Inqilab Logo

সোমবার ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮ আশ্বিন ১৪৩১, ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

ধান জীবন ধানই মরণ

কৃষকের হাহাকার সর্বত্র

প্রকাশের সময় : ২ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:১৭ এএম, ২ জুন, ২০১৬

স্টালিন সরকার : ধান কৃষকের জীবন। ধানই যেন হয়ে উঠেছে কৃষকের মরণ। ধানের ফলন খারাপ হলে বিপদ; বাম্পার ফলন হলে মহাবিপদ। কোন দিকে যাবে দেশের ১ কোটি ৮০ লাখ কৃষক? দেশের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ কৃষিনির্ভর। অথচ তাদের দিকে তাকানোর কেউ নেই।
কৃষকের স্বার্থের অজুহাতে রাজনৈতিক দলগুলো নানা ফন্দি-ফিকির প্রচার করে। রাজনৈতিক দলগুলো ভোটের চিন্তা মাথায় রেখে ‘কৃষক শব্দ’ নামে সংগঠন করে কৃষক বান্ধবের ভান করে। আওয়ামী কৃষক লীগ, জাতীয়তাবাদী কৃষক দল, জাতীয় কৃষক পার্টি কৃষকের স্বার্থে কি করছে? এ সংগঠনগুলো কার্যত বড় দলগুলোতে শোপিছ। সিপিবি-বাসদের কৃষক-ক্ষেতমজুর সংগঠনগুলো ধানের ন্যায্য মূল্যের দাবিতে সারাদেশে কর্মসূচি পালন করলেও বড় দলগুলোর কৃষক সংগঠনগুলো শ্বেতহস্তির মতো দাঁড়িয়েই রয়েছে।
কৃষিমন্ত্রী নিজেকে সফল দাবি করেন। সভা-সমাবেশে লাফিয়ে লাফিয়ে কৃষকের স্বার্থের কথামালা শোনান। তিনি কি ধান নিয়ে দেশের কৃষকের দুর্দশার খোঁজ নিয়েছেন? শুধু লোক দেখানো কথা বলে মিডিয়া কভারেজ পাওয়া যায় সত্য; তাতে কৃষকের উপকার হয় না; লাখ লাখ কৃষকের চিন্তায় মুখের ভাঁজ যায় না। মে মাসের প্রথম দিকে ধানের দর ৯২০ টাকা মণ বেঁধে দিয়ে ৫ মে থেকে ক্রয়ের কার্যক্রম শুরুর ঘোষণা দিয়েছে সরকার। মিডিয়া সে খবর ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু এক মাস হয়ে গেলেও সরকারি পর্যায়ে ধান ক্রয় শুরু হয়নি। বাধ্য হয়েই কৃষকরা প্রতিমণ ধান বিক্রী করছেন ৪শ’ থেকে সাড়ে ৪শ’ টাকায়। এলাকা ভেদে এবার প্রতিমণ ধান উৎপাদন খরচ ৬শ’ টাকা থেকে ৭শ’ টাকা পড়লেও লোকসান দিয়েই ধান বিক্রী করছে কৃষকরা। দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলার দাবিদার মন্ত্রী কি দেখছেন যে, বাম্পার ফলনের পরও ধানে লোকসানে কৃষকরা চোখের পানি ফেলছেন। রাস্তায় ধান ফেলে প্রতিবাদ করছেন। সচিত্র সে খবর টিভি ও পত্র-পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে।
 খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কৃষিমন্ত্রী-খাদ্যমন্ত্রী কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয়ের ঘোষণা দিয়ে তা মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করার পরও কোথাও সরকারি গুদামে কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয় শুরু হয়নি। নেপথ্যের কারণ কি? পর্দার আড়ালের খবর হলো মন্ত্রীর ঘোষণার পরও সরকারি গুদামগুলো কৃষকের কাছ থেকে ধান নিচ্ছে না। কারণ কৃষক এখন যে ধান কম দামে বিক্রী করছে সেগুলো কিনছে মধ্যস্বত্বভোগ কিছু ব্যবসায়ী ও ক্ষমতাসীন দলের জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। গুদাম, লোভাতুড় ব্যবসায়ী, চালকল মালিক ও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। কৃষকের ধান বিক্রী শেষ হলেও সরকারি