Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ব্যাংকিং খাতের কুখ্যাত বন্ড আবদুল আজিজের ‘মাসুদ রানা’

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২৭ জুলাই, ২০১৯, ৪:২৭ পিএম

‘ধ্বংস পাহাড়’ দিয়ে শুরু ‘মাসুদ রানা’র গল্প। দুর্দান্ত, দুঃসাহসী গুপ্তচর ‘মাসুদ রানা’ দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ান গোপন মিশন নিয়ে। ছোটবেলা থেকেই হয়তো এ গল্পের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন আবদুল আজিজ। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এবং জনতা ব্যাংকের মামলার খড়গ মাথায় নিয়ে অন্তরালে ঘুরে বেড়াচ্ছেন জাজ মাল্টিমিডিয়ার এ কর্ণধার। অন্তরাল থেকেই এবার ঘোষণা দিয়েছেন ‘মাসুদ রানা’কে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের।

আবদুল আজিজসহ তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ৯১৯ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের। দুদকের অভিযোগ, ১ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা আত্মসাতের। আর জনতা ব্যাংকের অভিযোগ, ৩ হাজার ৫৭২ কোটি টাকা ফেরত না দেয়ার। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি থেকে বিশাল অংকের এ অর্থ বের করে নেয়ায় সহযোগিতা করেছেন মা, ভাই, ভাবি, স্ত্রী, ভাতিজিকে। তাদের সবাই মামলার আসামি হলেও কারাভোগ করছেন ভাই এমএ কাদের।

গত ছয় মাসে জনতা ব্যাংককে ১ টাকাও ফেরত দিতে পারেনি আবদুল আজিজের পরিবার। অথচ তার প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়া ঘোষণা দিয়েছে ৮৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘মাসুদ রানা’ নির্মাণের। এ ঘোষণায় এরই মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়েছে সিনেমাপাড়ায়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাজী আনোয়ার হোসেনের ‘মাসুদ রানা’ শুরু হয়েছিল ‘ধ্বংস পাহাড়’ দিয়ে। আর আবদুল আজিজের উত্থান জনতা ব্যাংক ‘ধ্বংসের’ সহযোগী হয়ে। তার কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার ব্যাংকিং খাতের ‘কুখ্যাত বন্ড’।

জনতা ব্যাংক বলছে, আবদুল আজিজের কোনো খোঁজ নেই। ব্যাংকের টাকা ফেরত দেয়ার বিষয়ে কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। আবার শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর বলছে, আবদুল আজিজসহ তাদের পরিবারের অন্য সদস্যদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সন্ধান পাওয়ামাত্রই আবদুল আজিজসহ মামলার সব আসামিকে গ্রেফতার করা হবে। রেকর্ড বাজেটে ছবি বানানোর ঘোষণা দিলেও আবদুল আজিজের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই জাজ মাল্টিমিডিয়ার সিইও আলিমুল্লাহ খোকনেরও। তাহলে ‘মাসুদ রানা’ কীভাবে নির্মাণ হবে? সে প্রশ্নই এখন সবার মুখে।

যোগাযোগ না থাকলেও আবদুল আজিজ বর্তমানে কানাডায় আছেন বলে জানান জাজ মাল্টিমিডিয়ার সিইও আলিমুল্লাহ খোকন। তিনি বলেন, ‘মাসুদ রানা’ নির্মাণে ৮৩ কোটি টাকা ব্যয় হবে। তবে এ ব্যয়ের পুরোটাই আমাদের নয়। হলিউডের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সিলভার লাইন, জাজ মাল্টিমিডিয়াসহ তিনটি প্রতিষ্ঠানের যৌথ অর্থায়নে ছবিটি বানানো হবে। তবে এতে কত শতাংশ বিনিয়োগ জাজের আছে, সে সম্পর্কে আমি বিস্তারিত জানি না। আমাদের চেয়ারম্যান আবদুল আজিজ বলতে পারবেন।

জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আবদুল আজিজ দেশের অন্যতম শীর্ষ ঋণখেলাপি হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তার অনুপস্থিতি জাজের ওপর কতটা প্রভাব ফেলছে—এমন প্রশ্নের জবাবে আলিমুল্লাহ খোকন বলেন, এ মুহূর্তে জাজ একটু সংকটের মধ্য দিয়েই যাচ্ছে। আমরা আগের মতো বিনিয়োগ করতে পারছি না। চেয়ারম্যানের সঙ্গে আপাতত আমার কোনো যোগাযোগ নেই। যতটুকু জানি, বর্তমানে তিনি কানাডায় আছেন। শিগগিরই দেশে আসবেন।

এর মধ্যেই বড় বাজেটে ‘মাসুদ রানা’ নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে জাজ মাল্টিমিডিয়া। তাদের ঘোষণা অনুযায়ী, ‘মাসুদ রানা’ পরিচালনা করবেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত হলিউডের পরিচালক আসিফ আকবর। এ ছবিতে থাকছেন হলিউডের অভিনেতা মিকি রুর্কি, গ্যাব্রিয়েলা রাইট, ড্যানিয়েল বেনহার্ট, মাইকেল পেরে এবং রেসলিং তারকা দ্য গ্রেট খালি। ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের ছবির ডিরেক্টর অব ফটোগ্রাফি (ডিওপি) হিসেবে থাকছেন ‘জেমস বন্ড’ সিরিজসহ হলিউডের আরো অনেক জনপ্রিয় ছবির ডিওপি পিটার ফিল্ড। চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্য পরিমার্জন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধনে আছেন আবদুল আজিজ নিজে। সাথে আছেন আসিফ আকবর ও নাজিম উদ দৌলা। ছবিটির শুটিং হবে মরিশাস, থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশে। বাংলা আর ইংরেজি—এ দুই ভাষায় তৈরি হবে ছবিটি। বাংলা ভাষায় মুক্তি পাবে বাংলাদেশ ও ভারতের কলকাতায়। সারা বিশ্বে একযোগে ইংরেজি ভাষায় ছবিটি মুক্তি পাবে।

বড় বাজেটের চলচ্চিত্র নির্মাণকারী জাজ মাল্টিমিডিয়ার অবস্থা জমজমাট হয়ে ওঠে মূলত জনতা ব্যাংকের অর্থ লোপাটের সময়টিতে। এর ছাপ পড়ে সিনেমাপাড়ায়ও। কিন্তু এখন এফডিসিতে তেমন কোনো শুটিং নেই। বেশির ভাগ শিল্পীই হাত গুটিয়ে বসে আছে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দেশের প্রেক্ষাগৃহগুলোও। দেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির এ করুণ দশার জন্য আবদুল আজিজ দায়ী বলে মনে করেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ব্যাংকে গচ্ছিত জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা তিনি লোপাট করেছেন। অর্থ লোপাটের ঢাল হিসেবে চলচ্চিত্রকে ব্যবহার করেছেন। এ অর্থ তিনি লোপাট করেছেন শুধু নিজের উন্নয়নের জন্যই। গোটা চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির ধসে পড়ার পেছনে প্রধান দায়ী ব্যক্তিটি হলেন আবদুল আজিজ। যতটুকু অর্থ তিনি এর পেছনে দিয়েছেন, তা-ও লোক দেখানো।

জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার ক্ষমতার অপব্যবহার করে চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিকে এক হাতে কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন অভিযোগ করে মুশফিকুর রহমান গুলজার বলেন, দেশের অধিকাংশ প্রযোজক, নির্মাতা তার কাছে জিম্মি ছিল এতদিন। এখন তিনি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, চলচ্চিত্র থেকে দূরে আছেন। যে কারণে আবার নতুন করে ইন্ডাস্ট্রির ঘুরে দাঁড়ানোর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আমরা মনে করি, জাজ মাল্টিমিডিয়া ও আজিজের অনুপস্থিতি আমাদের ইন্ডাস্ট্রিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

দেশের ব্যাংকিং খাতের বৃহৎ ঋণ কেলেঙ্কারিগুলোর একটি জনতা ব্যাংকের ক্রিসেন্ট গ্রুপ। এ গ্রুপটির কাছে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৫৭২ কোটি টাকা। গ্রুপটির কাছ থেকে টাকা উদ্ধারে চলতি বছরের শুরুতেই পাঁচটি মামলা করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক। এর মধ্যে চারটি মামলায় ক্রিসেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান এমএ কাদেরকে প্রধান বিবাদী করা হয়। অন্য মামলার প্রধান বিবাদী করা হয় এমএ কাদেরের ছোট ভাই এবং রিমেক্স ফুটওয়্যার ও জাজ মাল্টিমিডিয়ার চেয়ারম্যান মো. আবদুল আজিজকে।

