্রী হত্যার ঘটনায় র‌্যাব-পুলিশ একটু নড়েচড়ে বসেছে। তবে সেই সাথে আবারো শুরু হয়েছে বন্দুক যুদ্ধের নামে বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-।
গত রোববার প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশ সুপার বাবুল আকতারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে চট্টগ্রামে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। একই দিনে উত্তরায় নিজ বাসায় গলা কেটে হত্যা করা হয় মনোয়ারা সুলতানা নামে এক সেনা কর্মকর্তার মা’কে। ঝিনাইদহে পৃথক ঘটনায় সোম ও মঙ্গলবারে এক হিন্দু পুরোহিতসহ গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে ৫ জনকে। ঘটনার পর জড়িতদের গ্রেফতারের বিষয়টি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এসব হত্যাকা-ের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ষড়যন্ত্রে এসব টার্গেট কিলিং হচ্ছে। এগুলো বন্ধ করতে সরকার সব ধরনের কাজ করে যাচ্ছে। গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রী বলেন, পুলিশের মনোবল যাতে নষ্ট হয়, সে জন্য জঙ্গিরা এসপি বাবুল আকতারের স্ত্রীকে হত্যা করেছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে সম্প্রতি একের পর এক হত্যাকা-ের সঙ্গে ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সম্পৃক্ততার ইঙ্গিত করেছেন। তিনি বলেন, এরই মধ্যে বাইরের একটি গোয়েন্দা সংস্থা এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এসব হত্যাকা-ের জন্য তিনি বিরোধী রাজনৈতিক দলকেও দায়ী করেন। তিনি মনে করেন, এ জন্য বিএনপি ও জামায়াত-শিবির দায়ী।
গতকাল মঙ্গলবার ভোর সোয়া ৪টায় রাজধানীর পল্লবীর কালশী এলাকায় ডিএমপির গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য বিভাগ (ডিবি) ও সিটি পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ তারেক হোসেন ওরফে মিলু (৩২) ও সুলতান মাহামুদ ওরফে কামাল (৪৫) নামের দুইজন নিহত হয়েছেন। নিহত তারেকের গ্রামের বাড়ী জয়পুরহাট। সুলতান মাহমুদের গ্রামের বাড়ী দিনাজপুর।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটি) অতিরিক্ত কমিশনার মো. মনিরুল ইসলাম বলেছেন, নিহত তারেক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর রেজাউল করিমকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। সরাসরি ওই ঘটনার নেতৃত্বেও ছিলেন তারেক। সুলতান মাহমুদ ওরফে কামাল বগুড়া শিয়া মসজিদে গুলি চালিয়ে একজনকে হত্যা করেছিল। মনিরুল ইসলাম বলেন, নিহতরা নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সদস্য বলে আমরা জানতে পেরেছি। জেএমবি’র সদস্যরা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্নস্থানে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। আমরা জানতে পেরেছি একটি ছোট গ্রুপ আবার রাজধানীতে এসে আশ্রয় নিয়েছে। ডিবি ও সিটি ইউনিটের সদস্যরা সেখানে গেলে তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে জঙ্গিরা। আত্মরক্ষার্থে পুলিশও পাল্টা গুলি ছোঁড়ে। গুলি বিনিময়ের একপর্যায়ে ওই দুই জেএমবি সদস্য গুলিবিদ্ধ হয়। আহতাবস্থায় তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনাস্থল ও মৃতদের কাছ থেকে একটি পিস্তল, ৩ রাউন্ড গুলি ও ৩টি হাত বোমা উদ্ধার করা হয়েছে।
