পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
সিলেট-আখাউড়া সেকশনের কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল স্টেশন সংলগ্ন বড়ছড়া ৯ নং রেল ব্রিজের ওপর গত রোববার রাত পৌনে ১২টায় স্মরণকালের ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে সিলেট থেকে ঢাকাগামী আন্তঃনগর উপবন এক্সপ্রেস ট্রেন। এতে ঘটনাস্থলেই ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং আহত হয়েছে দুই শতাধিক যাত্রী। এ ঘটনায় ঢাকার সাথে সিলেটের ট্রেন যোগাযোগ ১৯ ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর গতকাল সন্ধ্যা ৭টা ১০ মিনিটে ফের চালু হয়। এর আগে গত ৬ দিন ধরে সড়কপথেও সিলেটের সাথে ঢাকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থেকে চালু হয় গতকাল দুপুরে। সড়কের পর রেলপথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় যাত্রীরা পড়েন বিপাকে।
রেল সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন গতকাল সোমবার সকাল ৮টায় সরেজমিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে দু’টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এদিকে আন্তঃনগর উপবন এক্সপ্রেস ট্রেন রাত ৩টায় দুর্ঘটনাস্থলে ৭টি বগি রেখে ৬টি বগি কিছু যাত্রী নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে কুলাউড়া স্টেশন ছেড়ে যায়। এছাড়া ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা আন্তঃনগর উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনটি কুলাউড়া স্টেশনে আসার পর সিলেটের যাত্রীদের নামিয়ে দেয়। পরে যাত্রীরা সড়কপথে সিলেটে যান। গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় কুলাউড়া জংশন স্টেশন থেকে কুলাউড়া-ঢাকা ও কুলাউড়া-চট্টগ্রামের উদ্দেশে ট্রেন চলাচল শুরু হওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
নিহতদের পরিচয় : নিহত ৪ যাত্রীর মধ্যে ৩ জন নারী ও একজন পুরুষ। তন্মধ্যে কুলাউড়া পৌরসভার টিটিডিসি এরিয়ার বাসিন্দা ও ঠিকাদার আব্দুল বারীর স্ত্রী মানোয়ারা পারভীন (৪৮)। সিলেটের মোগলাবাজারের আব্দুল্লাহপুর গ্রামের আব্দুল বারীর মেয়ে ফাহমিদা ইয়াসমিন ইভা (২০) ও বাগেরহাট জেলার মোল্লারহাট থানার ভান্ডারখোলা গ্রামের আকরাম মোল্লার মেয়ে সানজিদা আক্তার (২০)। এরা দু’জন সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের নার্সিং ইনস্টিটিউটের ছাত্রী। নিহত পুরুষ যাত্রী মো. কাউছার আহমদ (২৬) ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাছিরনগর উপজেলার ধরমন্ডল গ্রামের মরহুম নুর হোসেনের ছেলে। কাউছারের মা ২ বছর ও বাবা ১ বছর আগে মারা গেছেন। তার খালা হাজেরা বেগম গতকাল লাশ গ্রহণ করেন। নিহত ৪ জনেরই লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
আহতরা কুলাউড়া হাসপাতাল, ব্রাহ্মণবাজার মুসলিম এইড হাসপাতাল, মৌলভীবাজার সদর হাসপাতাল ও সিলেট ওসমানী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
দুর্ঘটনা নিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য
বরমচাল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ইছহাক চৌধুরী ইমরান, প্রভাষক মো. আলী তরিক, প্রভাষক আহসান মিরাজ, পারভেজ আহমদ, সুলতান আহমদ ও ভাটেরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সৈয়দ এ কে এম নজরুল ইসলাম জানান, রাত আনুমানিক ১১টা ৪০ মিনিটে আন্তঃনগর উপবন এক্সপ্রেস ট্রেন বরমচাল স্টেশন অতিক্রম করার পরপরই এক বিকট শব্দ শোনা যায়। সাথে সাথে মানুষের আর্তচিৎকার শুরু হয়। দুর্ঘটনা বুঝতে পেরে সাথে সাথে স্থানীয় কালা মিয়া বাজারের মসজিদের মাইকে ট্রেন দুর্ঘটনার ঘোষণা দেয়া হয় এবং স্থানীয় লোকজনকে উদ্ধার কাজে অংশ নেয়ার আহ্বান জানানো হয়। সাথে সাথে আশপাশের শত শত মানুষ ঘুম থেকে জেগে দুর্ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন এবং উদ্ধার কাজে অংশ নেন।
