Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২২ কার্তিক ১৪৩১, ০৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ব্যস্ত সড়কে এক মিনিটের নৃশংসতা - চট্টগ্রামে এসপির স্ত্রীকে হত্যা

প্রকাশের সময় : ৬ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:০৫ এএম, ৬ জুন, ২০১৬

রফিকুল ইসলাম সেলিম : চট্টগ্রাম নগরীতে লোমহর্ষক হত্যার শিকার হয়েছেন এক পুলিশ সুপারের স্ত্রী। নগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার এডিসি থেকে পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ সদরদপ্তরে সদ্য বদলি হওয়া পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে (৩২) কুপিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। গতকাল (রোববার) সকাল ৭টার দিকে ও আর নিজাম রোডে এই ঘটনা ঘটে। শিশুপুত্রকে স্কুল বাসে তুলে দিতে বাসা থেকে বের হয়ে একশ’ গজ দূরে আসতেই তিন দুর্বৃত্ত তাকে মোটর সাইকেল দিয়ে প্রথমে ধাক্কা দেয় পরে ছুরিকাঘাত ও গুলি করে। মাথায় গুলি করে মাত্র এক মিনিটেরও কম সময়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে ঘাতকরা মোটর সাইকেল যোগে পালিয়ে যায়। নিজের চোখে মায়ের পৈশাচিক খুনের ঘটনা দেখে ভয় আতঙ্কে দৌঁড়ে বাসার সামনে চলে যায় শিশুপুত্র মাহমুদ আকতার মাহি।
চট্টগ্রাম অঞ্চলের সাধারণ মানুষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়, সুদক্ষ, সৎ, দেশপ্রেমিক ও মেধাবী রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত এই পুলিশ অফিসারের স্ত্রীকে প্রকাশ্যে রাস্তায় কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যার খবরে সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা সেখানে ছুটে যান। দুপুরে বাবুল আক্তারের বাসায় যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। তিনি এই হত্যাকা-কে নির্মম পৈশাচিক ও বর্বোরচিত উল্লেখ করে এর পেছনে জঙ্গিদের হাত থাকতে পারে বলে সন্দেহপ্রকাশ করেন। খুবশিগগির খুনিদের পাকড়াও করে আইনের মুখোমুখি দাঁড় করানোর অঙ্গীকার করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। হত্যাকা-ের রহস্য সম্পর্কে এখন নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার মো. ইকবাল বাহার বলেছেন, বাবুল আক্তার তার পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সন্ত্রাসী, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসায়ী এবং জঙ্গিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেছেন। কোন পক্ষ প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে এই খুনের ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে। তদন্ত শুরু হয়েছে খুব শিগগির রহস্য উদ্ঘাটন করা যাবে। এটিকে পরিকল্পিত হত্যাকা- বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
নির্মম এই হত্যাকা-ের ঘটনায় বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামে সবশ্রেণি পেশার মানুষের মধ্যে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। দলমত নির্বিশেষে সবাই কাপুরুষিত এই হত্যাকা-ের তীব্র নিন্দা ও ধিক্কার জানাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বইছে নিন্দার ঝড়। বাবুল আক্তারের বাসায় চলছে স্বজনদের কান্নার রোল আর আহাজারি। মিতু এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জননী। বাবুল ও মিতু আক্তার দম্পতির ছেলে মাহমুদ আকতার মাহি নগরীর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। ছোটো মেয়ে তাবাসসুম এখনও স্কুলে যাওয়া শুরু করেনি। তাদের বাসা জিইসি মোড় সংলগ্ন ও আর নিজাম রোডে।
