ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
রেজাউর রহমান সোহাগ
মৃত্যু হচ্ছে মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় বাস্তবতা। তারপরেও কিছু কিছু মৃত্যু আছে, যা সহজে মেনে নেয়া যায় না। আবার বিশ্বাসও হতে চায় না। ঠিক এমনি একটি মৃত্যু সংবাদ পেয়ে রীতিমতো হতবাক হয়ে গেলাম। বুধবার সকালে দেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক, মাছরাঙা টিভি’র সিইও ও প্রধান সম্পাদক সৈয়দ ফাহিম মুনয়েম-এর মৃত্যুর সংবাদটি যখন পেলাম তখন কষ্টে শোকে কোনোভাবেই আর নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারছিলাম না। বারবার মনে হচ্ছিল যেন ভুল শুনেছি, এটা হতে পারে না। হঠাৎ ফাহিম মুনয়েমের মতো সদা হাস্যোজ্জ¦ল, সুস্থ মানুষ পৃথিবী থেকে এভাবে চলে যাবেন, এটা বিশ্বাস করতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল। বাংলায় যে প্রবাদ আছে, ‘অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর’ আমার অবস্থাও ছিল ঠিক সেরকম। অতিকষ্টে শোক কিছুটা সামলে নিয়ে টেলিফোনে সংবাদটি জানালাম ইনকিলাব সম্পাদক বাহাউদ্দীন ভাইকে। বাহাউদ্দীন ভাই খবরটি শোনার সাথে সাথে অনেকটা চিৎকার দিয়েই বললেন, ‘বলো কী সোহাগ? ফাহিম মুনয়েম ভাই নেই? কীভাবে, কী হয়েছিল? জানালাম যে, গুলশানের বাসায় ভোরে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ফাহিম মুনয়েম (টিপু) ভাই মারা গেছেন। খবরটি শুনে বাহাউদ্দীন ভাইও শোকে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে বাহাউদ্দীন ভাই বললেন, ‘ফাহিম মুনয়েম ভাইয়ের মতো অমায়িক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন সজ্জন মানুষ আমি আমাদের সমাজে খুব কমই দেখেছি। তিনি ছিলেন আমাদের মিডিয়া পেশার একজন গর্ব করার মতো অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। তার শূন্যস্থান কোনোভাবেই পূরণ হওয়ার নয়।’ ফাহিম মুনয়েম ছিলেন দেশের সাংবাদিকতা জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। গর্বিত পিতা দেশবরেণ্য সাংবাদিক সৈয়দ নুরুদ্দীনের যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে নিজেকে দেশ ও সমাজের কাছে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন এক অনন্য উচ্চতার সাংবাদিক হিসেবে। একজন সফল মানুষের সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে তার ব্যক্তিত্ব আর এই কথাটি শতভাগ প্রযোজ্য ফাহিম মুনয়েমের ক্ষেত্রে। একজন পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে সৈয়দ ফাহিম মুনয়েমের দক্ষতা ও সফলতা ব্যাপক। কিন্তু এত বড় মাপের একজন বরেণ্য সাংবাদিক হওয়ার পরেও তার মধ্যে কোনোরকমের অহংকারবোধ ছিল না। এটাই ছিল একজন মানুষ হিসেবে ফাহিম মুনয়েমের সবচেয়ে বড় গুণ। সব সময় মুখে হাসি লেগে থাকাটা ছিল তার চরিত্রের এক অসাধারণ বৈশিষ্ট্য। হাসি ছাড়া যেন কোনো কথাই বলতে পারতেন না আমাদের সবার প্রিয় ফাহিম মুনয়েম টিপু ভাই। মিডিয়ার যেকোনো অনুষ্ঠানে ফাহিম মুনয়েমের উপস্থিতি অনুষ্ঠানের মাধুর্য বাড়িয়ে দিতো অনেকাংশে। ফাহিম মুনয়েম খেলাধুলা খুবই পছন্দ করতেন এবং ক্রীড়াজগতের প্রতি ছিল তার প্রচ- দুর্বলতা। বিশেষ করে ক্রিকেটের প্রতি তার ছিল প্রচ- আগ্রহ। সময় পেলেই ক্রিকেট খেলা দেখতেন। কারণ একজন পেশাদার ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে আমার সাথে ফাহিম মুনয়েমের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও আন্তরিক সম্পর্কের সৃষ্টি হয়েছিল অনেক আগে থেকেই। সৈয়দ ফাহিম মুনয়েমের ডাক নাম ছিল টিপু। যে কারণে আমি সব সময় তাকে টিপু ভাই বলেই ডাকতাম। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবাহনীর ও জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার গোলাম রাব্বানী হেলাল ও আবাহনীর সংগঠক আহমেদ ফয়জুর রহমানেরও অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন ফাহিম মুনয়েম। তার সাথে আমাদের একত্রে অনেক সময় আড্ডা ও একত্রে হোটেল সোনারগাঁয় ও শেরাটনে লাঞ্চ ও ডিনার করার সুযোগ হয়েছে। আমাদের ঐ আড্ডায়ও টিপু ভাই’র কাছে প্রধান বিষয় থাকতো ফুটবল ও ক্রিকেট। ব্যক্তিগতভাবে টিপু ভাই আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। তার মতো একজন ব্যক্তিত্বের স্নেহ ও সহযোগিতা আমি মনে করি আমার সাংবাদিকতা জীবনের অন্যতম প্রাপ্তি। আমার সাথে যখনি কোথাও দেখা হতো আমার সালামের জবাব দেয়ার সাথে সাথেই হাসিমুখে টিপু ভাই’র কমন প্রশ্ন থাকতো ‘সোহাগ কেমন আছ? বাহাউদ্দীন ভাই কেমন আছে?’ এখানে উল্লেখ্য, সৈয়দ ফাহিম মুনয়েমের সাথে আমাদের ইনকিলাব সম্পাদক বাহাউদ্দীন ভাই’র সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও গভীর এবং তাদের মধ্যে প্রায়ই বিভিন্ন বিষয়ে টেলিফোনে কথাবার্তা হতো। টিপু ভাই’র আরেকটি অসাধারণ গুণ ছিল, তিনি তার মিডিয়ার সহকর্মীদের ব্যাপারে সব সময় ছিলেন অত্যন্ত আন্তরিক এবং যেকোনো ব্যাপারে সকলের জন্যই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে। সাংবাদিকদের মর্যাদা রক্ষায় ও অন্যান্য স্বার্থ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ফাহিম মুনয়েম ছিলেন এক আপোষহীন ব্যক্তিত্ব। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন একজন নিয়মিত সোচ্চার প্রতিবাদী। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এই নৃশংস হত্যাকা-ের প্রতিবাদ করে এর সুষ্ঠু বিচার দাবি করে গেছেন। তিনি যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দিন আহমেদের প্রেস সচিব ছিলেন তখন বিভিন্নভাবে সাংবাদিকদের আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেছেন যেগুলো অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো দৃশ্যমান ছিল না বা তিনিই হয়তো দৃশ্যমান হতে দেননি। ওই সময়ের একটি ঘটনার কথা আজ খুবই মনে পড়ছে, যা উল্লেখ করার লোভ আমি কোনোভাবেই সামলাতে পারছি না। আমি যখন বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির প্রেসিডেন্ট ছিলাম তখন আমাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনে টিপু ভাই আমাকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করতেন। আমার সাংবাদিক সহকর্মীরা সকলেই জানতেন যে, টিপু ভাই আমার খুবই ঘনিষ্ঠ এবং আমার কোনো অনুরোধ তিনি আন্তরিকভাবে রাখার চেষ্টা করেন। এ কারণে টিপু ভাই যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দিন আহমেদের প্রেস সচিব তখন বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি তাদের বাৎসরিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি করতে চাইল প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দিন আহমেদকে এবং এই বিষয়টি চূড়ান্ত করার দায়িত্ব দেয়া হলো আমাকে। আমি যথারীতি টিপু ভাইকে বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে জানালে তিনি দুই দিনের মধ্যেই প্রধান উপদেষ্টাকে প্রধান অতিথি করে, অনুষ্ঠানের চূড়ান্ত তারিখ নির্ধারণ করে দিলেন। অত্যন্ত আনন্দ আর আগ্রহচিত্তে ক্রীড়া লেখক সমিতির সদস্যরা অনুষ্ঠানকে সুন্দর ও সফল করার জন্য কাজ শুরু করলেন। কিন্তু একটি বিষয় আসলে বুঝতে না পেরে ক্রীড়া লেখক সমিতি ওই অনুষ্ঠানে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে (যিনি বর্তমানে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য) বিশেষ অতিথি করায় বিপত্তি বাধে। অনুষ্ঠানের ৩ দিন আগে এ ব্যাপারে টিপু ভাই আমাকে টেলিফোন করে বলেন, ‘সোহাগ, আমিতো মাননীয় প্রধান উপদেষ্টাকে প্রধান অতিথি হতে রাজি করিয়েছি শুধু তোমার অনুরোধে। কিন্তু তোমরাতো একটা ঝামেলা করে ফেলেছো। তোমরা একজন রাজনৈতিক নেতাকে ঐ অনুষ্ঠানে কেন বিশেষ অতিথি করেছো? মাননীয় প্রধান উপদেষ্টাতো একটা নির্দলীয় সরকারের প্রধান এবং তিনিতো কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা মঞ্চে থাকলে সেই অনুষ্ঠানে যেতে পারেন না। ব্যাপারটিতো আমার জন্য খুবই বিব্রতকর হলো।’ আমি তখন সঙ্গে সঙ্গে টিপু ভাইকে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়ে বললাম, ‘টিপু ভাই আপনাকে বিব্রত করে আমরা কোনো প্রোগ্রাম চাই না। আপনি যেটা ভালো মনে করেন, সেই সিদ্ধান্তই আমাদের জানিয়ে দিন।’ দুই ঘণ্টা পর টিপু ভাই আমাকে ফোন করে বললেন, ‘সোহাগ সরি, প্রোগ্রামটা বাতিল করা হয়েছে।’ আরেকটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ সময়ে ফাহিম মুনয়েমকে কানাডায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করা হয়। কিন্তু নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরই রাষ্ট্রদূত হিসেবে ফাহিম মুনয়েমের এই নিয়োগ বাতিল করে দেয়। এ ঘটনার কিছুদিন পরই কলকাতা বিমান বন্দরে দেখা হয় টিপু ভাই’র সঙ্গে। আমরা দেশে ফেরার জন্য কলকাতা দমদম বিমান বন্দরে অপেক্ষা করছিলাম। ফ্লাইট দুই ঘণ্টা বিলম্ব হয়েছিল। তাই এই অলস সময় পুরোটা জুড়েই আমি আর টিপু ভাই আড্ডা মারছিলাম। নানা কথার মাঝে প্রসঙ্গ উঠলো তার রাষ্ট্রদূত নিয়োগ বাতিলের বিষয়টি নিয়েও। এ ব্যাপারে বেশ দৃঢ়তার সাথেই টিপু ভাই আমাকে বললেন, ‘দেখ সোহাগ, আমিতো রাজনীতি করি না, রাজনীতি বুঝিও না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমাকে ওই পদের জন্য যোগ্য মনে করেছিল বলেই আমাকে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল। কিন্তু বর্তমান সরকার কোনো কারণ ছাড়াই আমার ওই নিয়োগ বাতিল করায় সামাজিকভাবে আমি হেয় হয়েছি। বিষয়টি আমার আত্মসম্মানবোধে লেগেছে। কারণ, আমিতো কোনো তদবির করে ঐ নিয়োগ নেইনি।’ এ কথাগুলো বলার সময় ফাহিম মুনয়েম ভাই’র চেহারায় ও কণ্ঠে ভেসে উঠেছিল এক অসাধারণ ব্যক্তিত্বের প্রতিচ্ছবি। ফাহিম মুনয়েমের এই আকস্মিক মৃত্যুতে শুধু মিডিয়া জগৎ নয়, সারা দেশই হারালো একজন অভিজাত, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সজ্জন মানুষকে। আসলে শুধু মিডিয়া জগতেই নয়, আমাদের সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মধ্যেই অভিজাত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সজ্জন ব্যক্তির সংখ্যা দিন দিনই কমে যাচ্ছে, যা সমাজের জন্য এক ভয়াবহ অশনি সংকেত। সব কথার শেষ কথা, আমাদের সকলের প্রিয় ফাহিম মুনয়েম টিপু ভাই আজ আর আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তিনি সব সময় আমাদের হৃদয়ের ভিতরে জাগ্রত থাকবেন তার অসামান্য গুণাবলীর কারণে। তার এই অকাল মৃত্যুতে শুধু তার পরিবার নয়, সারা মিডিয়া জগৎ আজ শোকাহত। আমরা মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করছি আল্লাহ যেন ফাহিম মুনয়েমকে বেহেস্তবাসী করেন। তার পরিবারের সদস্যদের প্রতি জানাই গভীর শোক ও সমবেদনা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।