Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিএনপিকে দেশের আত্মা রক্ষায় উদ্যোগী হতে হবে

প্রকাশের সময় : ৩ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

কামরুল হাসান দর্পণ
বহুদিন পর ফের কথাটি শোনা গেল। রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যখন সমানে সমানে পাল্লা দিত এবং একে অপরকে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ঘায়েল করার চেষ্টা করত, তখন কথাটি শোনা যেত। আওয়ামী লীগকে ঘায়েল করার বিএনপি অসংখ্য কথার মধ্যে যে কথাটি বলত এবং যা তার প্রতি জনগণের ব্যাপক সমর্থন জোগাত, তা হলো ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে দেশ ভারতের কাছে বিক্রি করে দেবে।’ মূলত এটি ছিল বিএনপির ব্যাপক জনসমর্থনের একটি ভিত্তি। দলটিকে যারা সমর্থন ও ভোট দেয়ার মানসিকতা পোষণ করে, তারা বিএনপির এ কথার সাথে খুবই একমত হতো। কারণ তারা দেখেছে, ভারত বাংলাদেশের প্রতি অত্যন্ত বিরূপ আচরণ করে। সীমান্তে পাখির মতো মানুষ হত্যা করে। নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা দেয় না। জোর করে পানি সরিয়ে নেয়। সবসময় দাদাগিরি ফলায়। সর্বোপরি সৎ প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের কাছ থেকে যে আচরণ জনগণ আশা করে, তা ভারত কখনই করেনি এবং করছেও না। এসব বিষয় বিএনপি জনসাধারণের সামনে যখন তুলে ধরত, তখন তা তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হতো। বিএনপিকে তারা সত্যিকার অর্থে জাতীয়তাবাদী শক্তি এবং ভারতের অন্যায় আচরণের শক্ত প্রতিবাদকারী দল হিসেবে বিশ্বাস করে। তাদের মনে এ দৃঢ় বিশ্বাস জন্মায়, ভারতের অন্যায় আচরণের শক্ত প্রতিবাদ একমাত্র বিএনপিই করতে পারতো। বিএনপি সমর্থক এবং দেশের একটি অংশ আওয়ামী লীগকে বরাবরই প্রো-ইন্ডিয়ান বা ভারত সমর্থক হিসেবে মনে করত, এখনো করে। আওয়ামী লীগও এ নিয়ে কোনো আপত্তি করত না। বলা হয়, দলটি ক্ষমতায় টিকে আছে ভারতের সমর্থনের কারণে। দলের নেতাকর্মীদের কথাবার্তায় সব সময় উঠে, আসে ভারত আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু। সে এ বন্ধুত্বের পরীক্ষা দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে। তবে স্বাধীনতা-পরবর্তীতে ভারতের এ বন্ধুত্ব দেশের বেশির ভাগ মানুষ যে ভালোভাবে নেয়নি, তা ভারতবিরোধী দলের ক্ষমতাসীন হওয়া থেকেই বোঝা যায়। বিএনপির একাধিকবার ক্ষমতায় আসার পেছনে এ কারণটি অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালন করে। আমাদের দেশের মানুষের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা একবেলা না খেয়ে স্বাধীনভাবে থাকবে তবু অন্যের খবরদারির নিচে থাকবে না। ভারতের খবরদারি তারা কখনো মেনে নেয়নি এবং যারাই এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, তাদেরকেই সমর্থন দিয়েছে। বিএনপি সাধারণ মানুষের এই নার্ভ ধরতে পেরেছিল বলে বিপুল জনপ্রিয়তা পায় এবং একাধিকবার ক্ষমতায় আসে। তা নাহলে আওয়ামী লীগের মতো প্রাচীন এবং পোড়খাওয়া একটি দলের সঙ্গে ক্ষমতায় যাওয়ার প্রতিযোগিতায় কোনোভাবেই সমকক্ষ হতে পারত না। বিএনপির জাতীয়তা ও দেশাত্মবোধক নীতিই তাকে প্রতিষ্ঠিত এবং টিকে থাকতে মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। এই