গুদাম বেঁধে দেয়া মূল্যে ধান ক্রয় শুরু করবে এবং সে টাকা চলে যাবে সি-িকেটের পকেটে। যারা ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনে সরকারকে ক্ষমতায় আনতে সহায়তা করেছে সেই নেতাকর্মীদের সুবিধা দিতেই এই কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলার কয়েকজন কৃষক ও সংশ্লিষ্ট কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে। প্রশ্ন হলো ৫ জানুয়ারী ভোট দিতে না পারায় দায় কি কৃষকের? রাজনীতির যাঁতাকলে তাদের বলীর পাঁঠা বানানো হচ্ছে কেন?
গতকাল ইনকিলাবে ছবিসহ খবর বের হয়েছে রংপুরের মাহিগঞ্জের সাতমাথায় ঢাকা-কুড়িগ্রাম মহাসড়কে বস্তায় বস্তায় ধান ফেলে কৃষকরা প্রতিবাদ করছেন। বিক্ষুব্ধ কৃষকরা দাবি জানিয়েছেন তাদের কাছ থেকে সরাসরি গুদামে ধান ক্রয় করতে হবে। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং নানা অজুহাতে সরকার ঘোষণা দিয়েও কৃষকের কাছ থেকে ধান নিচ্ছে না। ফলে রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে ফসল ফলানো ধান হয়ে গেছে কৃষকের গলার ফাঁস। প্রতিমণ ধানে কৃষককে লোকসান দিতে হচ্ছে ২শ’ থেকে ৩শ’ টাকা। আবার ভরামৌসুমে ভারত থেকে চাল আমদানী করা হচ্ছে। গত ১০ মাসে একমাত্র হিলি বন্দর দিয়ে ভারত থেকে ৩২ হাজার ৮৬৩ মেট্রিকটন চাল আমদানী করা হয়েছে। অথচ ৩১ মে খাদ্যমন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেছেন, বাংলাদেশ চাল আমদানী নয়; রফতানি করে থাকে। শ্রীলংকায় চাল রফতানির পর আফ্রিকার দেশগুলোতে চালের বাজার খোঁজা হচ্ছে। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী তার স্বভাবসুলভ ভাষায় দাবি করেছেন, কৃষকের কাছ থেকেই ধান ক্রয় করা হচ্ছে। তারা কি সারাদেশের প্রকৃত চিত্র জেনে এ দাবি করছেন? নাকি ফাঁকা বুলি আওড়াচ্ছেন? মন্ত্রী ঘোষণা দিয়ে ধান ক্রয়ের নির্দেশনা দেয়ার পরও কেন সরকারি গুদামে ধান ক্রয় শুরু হয়নি? মন্ত্রী বড় না গুদামের কর্মচারীরা?
 বোরো ধান কাটার মৌসুম প্রায় শেষ। ধানের বাম্পার ফলন হলেও কৃষকের মুখে হাসি নেই। এক মণ ধান উৎপাদনে প্রায় ৬শ’ টাকা খরচ হলেও এলাকা ভেদে প্রতিমণ ধান বিক্রী হচ্ছে ৩৫০ টাকা থেকে ৪২০ টাকা। বাজারে সোয়া একমণ ধানে এক কেজি গরুর গোশত এবং ৩ মণ ধানে এক কেজি ওজনের একটি ইলিশ বিক্রী হচ্ছে। অথচ সরকার নিজেদের কৃষিবান্ধব প্রমাণের জন্য প্রতিমণ ধানের মূল্য বেঁধে দিয়েছে ৯শ’ ২০ টাকা। দাম বেঁধে দিয়েই কি সরকারের দায়িত্ব শেষ? গুদামগুলো ধান ক্রয় না করায় মরণদশায় পড়েছেন সারাদেশের কৃষকরা। কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যাংকের কৃষিঋণ সহজলভ্য না হওয়ায় এবং ঘুষ ছাড়া ঋণ না পাওয়ায় অধিকাংশ কৃষক বাধ্য হয়েই আগাম দাদন নিয়েই ধান চাষ করেছে। মহাজনের সেই টাকা পরিশোধ করতে লোকসান হলেও ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে সারা দেশে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হলেও হাসি নেই কৃষকের মুখে।