এদিকে দুর্ঘটনাকবলিত বগির প্রায় ৩৫ জন যাত্রী রাতে আশ্রয় নেন বরমচাল টিকরা জামে মসজিদে। স্থানীয়দের মতে, অতিরিক্ত যাত্রীর কারণেই ট্রেনটি দুর্ঘটনাকবলিত হয়েছে। এতে বড়ছড়া নামক পাহাড়ী ছড়ার ওপর নির্মিত ৯ নং রেল ব্রিজটির ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে রেল কর্মচারীদের মতে, রেলের প্রতিটি ব্রিজ মেরামতে লাখ লাখ টাকার দুর্নীতি হয়ে থাকে। কোনো ব্রিজই সঠিকভাবে নিয়ম মেনে করা হয় না। দুর্ঘটনাকবলিত ব্রিজটি কয়েক মাস আগে মেরামত করা হয়। সে সময় সঠিকভাবে কাজ করা হয়নি বলে রেলওয়ে কর্মচারীদের অভিযোগ।
উদ্ধার কাজে অংশগ্রহণকারীরা
ট্রেন দুর্ঘটনার খবর পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে রেলওয়ে নিরাপত্তা পুলিশ, কুলাউড়াসহ মৌলভীবাজারের বিভিন্ন থানা পুলিশ, সহকারী পরিচালক মো. শাহজাহানের নেতৃত্বে ২ প্লাটুন বিজিবি, র্যাব এবং উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে কুলাউড়া, মৌলভীবাজার ও সিলেটের ফায়ার সার্ভিসের ১১টি ইউনিট রাতে উদ্ধার কাজে অংশ নেয়। মাঝরাতে ঘন অন্ধকার থাকায় উদ্ধারকারী দল সাময়িক ট্রেনের বগিগুলোতে উদ্ধার কাজ বন্ধ রাখে। সকালবেলা পুনরায় উদ্ধার কাজ শুরু করলেও কোনো হতাহত ব্যক্তিকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। গতকাল সোমবার সকাল ৯টায় আখাউড়া থেকে উদ্ধারকারী রিলিফ ট্রেন দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছে ছিটকে পড়া বগি উদ্ধার কাজ শুরু করে।
ট্রেন যাত্রীদের বক্তব্য
দুর্ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে সিলেটের ফটোগ্রাফার কে এম এ তাহের বলেন, আমি সিটে বসা, হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন যাত্রী আমার গায়ের ওপর পড়েন। বিকট শব্দ ও কান্নার আওয়াজ শুনি। ভাগ্যিস জানালার পাশে ছিলাম, ঝুলন্ত বগি থেকে কোনো রকম মাথাটা বের করে পা বাড়ালে দেখি আমি পানিতে। জাহেদ মিয়া, আলম মিয়া, মাসুদ আহমেদ, তোফায়েল, মিজানুর, আব্দুর রশীদ বলেন, চোখে ঘুম ঘুম ভাব, হঠাৎ ভূমিকম্পের মতো মনে হলো। কী যেন আমাদেরকে ট্রেনের পেছন দিক দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এর পরই বিকট শব্দের পর আমরা দেখি রেললাইনের পাশের জমিতে পড়ে আছি। সাথে সাথে আমাদের সাথে থাকা শিশু ও মহিলাদের আর্তনাদ শুনে উদ্ধার কাজে লেগে যাই।
ওদিকে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনাকবলিত আন্তঃনগর উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনের বগির যাত্রী পাবনার মো. আল আমিন ও মো. সম্রাট পারভেজ জানান, তারা ১৪ জন মিলে সিলেটে মাজার জিয়ারতে আসেন। সড়কপথ বন্ধ থাকায় তারা ট্রেনের টিকিট কেটে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। দুর্ঘটনার পর ভয়ে তারা ট্রেন থেকে নেমে টিকরা জামে মসজিদে আশ্রয় নেন। মসজিদে রাত কাটান। ভোর ৭টায় তারা সড়ক পথে আবার ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। তারা ক্ষোভের সাথে জানান, এটা কোন ধরনের ট্রেন হলো। টিকিট কেটে সিটে বসলাম। কিন্তু কাঁধের ওপর লোক দাঁড়িয়ে ছিল। ট্রেনের টিকিটধারী যাত্রীর চেয়ে দ্বিগুণ যাত্রী ছিল দাঁড়ানো। আর যাত্রা শুরুর পর ট্রেনটি খুবই দ্রুত গতিতে চলছিল। তখনই মনে হয়েছিল, কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিকট শব্দে বগিটি ব্রিজ থেকে ছিটকে নিচে পড়ে যায়।
ঘটনা তদন্তে পৃথক দু’টি তদন্ত কমিটি গঠন