কয়েক বছর ধরে দলটি যেন তার অবস্থান থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় থাকতে ভারতের সহায়তার কথা বিবেচনা করে সেও নীতিবিচ্যুত হয়ে ভারতের পেছন পেছন ছুটতে শুরু করে। কেন যেন তার মধ্যে এ ধারণা জন্মায় যে, ভারতের সমর্থন ছাড়া ক্ষমতায় যাওয়া যাবে না এবং ভারতকে তোষণ করলেই ক্ষমতায় যাওয়ার পথ মসৃণ হবে। এ স্বপ্ন নিয়ে অন্ধের মতো ভারতের পিছু ছোটা শুরু করে। ভারতের ক্ষমতাসীন অমুক নেতার সাথে কথা বলা থেকে শুরু করে তমুক নেতার একটু সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। দলটি এতটাই বেহাল হয়ে ওঠে যে, সহজ একটি সমীকরণ ও বুঝতে পারে না। বুঝতে পারে না আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ভারত তার চাওয়া যেভাবে পূরণ করতে পারবে বলে বিশ্বাস করে, বিএনপির কাছ থেকে ঐতিহাসিক কারণেই তা আদায় করতে পারবে না। কারণ তার পপুলারিটির অন্যতম ভিত্তিই হচ্ছে এন্টি ইন্ডিয়ান সেন্টিমেন্ট। এই সেন্টিমেন্টের কারণেই ভারতের সব চাওয়া পূরণ করা বিএনপির পক্ষে সম্ভব নয়। নিজের এবং দেশের এই মৌলিক বিষয়টি ভুলেই ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ভারতকে কনভিন্স করতে উঠেপড়ে লাগে। ভারতের মতো ঘাঘু দেশ তার পরীক্ষিত বন্ধু আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে সমর্থন দেবে, এটা বিএনপির নীতিনির্ধারকরা বিশ্বাস করলেও জনগণ কোনো দিনই বিশ্বাস করেনি, এখনো না।
দুই.
ইট ইজ বেটার লেট দ্যান নেভার। বিএনপির ভেতরে এ বিষয়টি মনে হয় একটু একটু করে কাজ করতে শুরু করেছে। ছায়া ও কায়ার পেছনে ছুটতে ছুটতে কিছুটা যেন সম্বিত ফিরে পেতে শুরু করেছে। মূলের দিকে তাকিয়েছে। বুঝতে পারছে, ভারত নামক কায়ার পিছে ছুটে লাভ নেই। তাকে তার মূল শক্তি দেশের স্বার্থ ও মানুষের জাতীয়তাবোধের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। যে জনগণ তাকে বারবার ক্ষমতায় এনেছে শুধু জাতীয়তাবোধ ও পার্শ্ববর্তী দেশের প্রচ্ছন্ন খবরদারি থেকে মুক্ত থাকতে, দেরিতে হলেও বিএনপি যেন সে বোধে ফিরেছে। তার যে বোধোদয় হয়েছে সম্প্রতি তার মুখপাত্রের কণ্ঠ থেকে তা প্রতীয়মান, যা এ সময়ে দেশ ও জাতির স্বার্থে খুবই প্রয়োজন। সম্প্রতি সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে অনেকটা গোপনে ভারতকে নামমাত্র শুল্কে নৌ ট্রানজিট দিয়েছে। এ খবর দুয়েকটি পত্রিকা প্রকাশ না করলে তা দেশের মানুষ জানতই না। যাই হোক, গত ১৫ মে ভারতের কলকাতা থেকে আগরতলায় এক হাজার টন ঢেউটিনের চালানের মাধ্যমে এই ট্রানজিট শুরু হয়েছে। এতে মাশুল ধরা হয়েছে টনপ্রতি মাত্র ১৯২ টাকা। ট্রানজিটের আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বলা যায়, এ মাশুল নস্যি। দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ ব্যাপারটি বিএনপি ধরতে পেরেছে এবং বেশ জোরালোভাবে বক্তব্য দিয়েছে, সেই আগের মতো। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব গত শনিবার এক আলোচনা সভায় বেশ সরব হয়ে সরকারের উদ্দেশে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, ‘কত দামে দেশের স্বাধীনতা বিক্রি করেছেন আপনারা? ২০১০ সালে ৫০ দফা যে চুক্তি করেছেন তার মধ্যে আর কি আছে? এটা দয়া করে বাংলাদেশের জনগণের সামনে বলুন।’ তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘অল্প দাম’ ল্যান্ড ট্রানজিটের সুবিধা দিয়ে সরকার দেশের আত্মা বিক্রি করে দিয়েছে। এ কথাও বলেন, ‘কত নির্লজ্জ হতে পারে এই সরকার, দিনে দিনে সার্বভৌমত্বকে দুর্বল করে দিচ্ছে! মাত্র ১৯৮ (বস্তুত ১৯২) টাকা মাশুল দিয়ে ভারতে ট্রানজিট যাবে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে। অথচ এখানকার এই ট্রানজিট কমিশনে যারা কাজ করেছেন, তারাও ফি নির্ধারণ করেছিলেন ১০৫৮ টাকা। সেটাকে অগ্রাহ্য করে সরকার নিজের ইচ্ছায়, নিজের ক্ষমতায় ১৯৮ টাকা করেছে। কী গভীর প্রেম!’ তিনি আরও বলেন, ‘নামকাওয়াস্তে ফি দিয়ে বিভিন্ন সরঞ্জাম যাবে ভারতে। এটা একেবারে দুরভিসন্ধিমূলক এবং এটা অল্প দামে দেশের স্বাধীনতা বিক্রি করে দেয়া। আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই, সরকার আত্মাকে বিক্রি করে দিয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশের কাছে।’ বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও মুখপাত্রের এ বক্তব্যে দেশ ও জনগণের স্বার্থ এবং মনের কথাই ফুটে উঠেছে। সেই সঙ্গে এটাও প্রতীয়মান হয়েছে, বিএনপি নামক জাতীয়তাবাদী দলটির মূল যে শক্তি তাতে ফিরতে শুরু করেছে। সরকারের দমন-পীড়নের ঝড়ে ল-ভ- হয়ে যাওয়া এবং ক্রমাগত চাপের মধ্যে থেকে অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামের মধ্যে থেকেও যে সাহস করে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চেতনার কথা বলতে পেরেছে যা এত দিন বলতে পারছিল না, এ জন্য নিঃসন্দেহে দলটি প্রশংসার দাবিদার। মানুষের কাছে বিএনপির এ কথা, প্রচ- ঝড়ের মধ্যেও অবিচলভাবে জাহাজের হাল ধরে থাকা ক্যাপ্টেনের মতোই মনে হবে। দেশের সাধারণ মানুষও বুঝতে পারবে বিএনপি দেশের স্বার্থেই কথা বলেছে। এ কথা অনস্বীকার্য, বিশ্বায়নের এ যুগে আগের দিনের মতো কোনো আগ্রাসী শক্তি সৈন্য-সামন্ত নিয়ে অন্য দেশ দখল করতে যায় না। এখন এই কৌশল পরিবর্তিত হয়ে অর্থনৈতিক আগ্রাসনে পরিণত হয়েছে। বলাবাহুল্য, একটি দেশের সৌল বা আত্মা হচ্ছে তার অর্থনীতি। এটাই তার প্রাণভোমরা। এই আত্মা বা প্রাণভোমরা যদি কব্জা করা যায় বা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যাওয়া যায়, তাহলে দেশ আত্মাছাড়া শূন্য খাঁচায় পরিণত হয়। ভারত যে বাংলাদেশকে একটি আত্মাহীন খাঁচায় পরিণত করার প্রক্রিয়ায় রয়েছে, অনেকেই তা উপলব্ধি করে। তাদের উপলব্ধ কথা রুহুল কবীর রিজভীর কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। তথাকথিত দলদাস বুদ্ধিজীবীদের বাইরে থাকা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মাঝে মাঝে সাহস করে কিছু নিরেট সত্য কথা বলে ফেলেন। তিনি এ সাহস পান এ কারণে যে, দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন এবং জীবন দেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। যুদ্ধ করতে করতে বেঁচে গেছেন এবং বেঁচে আছেন বলে তার মৃত্যু বা গুম, খুন হওয়ার ভয় নেই। ফলে অকপটে দেশ ও জনগণের স্বার্থ ক্ষুণœ হওয়ার মতো ঘটনার বিরুদ্ধে কথা বলেন। গত ২৬ মে ঢাকায় গুম হওয়া মানুষের পরিবারের আয়োজনে এক মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করে তিনি বলেছেন, ‘ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ বাংলাদেশে বিভিন্ন অকারেন্স ঘটিয়ে, নেপালসহ ভারতের আশপাশের দেশগুলোর মতো বাংলাদেশের ওপরও নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করছে।’ যারা বাংলাদেশের প্রতি ভারতের আচরণের বিষয়টি দেশাত্মবোধ থেকে নির্মোহ দৃষ্টিতে বিচার করেন, তারা স্বীকার করবেন, ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী কথাটি হয়তো এমনি এমনি বলেননি। তার হয়তো ভিত্তি রয়েছে। যদি নাই থাকত তবে এ প্রসঙ্গে কথা বলার কোনো প্রয়োজন পড়ত না। একজন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি বিষয়টি ‘ফিল’ করেছেন। যে কথা বলছিলাম, একটি দেশকে নতজানু রাষ্ট্রে পরিণত করতে এখন আর ভূখ-গতভাবে দখল করার প্রয়োজন নেই। দেশের আত্মা অর্থনীতি দখল করতে পারলেই সে দেশ এমনিতেই মাথা নুইয়ে হুজুর হুজুর শুরু করে। আমরা দেখেছি, গত বছর সেপ্টেম্বরে নেপালে সংবিধান সংশোধন নিয়ে ভারত নাখোশ হয়ে কী তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। শেষ পর্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে নেপালে খাদ্যবাহী পরিবহন বন্ধ করে দেয়। এতে নেপালের জনগণ এক অবর্ণনীয় দুর্ভোগের মধ্যে পড়ে। তাদের না খেয়ে মরার উপক্রম হয়। এর কারণ যে নেপালের আত্মা ভারতের হাতে অনেকটা বন্দি হয়ে আছে, তা এ ঘটনা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না।
তিন.
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, লেখক, গবেষক ও বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন বলেছিলেন, ‘Those who would give up Essential Liberty to purchase a little Temporary Safety, deserve neither Liberty nor Safety.’ অর্থাৎ যে সাময়িক ক্ষুদ্র নিরাপত্তা বা টিকে থাকার স্বার্থে তার প্রয়োজনীয় স্বাধীনতা বিকিয়ে দেয়, সে না স্বাধীনতার যোগ্য না নিরাপত্তার যোগ্য। কথাটি এ কারণে অবতারণা করলাম যে, আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এখন এমন একটা মানসিকতা ও প্রবণতা লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠেছে। বলাবাহুল্য, দেশের সাধারণ মানুষ সাধারণত দুই দিকে তাকিয়ে থাকে। এক. ক্ষমতাসীন দলের দিকে। দুই. ক্ষমতার বাইরে বিরোধী দলের দিকে। এই দুই দলের নীতি-এজেন্ডা এবং রাজনৈতিক কর্মকা- দ্বারা তারা প্রভাবিত হয়। তাদের কথা বিশ্বাসও করে। এ ছাড়া তাদের উপায়ও নেই। কারণ তারাই দেশ পরিচালনা করে এবং পর্যায়ক্রমে করবে। ফলে জনগণের স্বাভাবিক বিশ্বাস, তাদের স্বার্থের বাইরে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো যাবে না এবং তাদের স্বার্থ রক্ষায় অবিচল থাকবে। এখন এই দুই বিপরীত ধারার দিকে যদি তাকানো যায়, তবে জনগণ দেখবে ধারা দুটি তাদের স্বার্থের চেয়ে নিজেদের ক্ষমতায় থাকা ও যাওয়ার স্বার্থকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। এ জন্য যা করা দরকার তা করতে কোনো দ্বিধা করছে না। সরকারের দিকে যদি দৃষ্টি দেয়া যায়, তবে দেখা যাবে তার মধ্যে এ প্রবণতা বেশি। এ কথা সবাই জানেন, বর্তমান সরকার জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত ভোটে নির্বাচিত হয়নি। তার জনগণের ভোটের প্রয়োজন হয়নি। এ সরকারকেই ভারত অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। বলা