রাজশাহীর বাগমারার সৈয়দপুর গ্রামে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মসজিদে আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনায় জড়িত জেএমবি’র সদস্য জামাল উদ্দিন পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন গতকাল। নিহত জামাল উদ্দিন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার লক্ষ্মীপুর কালিনগর গ্রামের তাবজুল হকের ছেলে। সে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবি’র আত্মঘাতী দলের সদস্য ছিল বলে পুলিশ জানায়। সোমবার (০৬ জুন) দিনগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার ফরাদপুর চাপড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। গতকাল ভোর ৫টার দিকে ময়নাতদন্তের জন্য জামালের লাশ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের মর্গে নেওয়া হয়।
এর আগে বরিশালে গত বুধবার ভোরে উপজেলার উত্তর বালিয়াতলী গ্রামের আমানতগঞ্জ বাজারে পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে সলিম হাওলাদার নামের এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। পুলিশ বলছে সে ডাকাত ছিল। পুলিশ জানায়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী সলিম হাওলাদারকে ধরতে অভিযান চালায় তারা। বিষয়টি টের পেয়ে পুলিশের উপর হামলা করে সলিম ও তার বাহিনী।
গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে ঝিনাইদহ সদরে আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলী (৭০) নামে মন্দিরের এক পুরোহিতকে গলা কেটে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। তিনি বাইসাইকেলে উপজেলার সোনাইখালী গ্রামের মহিষের ভাগাড় বিল দিয়ে যাচ্ছিলেন।
ঝিনাইদহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজবাহার আলী শেখ জানান, প্রতিদিনের মতো সকাল ৯টার দিকে পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলী নলডাঙ্গা মন্দিরে যাচ্ছিলেন। তিনি নিজ বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরে মহিষের ভাগাড় বিলে পৌঁছালে তিনজন হেলমেট পরা মোটরসাইকেল আরোহী তার গতিরোধ করে মাথায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। আঘাতের পর তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লে দুর্বৃত্তরা তাকে গলা কেটে হত্যা করে পালিয়ে যায়। পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলী নন্দের মাথা, ঘাড়, গলাসহ বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তাকে কে বা কারা হত্যা করেছে তাৎক্ষণিকভাবে বলা যাচ্ছে না।
এর আগে সোমবার দিন শেষে ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডু উপজেলা শহরে নজরুল ইসলাম (৪১) নামে এক ক্লিনিক ব্যবসায়ীকে প্রকাশ্যে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা। বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে সাইভাঙ্গা মাঠে প্রকাশ্যে তাকে হত্যা করা হয়। নজরুল ইসলামের বাবার নাম মরহুম লুৎফর রহমান। চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার তিওরবিলা গ্রামে তাদের বাড়ি। তার বাবা সাবেক চেয়ারম্যান ছিলেন। গত ২০ বছর আগে তার বাবা লুৎফর রহমানকে সন্ত্রাসীরা নিজ বাড়িতে প্রকাশ্যে দিবালোকে গুলি ও গলাকেটে হত্যা করে।
একই দিনে গত সোমবার সকালে যশোরের বাঘারপাড়ার চাড়াভিটা এলাকায় একটি পেট্রোল পাম্পের ভেতরে ২ জনকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। নিহতরা হলেন পাম্পের ম্যানেজার ওবায়দুর রহমান (৩২) ও যশোর এমএম কলেজের ছাত্র লিজন আহমেদ অপু (২৩)। খবর পেয়ে পুলিশ সকালে নিহতদের লাশ উদ্ধারের পর মর্গে পাঠায়। স্থানীয়রা জানান, রোববার রাতে চাড়াভিটায় মেসার্স আব্দুল বারী ফিলিং স্টেশনে প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার ওবায়দুর রহমান ও কলেজছাত্র লিজন আহমেদ ও ওই পাম্পের নজেলম্যান সিরাজুল ইসলাম ঘুমিয়ে ছিলেন। সোমবার সকালে পাম্পটিতে পেট্রোল নিতে এসে স্থানীয়রা পাম্পের ভেতরে লাশ দুটি দেখে থানায় খবর দেন। পরে পুলিশ পাম্পের দরজা ভেঙে লাশ দুটি উদ্ধার করে।
সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া পংখাড়ুয়া গ্রামে জমির উদ্দিন (২২) নামে এক যুবককে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। গত রোববার দুপুরে পুলিশ একটি গাছের নীচ থেকে গলায় রশি পেঁচানো অবস্থায় লাশটি উদ্ধার করে। পুলিশ জানায়, নিহতের বাড়ির অদূরে একটি আমগাছের নিচে গলায় রশি পেঁচানো অবস্থায় জমির উদ্দিনের লাশ দেখে স্থানীয়রা থানায় খবর দেন। পরে পুলিশ গিয়ে তার লাশ উদ্ধারের পর মর্গে পাঠায়।
এছাড়া, বরিশালের মুলাদীর আড়িয়াল খাঁ নদী থেকে মিঠু খান (১৭) নামে এক কলেজছাত্রের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। সকাল ১০টায় নন্দী বাজারসংলগ্ন নদী থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। তার বাবার নাম মোনায়েম খান। চরকালেনখান আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র বলে জানা গেছে। দুই দিন আগে মিঠু খান নিখোঁজ হয়। তাকে অনেক জায়গায় খোঁজ করেও কোথাও পাওয়া যায়নি। নদী থেকে পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে।
লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে নিখোঁজের ৯ দিন পর মাকছুদুর রহমান (২৫) নামে এক যুবকের গলিত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। উপজেলার চর-জাঙ্গালীয়া ইউনিয়ন ভূমি অফিসের পিছনে তহশিলদার সানা উল্যার বাড়ির সেপটিক ট্যাংক থেকে লাশটি উদ্ধার করা হয়।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ তাজপুর গ্রাম থেকে অজ্ঞাতপরিচয় এক নারীর (৩৬) লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। গোবিন্দগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোজাম্মেল হক জানান, সকালে কালো বোরকা পরা এক নারীর লাশ পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয় লোকজন থানায় খবর দেন। পরে পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেছেন, বিচার বহির্ভূত হত্যাকা- বন্ধ করতে হবে। সে যত বড় অপরাধীই হোক না কেন বুন্দুক যুদ্ধের নামে তাকে হত্যা করা গুরুতর অপরাধ। তিনি বলেন, একজন অপরাধীকে গ্রেফতারের পর তার কছে থেকে তথ্য নিয়ে আইন শৃংখলা বাহিনী হত্যাকা-ে জড়িত অন্যান্য অপরাধীদের গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। দেশ জনগণ ও সরকারের স্বার্থেই বিচার বহির্ভূত হত্যাকা- বন্ধ করতে হবে। সেই সাথে সামাজিক অস্থিরতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি রোধ করতে হবে।
বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, দেশে একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু তা রোধ করা যাচ্ছে না। এসব হত্যাকা-ের সাথে যারা জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনতে না পারলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে। তিনি আরো বলেন, যদি অপরাধীদের শাস্তি না হয়, তাহলে অপরাধ বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক। তিনি বলেন, আমি ১০ বছর ধরে এসব কথা বলে আসছি। এভাবে চলতে থাকলে এর পরিণাম হবে ভয়াবহ।
