দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
(পূর্বে প্রকাশিতের পর)
মানুষের কোন কাজ যেরূপ সময় ও কাল থেকে খালি হয় না এবং যার উপর ভিত্তি করে নামাজের সময়সমূহকে সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে, তেমন তা কোন স্থান হতেও খালি হতে পারে না। যখন মানুষ কোন কাজ করবে, তাহলে এটা সুস্পষ্ট যে, তার মুখ কোন না কোন দিকে হবেই। যদি নামাজের জন্য কোনও নির্দিষ্ট দিক না হত এবং এই সাধারণ অনুমতি দেয়া হত যার যেদিকে ইচ্ছা মুখ করে নামাজ আদায় করুক, তাহলে জমাআতের একতার বন্ধন ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যেত এবং নামাজীদের একই আকার ও ধরন বজায় থাকত না, বরং একই মসজিদে একই সময়ে কেউ পূর্ব দিকে, কেউ পশ্চিম দিকে, কেউ উত্তর দিকে, কেউ দক্ষিণ দিকে মুখ করে দাঁড়াত। এমতাবস্থায় তা একতা ও অবিচ্ছিন্নতার রূপ পরিহার করে শতধা-বিচ্ছিন্নতার এক হাস্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করত। এজন্য প্রত্যেক ধর্মেই ইবাদতের জন্য কোন না কোন সময় ও নির্দিষ্ট দিক ঠিক করা হয়েছে। সায়েবীরা (তারকা পুজারী) উত্তর দিকে মুখ করে ইবাদত করত। কারণ ধ্রুবতারা সেদিকেই থাকে এবং দৃশ্যমান তারকাগুলোর মাঝে এই তারা স্থানচ্যুত হয় না। (ইবনে তাইমিয়া : আররাদ্দ আলাল মানতিকীন) সূর্য পূজারীরা সূর্যের দিকে মুখ করে ইবাদত করে। অগ্নিপূজারীরা আগুনকে সামনে রাখে। মূর্তিপূজারীরা কোন না কোন মূর্তি সামনে রাখে। অধিকাংশ সিরীয় কাওম পূর্বদিকে মুখ করে দাঁড়াত। এমন কি ইহুদীদের একটি দল ইলিসিনি সূর্যোদয়ের স্থানকে কিবলা বানিয়েছিল। সিরীয় খৃষ্টানরাও এইদিকে মুখ করেই ইবাদত করত। (ইনসাইুক্লোপেডিয়া অব ইসলাম, কিবলা প্রবন্ধ) বনী ইসরাঈলদের জন্যও কিবলা জরুরী ছিল। তৌরাত থেকে হযরত ইব্রাহীম (আ:), হযরত ইসহাক (আ:) এবং হযরত ইয়াকুব (আ:)-এর এই দস্তুর জানা যায় যে, তাঁরা যেখানে ইবাদত করতে চাইতেন, সেখানে কতিপয় পাথর দ্বারা বেষ্টন করে আল্লাহর ঘর বানিয়ে নিতেন। (সফরে তাকবীন : ১২-৮ ও ১৩-৪ ও ২৮-১৭ ও ৩১-১৩) কুরআনুল কারীমে আছে, বনী ইসরাঈল যখন মিসরে ছিল তখন হযরত মূসা (আ:)-এর মাধ্যমে হুকুম হয়েছিল যে, নিজেদের গৃহগুলো কিবলামুখী করে তৈরি করবে এবং নামাজ আদায় করবে। ইরশাদ হচ্ছে, নিজেদের গৃহগুলোকে কিবলামুখী করে নাও এবং নামাজ কায়েম কর। (সূরা ইউনুস : রুকু-৯)। বাইতুল মুকাদ্দাসের কিবলা হওয়ার কথা প্রাচীনকাল হতেই সম্মিলিত কিতাবগুলোতে বিভিন্নবার বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত দাউদ (আ:)-এর যাবুর কিতাবে আছে, ‘হে আল্লাহ আমি যে-ই হই না কেন, সুতরাং তোমার অধিক রহমতের ফলেই