Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিপুল বিজয়েও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পরাজয়

প্রকাশের সময় : ৭ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

তারেক সালমান : ব্যাপক সহিংসতা, প্রাণহানি, ভোট ডাকাতি, কেন্দ্র দখলসহ নানান বিতর্কের মধ্যদিয়ে অবশেষে শেষ হল স্থানীয় সরকার পরিষদের সবচেয়ে শক্তিশালী অংশ ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন। গত শনিবার সারাদেশের ৭২৩টি ইউপিতে ৬ষ্ঠ ধাপের ভোটের মধ্যদিয়ে এ নির্বাচন পর্বটি শেষ হয়। এবারের ইউপি নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ঘোষিত ফলাফলে দেখা যায় মোট ৪৩২১টি ইউপিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নিজেদের দলীয় প্রতীক নৌকা প্রতীকে ২৬৫৪টি ইউপিতে বিজয়ী হয়েছে। অপরদিকে দেশের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি তাদের দলীয় প্রতীক ধানের শীষে জয় পেয়েছে ৩৬৭টিতে। অন্যদিকে, ৮৭৪টি ইউপিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছে। যাদের প্রায় সংখ্যাগরিষ্ঠ বিজয়ীরা হচ্ছেন মূলত ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী। এছাড়া জাতীয় পার্টি মোট ৩৮টি ইউপিতে বিজয়ী হয়েছে। আর বিনাভোটে বা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের ২০৫ জন প্রার্থী।
এবারের ইউপি নির্বাচনের শুরু থেকেই নানান বিতর্ক তৈরি হয়। বিশেষ করে ভোটকে কেন্দ্র করে সারাদেশে তৃণমূল নেতাকর্মীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। যার ফলাফলে সর্বশেষ ৬ষ্ঠ ধাপের নির্বাচন পর্যন্ত মোট প্রাণহানির সংখ্যা ১৩৫ জন ছাড়িয়ে যায়। বাংলাদেশে কোনো ধরনের নির্বাচনে এত প্রাণহানির ঘটনা ইতিহাসে বিরল। কারণ এ দেশে নির্বাচনকে বিশেষ করে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনকে ভোটাররা নিজেদের বিনোদনের অংশ হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গ্রাম পর্যায়ে বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলেও কার্যত স্থানীয় নির্বাচন বাংলাদেশের মানুষের কাছে একটি অন্যতম উৎসব হিসেবে দেখা দেয়।
এদিকে, স্থানীয় সরকার পর্যায়ের ইউপি নির্বাচন শেষে এবারের নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের যেনতেন প্রকারে বিজয় ছিনিয়ে নেয়ার মানসিকতাকে আওয়ামী লীগের মতো পুরনো রাজনৈতিক ঐতিহ্যবাহী দলটির কার্যত রাজনৈতিক পরাজয় হিসেবেই দেখছেন বিশ্লেষকগণ। তাদের অভিমত, নিজেদের জনপ্রিয়তা দেখানোর ‘বাড়াবাড়ি’ ইচ্ছায় মূলত দলটির রাজনৈতিক দুর্বলতাই প্রকাশ পেয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ভেঙ্গেচুরে আওয়ামী লীগ নিজেদের রাজনৈতিক পরাজয় ফুটিয়ে তুলেছে।
এবারের ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মাথাব্যথা হয়ে উঠেছিল বিদ্রোহী প্রার্থীর আধিক্য। অপরদিকে ক্ষমতাসীনদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি ছিল ঠিক উল্টো। সব মিলিয়ে ছয় ধাপে ৪ হাজার ৩২১টি ইউপির মধ্যে সাড়ে ৫শ’র বেশি (৫৫৪) ইউপিতে বিএনপির কোনো প্রার্থীই ছিল না। এর মধ্যে শতাধিক ইউপিতে দলীয় মনোনয়ন দেয়ার জন্য কোনো প্রার্থীই খুঁজে পায়নি দলটি। আবার অনেক জায়গায় প্রার্থী মনোনয়ন দেয়ার পরও সরকারী দলের নেতাকর্মীদের বাধার মুখে সেই প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমাই দিতে পারেননি। আবার কোথাও চাপের মুখে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছেন ধানের শীষের প্রার্থী।