গত দেড় বছরে উগ্রপন্থিরা যেসব হত্যাকা-ে অংশ নেয় তার অধিকাংশ ঘটনার রহস্যের কোনো কিনারা হয়নি। গত ৭ এপ্রিল সূত্রাপুরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিমুদ্দিন সামাদকে হত্যা করা হয়। দুই মাস পরও এ ঘটনায় জড়িত একজনকে গ্রেফতার করতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গত ২৫ এপ্রিল কলাবাগানে ইউএসএইড কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব তনয়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সিসিটিভির ফুটেজে পাঁচজনকে পালিয়ে যেতে দেখা গেছে। এ ঘটনায় শরিফুল ইসলাম শিহাব নামে পুলিশ সন্দেহভাজন একজনকে গ্রেফতার করলেও মূল আসামিরা এখনও অধরা। গত ৩০ এপ্রিল টাঙ্গাইলে হিন্দু দর্জি নিখিল চন্দ্র জোয়ার্দারকে হত্যা করা হয়। পুলিশ বলছে, ওই ঘটনায় জেএমবির সম্পৃক্ততা রয়েছে। যদিও এখনও জড়িত একজনকেও গ্রেফতার করা যায়নি। এ ছাড়া গত বছরের ২ নভেম্বর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যার ঘটনায় একজনকেও গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। শুদ্ধস্বরের কর্ণধার আহমেদুর রশীদ টুটুলের ওপর হামলাকারীরা এখনও আইনের আওতায় আসেনি। গত দেড় বছরে দেশে ৪৫টি জঙ্গি হামলার ঘটনার মধ্যে ২৪টির রহস্য উদ্ঘাটন করা যায়নি। মাত্র চারটি ঘটনায় দায়ের করা মামলার চার্জশিট দাখিল করেছে পুলিশ। অন্যসব হত্যাকা-ের তদন্তের অগ্রগতি নেই।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা আরও বাড়ানো প্রয়োজন। তাদের দুর্বলতার কারণেই খুনী চক্র বেপরোয়া হয়ে ওঠছে। অপরাধীদের যথাসময়ের মধ্যে গ্রেফতার করতে না পারলে এ অপরাধ বাড়তেই থাকবে।
রাজধানীর পল্লবীতে গতকাল মঙ্গলবার গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে দুই ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। পুলিশ বলছে, নিহতরা হলেনÑ তারেক হোসেন ওরফে মিলু ওরফে ইলিয়াস ওরফে ওসমান (৩২) এবং সুলতান মাহমুদ ওরফে রানা ওরফে কামাল (৪৫)। তারেকের বাড়ি জয়পুরহাটে এবং সুলতান মাহমুদের গ্রামের বাড়ি দিনাজপুর। পুলিশের দাবি, নিহতরা নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সদস্য এবং তারা রাবি শিক্ষক রেজাউল করিম হত্যাকা-ে ও বগুড়ার শিয়া মসজিদে হামলায় অংশ নিয়েছিল। ঘটনাস্থল থেকে একটি পিস্তল, তিনটি বুলেট ও তিনটি বোমা উদ্ধার করা হয়।
মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, বড় কোনো নাশকতার পরিকল্পনা নিয়ে এ দু’জন ঢাকায় আসছিলেন। তিনি আরো বলেন, জেএমবির সদস্যরা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। আমরা জানতে পেরেছি, একটি ছোট গ্রুপ আবার রাজধানীতে এসে আশ্রয় নিয়েছে। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গতকাল মঙ্গলবার ভোর ৪টার দিকে ডিবির একটি টিম কালশী এলাকায় অভিযান চালাতে যায়। এ সময় জেএমবি সদস্যরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে। আত্মরক্ষার্থে পুলিশও পাল্টা গুলি ছোড়ে। গুলি বিনিময়ের একপর্যায়ে ওই দুই জেএমবি সদস্য গুলিবিদ্ধ হয়। আহতাবস্থায় তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে জরুরি বিভাগের চিকিৎসকরা তাদের মৃত বলে ঘোষণা করেন। প্রাথমিক তদন্তের পর তাদের নাম ও পরিচয় জানা গেছে। এদিকে মেডিকেল সূত্র জানায়, নিহতদের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত নিহতদের কোনো স্বজন মর্গে আসেনি। এ সময় পর্যন্ত লাশ দু’টির ময়নাতদন্তও সম্পন্ন হয়নি।
রাজশাহীতে জেএমবি সদস্য নিহত
রাজশাহী ব্যুরো জানায়, গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে পুলিশের সাথে ক্রসফায়ারে জামালউদ্দিন নামে এক যুবক নিহত হয়েছে। তার বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ থানার কালীনগর লক্ষ্মীপুর। পুলিশ জানায়, নিহত যুবক জামাল রাজশাহী বাগমারায় আহম্মদিয়া মসজিদে আত্মঘাতী বোমা হামলায় জড়িত জেএমবি সদস্য।