আমি তোমার গৃহে আগামন করব এবং তোমাকে ভয় করে তোমারই পবিত্র হায়কলের দিকে মুখ করে সিজদা করব।” (৫-৭) সলাতীনে আইয়্যাল-এ আছে, “যখন তোমার সম্প্রদায় যুদ্ধের জন্য গমন করে এবং দুশমনদের মোকাবেলায় বের হয়, যেখানেই তুমি তাদেরকে প্রেরণ করবে, তখন আল্লাহর সকাশে দোয়া করবে, ঐ শহরের দিকে মুখ করে যাকে তুমি পছন্দ কর এবং ঐ গৃহের দিকে মুখ করে, যে গৃহকে আমি তোমার নাম বুলন্দ করার জন্য তৈরি করেছি।” (৭-৪৪)
এই সহীফাতেই পরবর্তীতে বলা হয়েছে, “এবং ঐ যমীনের দিকে যা তুমি তাদের পিতা দাদাদের দান করেছ। এবং ঐ শহরের দিকে যা তুমি চয়ন করেছ এবং ঐ গৃহের প্রতি যাকে আমি তোমার নামের জন্য তৈরী করেছি এবং তোমারই কাছে প্রার্থনা করছি। (৪০)
আহলে আরবের নিকট কা’বা শরীফের সেই মর্যাদাই ছিল, যা বনী ইসরাঈলের নিকট বাইতুল মুকাদ্দাসের জন্য ছিল। এজন্য যে আহলে আরবের কিবলা ছিল কা’বা শরীফ। উপরোক্ত সকল বিশ্লেষণের দ্বারা আল-কুরআনের এই আয়াতের যথার্থ মর্মই উদঘাটিত হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, “এবং প্রত্যেক উম্মতের জন্যই এক একটি কিবলা নির্ধারিত আছে। যার দিকে তারা মুখ করে দাঁড়ায়। সুতরাং হে মুসলমানগণ! তোমরা পুণ্যকর্মের দিকে দ্রুতগতিতে অগ্রসর হও।” উপরোক্ত বিবরণের দ্বারা একথা সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে, দুনিয়ার তিনটি মাযহাবে তিন প্রকার কেবলা ছিল। তারকা পুজারীরা অথবা তারকা পূজায় অনুরাগীরা কোন তারকাকে কেবলা বানিয়ে নিত। যেমন সূর্যপূজারীরা সূর্যোদয়ের দিকে অর্থাৎ পূর্ব দিকে এবং সাবেয়ী (তারকা পূজারী) উত্তর দিকের ধ্রুব তারাকে, উপাদান পূজারীরা অথবা মূর্তী পূজারীরা নিজেদের উপাস্য বস্তুকে অর্থাৎ আগুন অথবা দরিয়া অথবা কোনও মূর্তিকে কেবলা নির্ধারিত করত। মুয়াহহেদীন বা একত্ববাদীরা নিজেদের কেন্দ্রীয় মসজিদকে কিবলা মনে করত।
ইব্রাহীম (আ:)-এর বংশধরদের মাঝে এ শ্রেণীর কেন্দ্রীয় মসজিদ ছিল দু’টি (১) মাসজিদুল আকসা। (বাইতুল মুকাদ্দাস) এবং (২) মাসজিদুল হারাম (খানায়ে কা’বা) প্রথম মসজিদটির মুতাওয়াল্লী ছিলেন হযরত ইসহাক (আ:) এবং তাঁর সন্তান-সন্ততিগণ। এজন্য বাইতুল মুকাদ্দাস ছিল তাদের কিবলা। মাসজিদুল হারামের মুতাওয়াল্লী ছিলেন হযরত ইসমাইল (আ:) এবং তাঁর সন্তান-সন্ততিগণ যারা একে কিবলা হিসাবে গ্রহণ করেছিল। রাসূলুল্লাহ (সা:) যতদিন পর্যন্ত মক্কা মোয়াজ্জমায় ছিলেন, ততদিন তিনি খানায়ে কা’বার দিকে মুখ করে দাঁড়াতেন। এতে করে কা’বা এবং বাইতুল মুকাদ্দাস উভয়টি সামনে পড়ত। কিন্তুু তিনি যখন মদীনা হিজরত করলেন, তখন এভাবে দাঁড়ানো সম্ভব ছিল না। কেননা বাইতুল মুকাদ্দাস ছিল মদীনা