স্ত্রীর এই নৃশংস হত্যাকা-ের সময় বাবুল আক্তার কর্মস্থল ঢাকায় ছিলেন। গতকাল পুলিশ সদরদপ্তরে পুলিশ সুপার হিসাবে তার যোগদানের কথা ছিলো। প্রাণপ্রিয় সহধর্মিনীর নির্মম হত্যাকা-ের খবর টেলিফোনে পান তিনি। এরপর স্ত্রীর লাশ দেখতে তিনি দুপুরের আগেই বিশেষ হেলিকপ্টারযোগে চট্টগ্রাম ফিরে আসেন। প্রথমে তিনি চমেক হাসপাতালের মর্গে যান লাশ দেখতে। সেখান থেকে বাসায় ফিরেন। এসময় তার কান্নায় পরিবেশ ভারী হয়ে উঠে। মা হারানো অবুঝ দুই সন্তান বাবার গলা জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। এ সময় উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তা ও স্বজনেরা তাকে সান্ত¦না দিতে গিয়ে নিজেরাই কান্নায় ভেঙে পড়েন। পুলিশের চাকরি জীবনে নিজের জীবনবাজি রেখে লাখো মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দিয়েছিলেন বাবুল আক্তার। অথচ নিজের স্ত্রীকে এভাবে সন্ত্রাসীদের হাতে প্রাণ দিতে হলো।
বাবুল আক্তার বলেছেন ব্যক্তিগতভাবে কারো সাথে তার কোন বিরোধ নেই। তার কোন শত্রুও নেই। পরপর দুইবার পুলিশের সর্বোচ্চ পদকপ্রাপ্ত (পিপিএম বার) এই কর্মকর্তা ব্যক্তিগত জীবনে সৎ এবং সাধারণ জীবনযাপন করতেন। তার স্ত্রী মিতুও ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী, বন্ধুবাৎসল, পর্দানসীন। তিনিও সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন। বাবুল আক্তারকে সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন সময়ে হুমকি দিতেন। এসব হুমকিকে তেমন পাত্তা দিতেন না তিনি। তবে কিছুদিন ধরে মিতু নিরাপত্তাহীনতার কথা বলে বাসা বদলে ফেলার পরামর্শ দিয়েছিলেন স্বামীকে। তিনি বলতেন, এ বাসা অনেকে চিনে গেছে। এখানে থাকা নিরাপদ হবে না। তার আশঙ্কাই সত্য হলো।
পুলিশ কর্মকর্তাদের ধারণা বাবুল আক্তার চট্টগ্রাম মহানগরীসহ এই অঞ্চলে দায়িত্ব পালনকালে অনেক সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী চক্র, মাদক ব্যবসায়ী ও অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে সফল হন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সৎ ও সাদাসিধে হলেও সন্ত্রাসী মাদক ব্যবসায়ী ও অস্ত্রধারীদের কাছে তিনি মূর্তিমাণ আতংক। জঙ্গিবিরোধী অভিযানেও তার ভূমিকা ছিল। এসব কারণে কোন পক্ষ পরিকল্পিতভাবে এই খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে বলে ধারণা করছেন নগর পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা। তবে এখনও কাউকে আটক করা যায়নি।
এক মিনিটেই খুন
ঘটনাস্থল থেকে সংগ্রহ করা সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ দেখে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) পরিতোষ ঘোষ জানান। হত্যার ধরন দেখে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে এটি পরিকল্পিত হত্যাকা-। তারা আগে থেকেই ঘটনাস্থল রেকি করেছিল। ঘটনাস্থল থেকে ১০০ গজ দূরে বাসা থেকে বের হয়ে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে কখন আসবেন, তা নিশ্চয় দুর্বৃত্তরা আগে থেকে খোঁজ-খবর রাখছিল। পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী প্রতিদেনের মতো ছেলে মাহমুদ আকতার মাহিরকে নিয়ে জিইসি মোড় পৌঁছার আগেই ওয়েল ফুড নামক দোকানের সামনে মোটরসাইকেলে করে তিন আরোহী আসে। যে গাড়ি চালাচ্ছিল, তার মাথায় হেলমেট ছিল। বয়স আনুমানিক ৩০ থেকে ৩৫। তার পেছনে দু’জন বসা ছিল। মাঝখানে বসা যুবকের হাতে ছুরি ছিল। পেছনে বসা তৃতীয়জনের হাতে একটি পিস্তল ছিল। পরিতোষ ঘোষ বলেন, মোটরসাইকেলে থাকা তিন যুবক প্রথমে মাহমুদা খানমকে মোটরসাইকেল দিয়ে ধাক্কা দেয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাঝখানে থাকা যুবক প্রথমে তার বুকে, হাতে ও পিঠে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে। তৃতীয়জন