এদিকে, বাগমারায় আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত যুবকের পরিচয় পাওয়া গেছে। তার নাম তারিক আজিজ। সে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শিবগঞ্জ থানার কালীনগর লক্ষ্মীপুর এলাকার আবু সালেকের ছেলে। এ ঘটনায় তার মা তাসলিমা খাতুনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে পুলিশ। গোড়াগাড়ী থানার ওসি আবু ফরহাদ জানান, সোমবার রাত ১১টার দিকে জেএমবি সদস্য জামাল উদ্দিনকে গোদাগাড়ীর বাবুডাইং এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী তারেক আজিজের বাড়িতে নেয়া হয়। সেখানে তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর রাত তিনটার দিকে জেএমবির অন্য সদস্যদের আটকের জন্য গোদাগাড়ী ও চারঘাট থানার পুলিশের সমন্বয়ে পুলিশ একটি দল গোদাগাড়ীর ফারহাদপুরের চটাপাড়া এলাকায় পৌঁছালে জেএমবি জামালউদ্দিনের সহযোগীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ও বোমা নিক্ষেপ করে। এ সময় পুলিশও গুলি চালায়।
এ ঘটনায় পুলিশ ও জেএমবি সদস্যদের গুলিবিনিময়ের একপর্যায়ে জামালউদ্দিন গুলিবিদ্ধ হয়। বন্দুক যুদ্ধের পর আহত জামালউদ্দিনকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার সময় পথে তার মৃত্যু হয়। গতবছর ২৫ ডিসেম্বর দুপুরে রাজশাহী বাগমারা উপজেলার মচমইল এলাকার সৈয়দপুর মচমইল চকপাড়ায় আহমাদিয়া মুসলিম জামাত জামে মসজিদে আত্মঘাতী বোমা হামলায় ১০ মুসল্লি আহত হয়। গতকাল পুলিশ আত্মঘাতী যুবক তারিক আজিজ ও বন্দুক যুদ্ধে নিহত, তার সহযোগী জামালউদ্দিনের পরিচয় প্রকাশ করে।
বি’বাড়িয়ায় ডাকাত সর্দার নিহত
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সংবাদদাতা জানান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে বন্দুক যুদ্ধে রুবেল মিয়া (২৮) নামে এক ডাকাত সর্দার নিহত ও ওসিসহ চার পুলিশ সদস্য আহত হয়েছে। সোমবার দিনগত গভীর রাতে সরাইল-নাসিরনগর-লাখাই সড়কের নাসিরনগর উপজেলার কু-া ইউনিয়নের তোল্লাপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত ডাকাত সর্দার রুবেল নাসিরনগর উপজেলার নুরপুর গ্রামের ফয়েজ মিয়ার ছেলে। তার বিরুদ্ধে ডাকাতির অভিযোগে নাসিরনগর থানায় আটটি ও বিজয়নগর থানায় চারটি মামলা রয়েছে। নাসিরনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আব্দুল কাদের জানান, গভীর রাতে একদল ডাকাত সড়কে ডাকাতির প্রস্তুতি নিচ্ছে খবর পেয়ে পুলিশের একটি দল সেখানে গেলে ডাকাত দলের সদস্যরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে আত্মরক্ষার জন্য পুলিশও পাল্টা গুলি ছুড়ে। গোলাগুলির মধ্যে ডাকাত সর্দার রুবেল আহত হয়। তাকে উদ্ধার করে জেলা সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ওসি জানান, ডাকাত সদস্যের গুলিতে তিনিসহ চার পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। তাদেরকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
আহতরা হলেন-ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আব্দুল কাদের, সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) আশরাফুল, কনস্টেবল রাখাল ও আবু তাহের।

 



 

Show all comments
  • আবু রায়হান ৮ জুন, ২০১৬, ১:০৫ পিএম says : 0
    অপরাধীদের ধরার ও শাস্তি দেবার ব্যাপারে সরকার কঠোর হচ্ছে না কেন ?
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: তিন দিনে ৯ খুন জনমনে উদ্বেগ উৎকন্ঠা
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