Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পুলিশ ও অধিদফতরের কর্তারা ভাগাভাগি করে নেন মাসোহারা

প্রকাশের সময় : ৬ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

কুষ্টিয়া থেকে এস এম আলী আহসান পান্না : কেরু অ্যান্ড কোং-র ওয়ার হাউজের কুষ্টিয়ায় মদ বিক্রির দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা প্রতি সপ্তাহে পরিদর্শনের জন্য কুষ্টিয়ায় আসেন। মদে পানি মিশিয়ে ভেজাল মদ বিক্রি ও বিক্রির কোনো নিয়ম-নীতি না মানার ঘটনা উপেক্ষা করার বিনিময়ে তিনি মোটা অংকের টাকা উৎকোচ পান। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মদের দোকানে কর্মরত এক ব্যক্তি জানান, মদের ডিলার কুষ্টিয়ার মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মোঃ মিজানুর রহমান ও পরিদর্শক তারিক মাহমুদকে প্রত্যেককে মাসে ৫ লাখ টাকা করে মাসোহারা দেন। আর কুমারখালি ও ভেড়ামারার ডিলাররা প্রত্যেককে দেন মাসে ২ লাখ টাকা করে। এ টাকার একটি অংশ মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের হেড অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়। তারপরও এসব প্রতিষ্ঠানের যেসব কর্মকর্তা ও স্টাফ কুষ্টিয়াতে পোস্টিং পান তারা প্রায় সবাই খুব অল্প সময়েই প্রচুর অর্থ-বিত্তের অধিকারী হয়ে যান। ইতিমধ্যেই বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়ে গিয়েছেন তারা। এমনকি কেরু কোম্পানির কুষ্টিয়ার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাও একাধিক বাড়ি ও বিপুল পরিমাণ জমির মালিক হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, লাইসেন্স ছাড়া বিদেশী মদ বিক্রির নিয়ম নেই। কিন্তু কুষ্টিয়া, কুমারখালি ও ভেড়ামারার ডিলারদের মদের দোকানগুলোতে নানা ব্র্যান্ডের বিদেশী মদও পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায়। সম্প্রতি র‌্যাব আকস্মিক অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ বিদেশী মদ আটক করে। এ ঘটনার পর বিদেশী মদ বিক্রি কয়েকদিন বন্ধ থাকলেও এখন আবার আগের মতই তা বিক্রি হচ্ছে।
দেখা যায়, সুবিশাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ৩টি জেলার সীমান্ত এলাকা দিয়ে মাদক দ্রব্য কুষ্টিয়ায় আসছে। এগুলো হচ্ছে এক. কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলা সীমান্ত, দুই. মেহেরপুরের সদর, মুজিবনগর ও গাংনি উপজেলা সীমান্ত এবং তিন. চুয়াডাঙ্গার জীবন নগর ও দামুড়হুদা উপজেলা সীমান্ত। এর মধ্যে কুষ্টিয়া ও মেহেরপুর সীমান্তের মাদক আসে সড়ক পথে। আর জীবন নগর ও দামুড়হুদা সীমান্তের মাদক আসে দর্শনা হয়ে ট্রেনযোগে। এসব মাদকের চাহিদা যেমন ব্যাপক তেমনি সরবরাহও প্রচুর। সরেজমিনে দেখা যায়, কুষ্টিয়া শহরের আড়াইশ’র মত স্পটে মাদক দ্রব্য বিক্রি হচ্ছে। কথিত আছে যে এর মধ্যে শতাধিক স্পট নিয়ন্ত্রণ করেন গৌতম চাকি। কুষ্টিয়া শহর ও সংলগ্ন স্পটগুলোর মধ্যে রয়েছে মজমপুর গেট, পূর্ব ও পশ্চিম মজমপুর, আমলাপাড়া, পুরাতন পুলিশ ফাঁড়ি, আড়ুয়া পাড়া ওয়ারলেস মোড়, কাটাইখানা মোড়, চর মিলপাড়া, চর আমলাপাড়া, চর থানাপাড়া, কমলাপুর, বারখাদা, ত্রিমোহিনি, হাউজিং, চৌড়হাস কলোনি, বাস টার্মিনাল, মোল্লা তেঘড়িয়া, লাহিনি বটতৈল, উদিবাড়ি, মঙ্গলবাড়িয়া বাজার, বিআইডিসি, কুষ্টিয়া চিনিকল কলোনি, জগতী রেলবাজার প্রভৃতি। স্পটগুলোতে পলিথিনের ছোট ছোট প্যাকেটে করে বাংলা মদ বিক্রি হয়। এসব স্পটে আনাগোনা বড়দের পাশাপাশি ছোটদেরও। কুষ্টিয়া শহরের বাইরে ১১টি ইউনিয়নেই রয়েছে মাদক স্পট। এর মধ্যে রয়েছে উজানগ্রাম, হরিপুর, বৃত্তিপাড়া, ঝাউদিয়া, হরিনারায়ণপুর, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা প্রভৃতি। এর বাইরেও নানাস্থানে মাদক বিক্রির স্পট রয়েছে। সেগুলোও রমরমিয়ে চলছে।