তার হাতে থাকা পিস্তল দিয়ে খুব কাছ থেকে গুলি করে। প্রথম ফায়ারটি মিস হয়। দ্বিতীয় ফায়ারে বাবুল আক্তারের স্ত্রীর কপালের বাঁ পাশে গিয়ে লাগে। সবকিছু করতে ৪০ থেকে ৫০ সেকেন্ড লাগে। তবে ভিডিও ফুটেজ থেকে পাওয়া তিন যুবকের চেহারা স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে না। প্রথমজনের মাথায় হেলমেট থাকায় চেহারা বোঝা যাচ্ছে না। তারপরও তাদের খোঁজা হচ্ছে। মাহিও অনুরূপ বর্ণনা দিয়েছে হত্যাকা-ের। সে জানায়, মোটরসাইকেলে আসা তিন যুবকের একজন প্রথমে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। এরপর একজন তার মাকে মোটর সাইকেল দিয়ে ধাক্কা দেয়। একজন তার মাকে ছুরি মারে অপরজন গুলি করে। এতে সে ভয় পেয়ে দ্রুত বাসার সামনে চলে যায়।
বোরকা ভিজে যায় রক্তে
সন্ত্রাসীদের উপযূুপরি ধারালো অস্ত্রের আঘাত ও গুলিতে পিচঢালা কালো সড়কে লুটিয়ে পড়েন কালো বোরকা ও রঙিন হিজাব পরিহিতা মাহমুদা খানম মিতু। ছেলে মাহির কাছ থেকে খবর পেয়ে সেখানে ছুটে আসেন বাড়ির দারোয়ান। তিনি তাকে পুলিশ ভাবী হিসেবে চিনতেন। দ্রুত বাসায় গিয়ে একটি চাদর এনে রক্তে ভিজে যাওয়া লাশটি ঢেকে দেন দারোয়ান। সেখানেই লাশের সুরতহাল রিপোর্ট করা হয়। আলামত সংগ্রহ করে সিআইডির ফরেনসিক টিম ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআই’র সদস্যরা। পিবিআই’র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বশির আহমদ খান বলেন, মাহমুদার বুক, হাত, কনুই ও পিঠের মাঝখানে মোট ৮টি ধারালো অস্ত্রের আঘাত রয়েছে। মাথার বামপাশে গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে। ডানপাশে রয়েছে ইটের আঘাতের চিহ্ন। ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাাড়ি কোপানোর পর মৃত্যু নিশ্চিত করতে মাথায় গুলি করে খুনীরা। মাথার ডানপাশের আঘাতটি পড়ে যাওয়ার কারণে হয়েছে বলে জানান ওই পুলিশ কর্মকর্তা। সেখান থেকে তিনটি তাজা বুলেট পাওয়া যায়। একটি বুলেটের খোসাও উদ্ধার করা হয়। ৭.৬৫ বোরের এসব বুলেট পিস্তলে ব্যবহৃত হয়। প্রতিবেশীরা জানান, পর্দানসীন মিতু বাসা থেকে বের হলেই বোরকা আর হিজাব পড়তেন। গতকালও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
খুনীদের একজন আগে থেকেই সেখানে ছিল
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, মোটর সাইকেল চালিয়ে ২ যুবক আসে সেখানে। কিন্তু ফিরে যাওয়ার সময় ওই মোটরসাইকেলে তিনজনকে দেখা গেছে। আশপাশের রাস্তায় থাকা সিসিটিভির ফুটেজেও দেখা যায়, মোটরসাইকেল ২ জন এসেছে। আগে থেকেই একজন সেখানে ছিল। ওই যুবকটি দীর্ঘক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে মোবাইলে কথা বলছিলও বলে জানান পাশের ভবনের দারোয়ান। মিতু প্রতিদিনই সকালে ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে সেখানে আসেন। নিরিবিলি হোটেলের এক বয় জানান, গুলির শব্দ শুনে তারা দেখেন মোটরসাইকেল আরোহী পালিয়ে যাচ্ছে। আর এক মহিলা রাস্তায় পড়ে আছে।
অল্পের জন্য বেঁচে গেল ছেলে
অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেল মাহমুদা খানম মিতুর পুত্র মাহমুদ আকতার মাহি। তাকে স্কুল বাসে তুলে দিতে বাসা থেকে বের হয়ে সড়কে দাঁড়ান মিতু। এ সময় তার উপর হামলা করে খুনীরা। মাহি জানান, খুনীদের একজন তাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়। পরে গিয়ে সামান্য আহত হয় সে। এ অবস্থায় সেখান থেকে উঠে দৌঁড়ে বাসার সামনে চলে যায় সে। বুদ্ধি করে দৌঁড়ে না পালালে হয়তো এলোপাতাড়ি কোপ কিংবা গুলিতে তারও ক্ষতি হতে পারতো এমন কথা বললেন প্রতিবেশীরা। নিজের চোখের সামনে মায়ের নির্মম হত্যাকা-ের বিভীষিকাময় দৃশ্য দেখে ভয়ে তটস্থ এ শিশু। ঢাকা থেকে বাবা বাবুল আক্তার বাসায় আসার পর তার গলা জড়িয়ে ধরে রাখে সে। এ সময় বাবার কাছে মাকে কিভাবে খুন করা হয়েছে তার বর্ণনা দেয়। তার বিশ্বাস বাবা থাকলে ওরা মাকে মারতে পারতো না। মাকে হারিয়ে নির্বাক তার ছোট বোন তাবাস্সুম। তার বয়স মাত্র ৪ বছর। এখনও স্কুলে যাওয়া হয়ে উঠেনি। এ বয়সে সে কি হারিয়েছে তা বুঝার ক্ষমতাও তার নেই। তবে মা যে আর বেঁচে নেই এটা সে বুঝতে পেরেছে।