মন্ত্রী, এমপিদের বেতন বাড়ে; সরকারি কর্মচারীদের বেতন দ্বিগুণ হয়; অথচ কৃষকের দিকে তাকানোর যেন কেউ নেই। ১৬ কোটি মানুষের মুখে খাদ্যের যোগান দেয়া কৃষকরা অবহেলিত রয়ে যাচ্ছেন স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও। রাষ্ট্র, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল, মাঠের বিরোধী দল, গৃহপালিত বিরোধী দল কারো ভাবনায় কৃষকের জায়গা নেই। পুরো বছর জুড়ে কৃষি ও কৃষকের চিত্র হলো, রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে জমিতে ফসল ফলায় কৃষক। হরতাল-অবরোধ আর প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাদের প্রতি কেউ সহায়তার হাত বাড়ায় না। উৎপাদন ভালো হলেও ফসলের ন্যায্য দাম পায় না কৃষক। গত আমন মৌসুমে বন্যার পাশাপাশি ন্যায্য দাম না পেয়ে সর্বস্বান্ত হওয়ার পর বোরো ধানের দামই ছিল তাদের ভরণ-পোষণের একমাত্র ভরসা। জমিতে ফলন ভাল দেখে কৃষক হয়তো ভেবেছিলেন আমনের মৌসুমের ধাক্কা কিছুটা হলেও কেটে উঠবেন। ধান বিক্রী করে মহাজনের টাকা শোধ করবেন, স্ত্রী- ছেলে-মেয়ের কাপড় কিনবেন, কেউ কেউ বিবাহযোগ্যা মেয়ের বিয়ে দেবেন, বাচ্চাদের লেখাপড়ার খরচ যোগাবেন। কিন্তু সব হিসেব-নিকেষ উল্টে দিয়েছে ধানের দাম। বিশেষজ্ঞদের মতে, আমন মৌসুমে কৃষক ধানের আশানূরূপ দাম পায়নি। এবার বোরো মৌসুমেও ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। ফসল উৎপাদন করে কৃষক বার বার প্রতারিত হলে তারা ধান চাষ ছেড়ে দিয়ে অন্যকিছু উৎপাদনের দিকে ঝুঁকে পড়বে। যা হবে দেশের জন্য চরম ক্ষতিকর।
 বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। অর্থনীতির চাকা কৃষির উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল হলেও খুলছে না কৃষকের ভাগ্যের চাকা। সরকারের ভুল নীতি এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে কৃষকের উৎপাদিত ধানের মূল্য যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে। এবারও তার ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে না। সরকারি ভাবে ধান ক্রয়ের ঘোষণা দিলেও সি-িকেটের পকেট ভারী করার জন্যই কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয় করা হচ্ছে না। ফলে ধান নিয়ে বিপদে পড়ে গেছেন কৃষককুল। আর ভরা মৌসুমে ভারত থেকে ধান আমদানীই বা কেন? খাদ্যমন্ত্রী দাবি করছেন ধান রফতানির জন্য বাজার খোঁজা হচ্ছে; আসলেই কি তাই? কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা সরাসরি সুবিধা পেয়েছেন ফখরুদ্দিন-মঈনউদ্দিন সরকারের শাসনামলে। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে সরকার সরাসরি কৃষকদের হাতে ভুর্তকির অর্থ তুলে দিয়েছে। অথচ গণতান্ত্রিক সরকারগুলো কৃষকের জন্য তেমন কিছুই করছে না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা শুধু বাগাড়ম্বর আর কথামালা দিয়ে কৃষকদের ভোলাতে অভ্যস্ত। পেটে খাবার না থাকলে কথামালায় কি পেট ভরে? কৃষকের পাশে কেউ নেই।



 

Show all comments
  • samim ২ জুন, ২০১৬, ১:১১ পিএম says : 0
    kirisok bachate sorkarer kisu kora ucit
    Total Reply(0) Reply
  • kamal hosen ২ জুন, ২০১৬, ১:২২ পিএম says : 0
    80% public er condition niye karo matha beta nei kno??????
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ধান জীবন ধানই মরণ
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