নির্বাচন কমিশনের সাবেক কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনের অভিমত, ষষ্ঠ ধাপ শেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে শেষ হওয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচনটি ছিল জগাখিচুড়ি নির্বাচন। এককথায় বলতে হয়, এমন রক্তাক্ত নির্বাচন আমাদের দেশের অতীতের কোনো নির্বাচনী প্রক্রিয়া চলাকালে ঘটেনি। ১০৯ জনের মতো মানুষকে প্রাণ হারাতে হয়েছে এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। প্রায় হাজার পাঁচেক মানুষ আহত হয়েছে বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশ। নির্বাচন প্রক্রিয়া চলাকালীন বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রের মহড়া, ককটেল ব্যবহার, ব্যালট পেপার ছিনতাই, ব্যালট স্টাফিং, ভোটারদের কেন্দ্রে যাওয়ায় বাধা দেয়া, কেন্দ্রে প্রকাশ্যে সিল মারার ঘটনা এবং প্রতিপক্ষকে প্রতিহত করা থেকে শুরু করে নির্বাচনকে অসফল করার যত ধরনের উপায় রয়েছে, প্রায় সবই ব্যবহার করা হয়েছে।
এবারের ইউপি নির্বাচনে বিভিন্ন বিষয়ে যেমন রেকর্ড তৈরি হয়েছে। নিরঙ্কুশ বিজয় হয়েছে সরকারি দলের। সংখ্যাতত্ত্বের দিক থেকে বৃহত্তর দল বিএনপির তৃণমূলের অস্তিত্বের সংকট এবং অন্য দলগুলোর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার চিত্রই ফুটে উঠেছে। এছাড়াও সরকারি দল আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ে যে বিভাজনের সৃষ্টি হয়েছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তথাকথিত বিদ্রোহী প্রার্থীদের সামলানো নিয়ে ব্যাপক অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে দলটি। ছিল মনোনয়ন নিয়েও নানা প্রশ্ন।
প্রখ্যাত রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নুরুল আমিন বেপারী ইনকিলাবকে বলেন, এবারের নির্বাচন নিয়ে কথা বলার কিছু নেই। এই নির্বাচন একদিকে যেমন পরিবারে-পরিবারে গোন্ডগোল তৈরি করেছে, তেমনি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের বিভাজন-বিভেদ তৈরি করেছে। এর ফল কোথা গিয়ে দাঁড়ায় তা দেখার বিষয়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর আমিন আরও বলেন, স্থানীয় সরকার পর্যায়ের ইউপি নির্বাচনকে নির্বাচন কমিশন ও সরকার গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে ব্যবহার করতে পারত। কিন্তু তা হয়নি। যা হয়েছে, তা নির্বাচন নিয়ে আমাদের মনে অনাস্থা ও আশংকাই তৈরি হয়েছে। এ নিয়ে কথা না বলাই ভাল।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চেয়ারম্যান বদিউল আলম মজুমদার ইনকিলাবকে বলেন, সদ্য সমাপ্ত ইউপি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পরাজয় হয়েছে কিনা জানি না, তবে একথা বলতে পারি এই নির্বাচনের মাধ্যমে তারা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দলীয় প্রতীকে যে স্থানীয় নির্বাচন সম্ভব নয়, এ নির্বাচনে তা প্রমাণিত হয়েছে। দলের প্রার্থিতা নিয়ে তাদের দলের ভেতর যে বিভক্তি তা প্রকট হয়েছে। এই বিভক্তি ভবিষ্যতে ক্ষমতাসীনদের ভোগাতে পারে।
তিনি বলেন, নির্বাচন হল শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া। কিন্তু এ নির্বাচনের মাধ্যমে সেই শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়াকে ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। নির্বাচন নিয়েই জনগণের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। এক ধরনের ভয় তৈরি করা হয়েছে। আমরা ভয়াবহ ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হতে পারি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিপুল বিজয়েও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পরাজয়
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