ব্যাপক জনপ্রিয় বাবুল আক্তার
পুলিশ বিভাগে অত্যন্ত দক্ষ ও সাহসী অফিসার বাবুল আক্তার চট্টগ্রামে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান। তার অসীম সাহস, পেশাদারিত্ব এবং দায়িত্বের প্রতি নিষ্ঠা তাকে সন্ত্রাসকবলিত এ অঞ্চলের গণমানুষের পরমপ্রিয় করে তোলে। চাকরি জীবনের শুরুতে কিছুদিন তিনি ঢাকায় ছিলেন। এরপর সহকারী পুলিশ কমিশনার হিসেবে সিএমপির কোতোয়ালী জোনে বদলি হয়ে আসেন। একের পর এক চাঞ্চল্যকর হত্যাকা-ের রহস্য উদঘাটন, খুনী, ডাকাত, চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, অস্ত্র-মাদক ব্যবসায়ী, অপহরণকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে সফল হন তিনি। অভিনব সব কৌশলে অপরাধীদের পাকড়াও এবং চাঞ্চল্যকর মামলার রহস্য উদ্ঘাটনে তিনি ছিলেন পারদর্শী। তার এ সাফল্যের গল্প পুলিশ বিভাগ ছাড়িয়ে মিডিয়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। ছদ্মবেশে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে শীর্ষ অনেক সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করে আলোচনায় আসেন তিনি। পরপর দুইবার পুলিশের সর্বোচ্চ পদক পিপিএম অর্জন করেন বাবুল আক্তার। সিএমপি থেকে সার্কেল এএসপি হিসেবে হাটহাজারীতে বদলি হন তিনি। সেখানে দায়িত্ব পালনকালে অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে সন্ত্রাস কবলি ওই এলাকায় স্বস্তি ফিরিয়ে আনেন তিনি। সেখানে থাকা অবস্থায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতি পান বাবুল আক্তার। বদলি হয়ে চলে যান কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের দায়িত্বে। রামুতে বৌদ্ধবিহারে সন্ত্রাসী হামলাসহ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ও জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সেখানে ভূমিকা রেখে প্রশংসা পান বাবুল আক্তার। এরপর অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) হিসাবে সিএমপিতে বদলি হয়ে আসেন বাবুল আক্তার। ডিবির দায়িত্ব পেয়ে বেশ কয়েকটি সফল অভিযান পরিচালনা করেন তিনি। সর্বশেষ হাটহাজারীর আমান বাজারে একটি জঙ্গি আস্তানা থেকে আমেরিকায় তৈরি ¯œাইপার রাইফেল এবং কর্ণফুলী থানার ইছানগরে জেএমবির আস্তানা থেকে গ্রেনেড উদ্ধার করেন তিনি। এরপর তিনি একটি প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামে চলে যান চীনে। সেখানে থাকা অবস্থায় পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতি পান বাবুল আক্তার।
আশঙ্কা সত্যি হলো
পদোন্নতি পাওয়ার পর থেকে নানা ধরনের হুমকি-ধমকি পাচ্ছিলেন বাবুল আক্তার এমন কথা সহকর্মী এবং ঘনিষ্ঠ মিডিয়া কর্মীদের প্রায়ই বলতেন তিনি। তবে এসব নিয়ে কখনও তিনি বিচলিত ছিলেন না। তিনি বলেন, প্রায়সময় সন্ত্রাসীদের পক্ষ থেকে হুমকি পান তিনি। এসবকে পাত্তা দিলে কাজ করা যাবে না। পদোন্নতি পাওয়ার পর পোস্টিং পেতে বেশ কিছুদিন সময় পার হয়ে যায়। এ সময়ে তিনি বেশ কয়েকবার হুমকি পান। তিনি আশঙ্কা করছিলেন তার কিছু করতে না পারলেও পরিবারের ক্ষতি করতে পারে সন্ত্রাসীরা। আর তার সে আশঙ্কাই সত্য হলো। সন্ত্রাসী হামলায় স্ত্রীকে হারালেন তিনি। ঢাকা থেকে বিশেষ হেলিকপ্টারে চট্টগ্রামে ছুটে আসার পর হাসপাতালে যান বাবুল আক্তার। সেখানে পাঁচলাইশ থানার ওসিকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, তোমরা কেন তাকে দেখে রাখলে না। আমি তো তোমাদের বলেছি, ওরা আমার পরিবারের ক্ষতি করতে পারে। এসব বিষয় বাবুল আক্তার তার সহকর্মীদের কাছেও বলেছিলেন। নগর গোয়েন্দা পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, বড় ধরনের অভিযানে গেলে বাসা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতেন তিনি।