আন্তঃনগর উপবন এক্সপ্রেস দুর্ঘটনাকবলিত হওয়ায় দু’টি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে বলে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন জানান, রেলওয়ের চিফ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (পূর্বাঞ্চল) মো. মিজানুর রহমানকে কমিটির প্রধান করে ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- চিফ ইঞ্জিনিয়ার আবদুল জলিল, চিফ পিএসপি মইনুল ইসলাম, চিফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট (সিওপিএস) চিফ সুজিত কুমার। অপরদিকে কেন্দ্রীয় তদন্ত কমিটির ৫ সদস্য হলেন- চিফ সিগন্যাল অ্যান্ড কমিনিউকেশন মঈনুল ইসলাম, সিওপিএস সুজিত কুমার, রেলওয়ের মহাপরিচালক কাজী রফিকুল আলম, অতিরিক্ত সচিব মো. মুজিবুর রহমান, চিফ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার মিজানুর রহমান।
দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন
দুর্ঘটনার খবর পেয়ে গত রোববার রাতে তাৎক্ষণিকভাবে সিলেটে বিভাগীয় কমিশনার মেজবাহ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী, মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মো. তোফায়েল ইসলাম, মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার মো. শাহজালাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
এদিকে ট্রেন দুর্ঘটনার পর রাত কিংবা পরদিন সকাল ৮টা পর্যন্ত দুর্ঘটনাস্থলে রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তার দেখা মেলেনি। বেলা ১২ নাগাদ কুলাউড়া রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন প্রকৌশলী জুয়েল হোসাইন মোবাইল ফোনে জানান, প্রায় ২শ’ মিটার রেলপথ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সকাল থেকে ২ শতাধিক শ্রমিক মেরামত কাজ করছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত রেললাইন মেরামত কাজ সম্পন্ন হবে।
কুলাউড়া হাসপাতালের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. নূরুল হক জানান, রাত ১২টা থেকে সোমবার ৩টা পর্যন্ত ৬৭ জনকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৪ জন নিহত। তবে কুলাউড়া ফায়ার সার্ভিস সূত্র আহত ৬৭ জন জানালেও নিহত ৫ জন দাবি করছে।
মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার মো. শাহজালাল জানান, দুর্ঘটনার সাথে সাথে স্থানীয় লোকজন ও জনপ্রতিনিধিরা উদ্ধার কাজে অংশ নেয়। পরবর্তীতে খবর পেয়ে মৌলভীবাজারের প্রায় সব ক’টি থানার পুলিশ উদ্ধার কাজে অংশ নেয়।
মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মো. তোফায়েল ইসলাম জানান, ট্রেন দুর্ঘটনার কারণ জানা যায়নি। ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয়েছে। রেলওয়ের স্পেশালিস্ট ছাড়া দুর্ঘটনার কারণ নিরূপণ করা যাবে না।
সিলেট বিভাগীয় কমিশনার মো. মেজবাহ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী জানান, যত দ্রæততম সময়ের মধ্যে সম্ভব রেললাইন মেরামত করে যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন জানান, সোমবার সন্ধ্যা থেকে কুলাউড়া-ঢাকা ও কুলাউড়া-চট্টগ্রামের উদ্দেশে ট্রেন চলাচল শুরু হবে।
৩০০ প্রাণ বাঁচালেন মঈন
কুলাউড়ার বরমচাল রেলক্রসিং এলাকায় গত রোববার রাতে ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটনা ঘটে। এ সময় ২টি বগি লাইনচ্যুত হয়ে খালের মধ্যে ছিটকে পড়েছে। আর ৩টি বগি লাইনচ্যুত হয়ে রেললাইন বেঁকে যায়। ৯৯৯ নম্বরে ফোন দিয়ে পুলিশকে এমন ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার খবর জানান মঈন উদ্দিন নামে এক যুবক। এর ফলে প্রাণহানি থেকে বাঁচল ৩০০ যাত্রী।
এ ব্যাপারে কুলাউড়া থানার অফিসার ইনচার্জ ইয়ারদৌস হাসান বলেন, রাত ১২টার কিছুক্ষণ আগে এক ব্যক্তি ৯৯৯ নম্বরে ফোন দিয়ে ট্রেন দুর্ঘটনার খবর জানায়। দুর্ঘটনার পরপরই ওই যুবক ৯৯৯ নম্বরে ফোন না দিলে বড় ধরনের ঘটনা ঘটত। খবর পেয়ে তখনই ঘটনাস্থলের উদ্দেশ্য রওনা দেই আমরা। ওসি বলেন, হতাহতদের উদ্ধারে কাজ করেছে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও বিজিবি। ট্রেনের অন্য যাত্রীদেরও নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেয়া হয়েছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।