হয়, ভারতের সমর্থনের কারণে সরকার টিকে আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ভারতের কী এমন ঠেকা পড়েছে যে এ সরকারকে টিকিয়ে রাখতে হবে? এতে তার স্বার্থ কি? এখানেই মূল বিষয়। বর্তমান যুগ চলছে গিভ অ্যান্ড টেক নীতির ওপর। এ যুগে বিনা স্বার্থে কেউ কাউকে কিছু দেয় না। পারস্পরিক লেনদেনের মাধ্যমেই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখে। বর্তমান সরকারের পক্ষে ভারত এককভাবে শক্ত অবস্থান বিনা স্বার্থে নেয়নি। এতে তার অনেক স্বার্থ রয়েছে। এখানেও গিভ অ্যান্ড টেকের বিষয়টি রয়েছে। এক্ষেত্রে ভারত সরকারকে দিয়েছে ক্ষমতায় টিকে থাকার গ্যারান্টি, এর বিনিময়ে আদায় করে নিয়েছে তার সব চাওয়া। সাধারণ মানুষ মনে করে, সরকার ক্ষমতায় থাকার ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য দেশের বৃহৎ স্বার্থ বিসর্জন দিয়েছে। এখানেই বেঞ্জামিনের কথাটি এসে যায়। জনগণ ইতোমধ্যে দেখেছে ভারত তার চাওয় কড়ায়-গ-ায় আদায় করে নিয়েছে। ভারত যেভাবে চেয়েছে সরকারও অতি বিনয়ী হয়ে বিনাবাক্যে দিয়ে দিয়েছে। ভারতের অনেক চাওয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড় চাওয়া ছিল ট্রানজিটের নামে করিডোর। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে সহজে তার এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে মালামাল নিয়ে যাওয়া। বাংলাদেশের রাস্তাঘাট ও বন্দর ব্যবহার করে এই মালামাল নিতে যে মাশুল (টনপ্রতি ১০৫৮ টাকা) বাংলাদেশ ধার্য করেছিল, তা ভারত দিতে রাজি হয়নি। সে বলেছে ১৯২ টাকার ওপর দেবে না। সরকারও তা মেনে নিয়েছে। এর ফলে ট্রানজিটের নামে বাংলাদেশ যে করিডোর দিল তার নেতিবাচক ফলাফল কত ব্যাপক, তা যেমন বলে শেষ করা যাবে না, তেমনি নামমাত্র মাশুল ধার্য করে অর্থনৈতিকভাবে যে কত ক্ষতিগ্রস্ত হলো, তাও বলে শেষ করা যাবে না। অথচ বাংলাদেশের চাওয়া খুব বেশি নয়। একটিই চাওয়া, যৌথ নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা। পানির অভাবে বাংলাদেশ জীবনমরণ সমস্যার মুখোমুখি। অথচ সরকার তার কোনো সমাধান করতে পারেনি। তিস্তা চুক্তিটিও করতে সক্ষম হয়নি। উল্টো বলে দিয়েছে, আমাদের কিছু করার নেই। এটি এখন ভারতের মর্জির ওপর নির্ভর করছে। এ-তো পানির কথা গেল। অর্থনীতিতে ভারত যে থাবা মেলে ধরেছে, তা আরও ভয়াবহ। বাংলাদেশে লাখ লাখ বেকার থাকলেও ভারত থেকে ব্যাপক লোকের কর্মসংস্থান এখানে করা হচ্ছে। বলা হয়, ভারতের ফরেন রেমিট্যান্স আয়ের দ্বিতীয় বৃহৎ দেশ বাংলাদেশ। আবার ভারতের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতিও আকাশ আর পাতাল। এই ঘাটতি ৩৫৭ কোটি ডলার। ঘাটতি পূরণেও ভারত কোনো সুযোগ দিচ্ছে না। একজন সাধারণ মানুষও জানে, তাদের প্রতিদিনই ভারতীয় পণ্য কিনতে হয়। চকলেট-বিস্কুট, টুথ পেস্ট, চাল, ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, ফল-ফলাদি, কাপড়-চোপড় থেকে শুরু করে এমন কিছু বাকি নেই, যা ভারতীয় নয়। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, ভারত কীভাবে আমাদের অর্থনৈতিক আত্মা গ্রাস করে চলেছে। শুধু অর্থনৈতিক আত্মাই নয়, রাজনৈতিক আত্মাও প্রচ্ছন্নভাবে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে।
চার.