পুলিশ কমিশনারের বক্তব্য
হত্যাকা-ের পরপরই ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন নগর পুলিশের কমিশনার ইকবাল বাহার। তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, অতীতে বাবুল আক্তার সন্ত্রাস জঙ্গী দমনে প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছিলেন। এতে সংশ্লিষ্টরা সংক্ষুব্ধ হতে পারেন। এর জের ধরে পরিকল্পিতভাবে হত্যাকা-টি সংঘটিত হয়েছে বলে প্রাথমিক ধারণা করছি আমরা। তদন্তের মাধ্যমে খুনি, হত্যার কারণ ইত্যাদি বেরিয়ে আসবে। সব ধরনের ক্লু ধরেই তদন্ত এগিয়ে যাবে। তিনি বলেন, ঘটনার পরপরই পুলিশের একাধিক টিম খুনীদের ধরতে অভিযানে মাঠে নেমেছে। আমরা আশা করছি, খুব শিগগির খুনীরা ধরা পড়বে। ঘটনার পর পরপরই তদন্ত কাজ শুরু করেছেন গোয়েন্দারা। নগর পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) পরিতোষ ঘোষ জানান, খুনিদের শনাক্তের জন্যে ওয়েল ফুডের ভবনের সিসিটিভি ফুটেজ এবং সড়কের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হচ্ছে। নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মোক্তার আহমদ বলেন, ইতিমধ্যে পুলিশ তদন্তকাজ শুরু করে দিয়েছি। শিগগির খুনিদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
পুলিশ লাইনে জানাযা
মাহমুদা খানমের প্রথম নামাজে জানাজা নগরীর দামপাড়া পুলিশ লাইন মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। বিকেল সোয়া তিনটার দিকে অনুষ্ঠিত জানাযায় সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, সংসদ সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল আলম চৌধুরী, পুলিশ কমিশনার ইকবাল বাহারসহ বিপুলসংখ্যক ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা, বিভিন্ন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা অংশ নেন। জানাযা শেষে কফিন নিয়ে যাওয়া হয় ঝিনাইদহে। সেখানে বাবুল আক্তারের গ্রামের বাড়িতে দ্বিতীয় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে।
মাগুরায় শোকের মাতম
মাগুরা জেলা সংবাদদাতা জানান : সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত মাহমুদা খাতুন মিতুর স্বামী বাবুল আখতারের মাগুরা কাউন্সিল পাড়ার বাসভবনে চলছে শোকের মাতম। বাবুল আখতার চট্টগ্রামে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সম্প্রতি পদোন্নতি পেয়ে ঢাকা পুলিশ হেড কোয়র্টারে পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদান করার পর এ ঘটনা ঘটলো।
পুত্রবধুর মর্মন্তিক মৃত্যুও খবরে বাবুল আখতারের পিতা পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত এস আই আব্দুল ওয়াদুদসহ পরিবারের সদস্যরা মুষড়ে পড়েছেন। মাগুরার পুলিশ সুপার একেএম এহসান উল্লাহ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলামসহ ঊর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তারা সংবাদ পেয়ে মরহুমের বাসভবনে যান। পরিবারের সদস্যদের শান্তনা দেন তারা। এ সময় বাবুল আখতারের পিতা আব্দুল ওয়াদুদ হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ব্যস্ত সড়কে এক মিনিটের নৃশংসতা - চট্টগ্রামে এসপির স্ত্রীকে হত্যা
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