জীবন নগর ও দামুড়হুদা সীমান্ত দিয়ে দর্শনা হয়ে ট্রেনে আসা মাদক নামানো হয় পোড়াদহে। সেখানে গড়ে উঠেছে মাদক বিক্রির জমজমাট বাজার। পোড়াদহ রেল স্টেশনের দক্ষিণে পোড়াদহ বাজারে ও উত্তরে পোড়াদহ হাটে মাদক বিক্রি করা হয়।
দৌলতপুর উপজেলা সদরের বিভিন্ন স্থানসহ ১৪টি ইউনিয়নের হাট-বাজারে হাত বাড়ালেই মাদক মেলে। দৌলতপুর থানা মোড়, হোসেনাবাদ, তারাগুনিয়া, আল্লাহর দরগা, খলিসাকুন্ডি প্রভৃতি স্থানে মাদকের স্পট রয়েছে।
মিরপুর শহরে অবাধে মাদক বেচাকেনা চলে। উপজেলা সদরের মাদক স্পটগুলোর মধ্যে রয়েছে মশান বাজার, নওয়াপাড়া, আমলা, নিমতলা প্রভৃতি। এ ছাড়া বিভিন্ন ইউনিয়নের হাট-বাজারেও মাদক বিক্রি হয়। ভেড়ামারার মদের ডিলার হচ্ছেন আলতাফ হোসেন। ভেড়ামারা শহরে থানাপাড়া, রেলবাজার, উপজেলা মোড়, পৌরসভা মোড়, কাস্টম মোড়, মধ্যবাজার প্রভৃতি স্থানসহ প্রায় ৫০টি মাদকের স্পট রয়েছে।
কুমারখালিতে মদের ডিলার হচ্ছেন হরিশংকর সিংহ রায়। তার দোকান থেকে মদ নিয়ে বাইরের বিভিন্ন স্পটে বিক্রি করা হয়। কুমারখালি বাসস্ট্যান্ড মোড়, গরুর হাটসহ শহরের বিভিন্ন স্থানে মাদক বিক্রির স্পট রয়েছে।
খোকসা উপজেলা সদরেও মাদক মেলে। জানিপুর, সমশপুর, খোকসা রেলবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে বাংলা মদসহ মাদক বিক্রি হয়।
আগে বয়স্ক ও যুবকদের মাদক গ্রহণ করতে দেখা গেলেও হালে তরুণ ও স্কুলগামী বালক-কিশোরদের মধ্যেও মাদকাসক্তির প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে দেখা যাচ্ছে। কেউবা সঙ্গদোষে, কেউবা বিপথগামী হয়ে যোগ দিচ্ছে জীবন ধ্বংসের এ ভয়াবহ নেশায়। তারা ফেনসিডিল, হেরোইন, গাঁজায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। মাদকের মধ্যে গাঁজার মূল্য কিছু কম। অন্যদিকে ১শ’ টাকার হেরোইনে সারা দিন চলে। মাদকসেবীদের মধ্যে ধনী, সচ্ছল পরিবারের ছেলেরা যেমন তেমনি নিম্নবিত্তরাও রয়েছে। এ নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর নেশাগ্রস্তরা মাদকের টাকা যোগাড় করতে গিয়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে বাড়ছে চুরি-ছিনতাইয়ের মত অপরাধ। পাশাপাশি বন্ধু-সহপাঠীদের মাধ্যমে অল্পবয়সীদের মধ্যে মাদকাসক্তি ছড়িয়ে পড়ছে এবং মাদক দিন দিন সহজ লভ্য হচ্ছে। আরো শংকার কথা যে স্বল্প পরিমাণে হলেও তরুণীদের মধ্যেও মাদক গ্রহণের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
মাদকের বিস্তারে ক্ষুব্ধ মানুষের কথা হচ্ছে, মাদক দ্রব্য বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা যাদের দায়িত্ব সেই মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের লোকেরাই সব কিছু দেখেও না দেখার ভান করেন। অবৈধ অর্থের কাছে তারা আত্মসমর্পণ করায় সর্বনাশের কালো মেঘ দিনকে দিন বিস্তৃত হচ্ছে। তাদের সাথে পুলিশও নিয়মিত মাসোহারা পাওয়ায় মাদক ব্যবসা দমনের কেউ নেই। সে কারণে সর্বনাশ আরো ঘনীভূত হচ্ছে। দিন দিন বাড়ছে মাদক স্পট ও মাদক সেবীর সংখ্যা। ক্রমশ বেশি সংখ্যায় তরুণ সমাজ ধাবিত হচ্ছে অধঃপতনের দিকে। সমাজ আজ ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন। ফলে অভিভাবক মহল ভীষণ শংকিত হয়ে পড়েছেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পুলিশ ও অধিদফতরের কর্তারা ভাগাভাগি করে নেন মাসোহারা
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