এছাড়া এমএ কাদেরের মা রেজিয়া বেগম, স্ত্রী সুলতানা বেগম মনি, কন্যা সামিয়া কাদের নদী, আবদুল আজিজের স্ত্রী লিটুল জাহান মীরা ও লেক্সকো লিমিটেডের পরিচালক হারুন-অর-রশীদকেও মামলার বিবাদী করা হয়। এসব মামলার মধ্যে রিমেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের কাছে ১ হাজার ১৩৪ কোটি ৯ লাখ, রূপালী কম্পোজিট লেদারওয়্যার লিমিটেডের কাছে ৯২৩ কোটি ৫৯ লাখ, ক্রিসেন্ট লেদার প্রডাক্টস লিমিটেডের কাছে ৮৯৪ কোটি ৯২ লাখ, লেক্সকো লিমিটেডের কাছে ৪৪৬ কোটি ২৬ লাখ ও ক্রিসেন্ট ট্যানারিজ লিমিটেডের কাছে ১৭৩ কোটি ৫১ লাখ টাকা দাবি করা হয়েছে।

সম্প্রতি জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত দেশের শীর্ষ ৩০০ ঋণখেলাপির তালিকায় তৃতীয় শীর্ষ খেলাপির নামটি জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আবদুল আজিজের। রিমেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের চেয়ারম্যান হিসেবে এ তালিকায় নাম যুক্ত হয় তার।

জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আব্দুছ ছালাম আজাদ বলেন, ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে ক্রিসেন্ট গ্রুপ ১ টাকাও পরিশোধ করেনি। এমএ কাদের কারাগারে যাওয়ার পর আবদুল আজিজ বা ক্রিসেন্টের সঙ্গে সম্পৃক্ত কেউ ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি। আমরা এরই মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা করেছি। ক্রিসেন্টের কাছে আমাদের ৩ হাজার ৫৭২ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে।

তিনি বলেন, ক্রিসেন্ট গ্রুপের সবক’টি প্রতিষ্ঠানের জামানতের সম্পদ আমরা নিজেদের জিম্মায় নিয়েছি। সব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনই বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। জামানতের সম্পদ নিলামে বিক্রির জন্য আমরা আদালতে আবেদন জানিয়েছি। আশা করছি, দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ নিলাম সম্পন্ন হবে।

গত ৩০ জানুয়ারি ক্রিসেন্ট গ্রুপের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে তিনটি মামলা করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। মামলার পর পরই ক্রিসেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান এমএ কাদেরকে গ্রেফতার করে সংস্থাটি। তিনটি মামলায় ৯১৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকা পাচারের অভিযোগ আনা হয়। আসামি করা হয় ১৭ জনকে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ আসামি হলেন আবদুল আজিজ। এছাড়া তার স্ত্রী, মা, ভাবি, ভাতিজিকেও অর্থ পাচারের মামলায় আসামি করা হয়।

আবদুল আজিজকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানান শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ড. শহিদুল ইসলামও। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আবদুল আজিজসহ মামলার সব আসামিকে আমরা খুঁজছি। তাদের কোনো সন্ধান পেলেই গ্রেফতার করা হবে। আমাদের মামলায় গ্রেফতার হয়ে ক্রিসেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান এমএ কাদের কারাভোগ করছেন। তাদের বিরুদ্ধে ৯১৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকা পাচারের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

রফতানি না করেও ভুয়া রফতানি বিলের মাধ্যমে জনতা ব্যাংক থেকে ১ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা তুলে নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগে ২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। গত ১০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর চকবাজার থানায় পাঁচটি মামলা করেন সংস্থার সহকারী পরিচালক গুলশান আনোয়ার। এসব মামলারও অন্যতম আসামি আবদুল আজিজ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আবদুল আজিজ
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