বিএনপি মুখপাত্রের ভাষায় বাংলাদেশের আত্মা বিকিয়ে দেয়ার এ প্রবণতা থেকে কীভাবে রক্ষা পাওয়া যাবে? এ প্রশ্ন এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ ভারতের যা চাওয়ার ছিল, তা সরকার মিটিয়ে দিয়েছে। এখন বাংলাদেশের ন্যায্য প্রাপ্য আদায় করা আদৌ সম্ভব হবে কিনা, তা অনিশ্চিত। তবে ভারত বাংলাদেশের সাথে যে আচরণ করেছে এবং করছে, তা কোনোভাবেই মর্যাদাপূর্ণ নয়। সরকার কথায় কথায় বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে যে কথা বলছে, তা কতটা যুক্তিযুক্ত দেশের সাধারণ মানুষের বুঝতে বাকি নেই। পার্শ্ববর্তী দেশের কাছে আমাদের মর্যাদা কতটুকু, তাও তারা বুঝতে পারছে। এক ক্রিকেট নিয়ে দেশটি আমাদের সাথে কীভাবে তাচ্ছিল্য করেছে, তা তারা দেখেছে। তারা এটাও বুঝতে পারছে, ভারত তার দাদাগিরি দিয়ে বাংলাদেশ থেকে সব কিছু আদায় করে নিয়েছে। বিনিময়ে আমরা কিছুই পাইনি। এ ধরনের আচরণ কোনোভাবেই সমমর্যাদার পর্যায়ভুক্ত হতে পারে না। পাশের দেশের সাথে যেখানে আমরা যথাযথ মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করে ন্যায্য দাবি আদায় করতে পারিনি, সেখানে সারা বিশ্বে মর্যাদার কথা বলা প্রবঞ্চনা ছাড়া কিছু নয়। দেশের মানুষের এই সেন্টিমেন্টের সাথে একাত্মতা প্রকাশের তেমন কোনো শক্তি বলতে নেই। তারপরও পথহারা এবং মূলভিত্তিচ্যুত হয়ে পড়া বিএনপির মুখপাত্রের মুখ থেকে অনেক দিন পর দেশের মানুষ ভারতের অন্যায্য আচরণের কথা শুনেছে। সাধারণ মানুষ আশা করে, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ভারত তোষণ নয়, বরং দেশের স্বার্থ ও জাতীয়তাবোধকে বিএনপি আঁকড়ে ধরবে। ইতোমধ্যে বিভ্রান্ত হয়ে ভারতের তোষণ করতে গিয়ে দলটি যে ব্যর্থ হয়েছে, তা পরিষ্কার হয়ে গেছে। এ সস্তা পথে ক্ষমতায় যাওয়ার আশায় গুড়েবালি পড়েছে। সে যদি বুঝে থাকে, তবে তার যে মূলভিত্তি জাতীয়তাবাদ এবং ভারতের দাদাগিরির প্রতিবাদ করা, সেদিকেই ফিরে যেতে হবে। বিএনপিকে নিজস্ব শক্তিতে বলীয়ান হতে হবে। এই শক্তির মূল উৎস দেশের জনগণ। এটাই হবে বিএনপির ঘুরে দাঁড়ানোর মূল এবং স্থায়ী শক্তি। কালবিলম্ব না করে এখনই তাকে বাংলাদেশের আত্মাকে ধারণ এবং নিরাপদ রাখার চেষ্টায় জোরালোভাবে নিয়োজিত হতে হবে। মনে রাখতে হবে, জনগণের মন বুঝে তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারলে পৃথিবীর কোনো শক্তিই বাংলাদেশের সাথে অন্যায় আচরণ করতে সাহস পাবে না। বাংলাদেশের জনগণের এ ইতিহাস ও বৈশিষ্ট্য স্মরণ করতে হবে, তারা ন্যায্য অধিকারের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হতে সময় নেয় না এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে এতটুকু পিছপা হয় না। দ্বিধা করে না।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিএনপিকে দেশের আত্মা রক্ষায় উদ্যোগী হতে হবে
আরও পড়ুন