শরীফ হতে উত্তর দিকে এবং খানায়ে ক্কাবা ছিল দক্ষিণ দিকে। কিন্তু তবুও যেহেতু খানায়ে কা’বা কেবলা নির্ধারিত হওয়া সম্বলিত কোন হুকুম তখনো নাযিল হয়নি, সেজন্য তিনি বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকেই মুখ করে ১৬/১৭ মাস নামাজ আদায় করেছিলেন। কেননা সেটাই ছিল আম্বিয়ায়ে বনী ইসরাঈলের কিবলা। কিন্তুু তার আন্তরিক খায়েশ ছিল এই যে, মিল্লাতে ইব্রাহিমীর জন্য এই ইব্রারাহিমী মসজিদকে (ক্কা’বাকে) কিবলা নির্ধারিত করা হোক। যার মুতাওয়াল্লী প্রতিষ্ঠাতা হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর তরফ হতে বনী ইসমাঈলকে বানানো হয়েছিল। সূরায়ে বাকারার মধ্যমাংশে এ সম্পর্কে হুকুম নাযিল হয়। যার মাঝে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ পাক কোনও নির্দিষ্ট দিক এবং কোণের সাথে সংশ্লিষ্ট নন। কেননা তিনি দিকহীন ও দিক থেকে মুক্ত ও পবিত্র এবং সকল দিক তাঁরই জন্য নিবেদিত। আল-কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে-
অর্থাৎ-এবং আল্লাহরই জন্য পূর্ব এবং পশ্চিম, তুমি যেদিকেই মুখ কর, সে দিকেই আল্লাহর চেহারা রয়েছে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সুবিস্তৃত ও সুবিজ্ঞ। (সূরা : বাকারাহ-রুকু ১৪) আল্লাহর এই প্রশস্ততা ও সুবিজ্ঞতা সকল দিকেই পরিব্যাপ্ত আছে। এবং সকল দিকের খবরই জানেন এবং রাখেন। এই আয়াতে কারীমা দ্বারা কিবলা নির্ধারণের যাবতীয় শেরেকী ব্যবস্থাপনা রহিত হয়ে যায়। এবং এই ঘৃণ্য অংশীবাদীতার মূলোৎপাটিত হয়েছে। অপর এক আয়াতে একই মজমুনকে আরোও সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, “নির্বোধ লোকেরা বলে যে, এই (মুসলমানদের) লোকদেরকে তাদেরকে এই কিবলা হতে কিসে ফিরিয়ে দিয়েছে? যার উপর তারা ছিল? বলে দাও, পূর্ব এবং পশ্চিম (সবই) আল্লাহর জন্য। তিনি যাকে চান সোজা পথ প্রদর্শন করেন। (সূরা বাকারাহ : রুকু-১৭) ইহুদীদের অভিযোগই ছিল সবচেয়ে বেশী যে, মাশরেকী মাসজিদ অর্থাৎ বাইতুল মুকাদ্দাসকে ছেড়ে মাগরেবী মসজিদ অর্থাৎ খানায়ে কা’বাকে কেন নির্ধারণ করা হলো? কেন এমন হলো। তাদের অভিযোগের উত্তরে মহান আল্লাহপাক তাদেরকে লক্ষ্য করে ঘোষণা করেছেন, তোমরা নিজেদের মুখ পূর্ব এবং পশ্চিম দিকেই কর এতে পুণ্য নেই। বরং অবশ্য নেকী হচ্ছে এই যে, আল্লাহ, কিয়ামত, ফেরেশতা, কিতাব এবং পয়গাম্বরদের উপর ঈমান আনয়ন করা, এবং স্বীয় দৌলতকে এর মহব্বত থাকা সত্তে¡ও (আল্লাহর মহব্বতে) আত্মীয়-স্বজনকে, এতীম, গরীব ও মিসকীনকে, মুসাফিরদেরকে যাঞ্চাকারীকে এবং দাসদেরকে (মুক্ত করার জন্য) খরচ করা এবং নামাজ কায়েম করা, যাকাত দান করা, এবং (নেকী এই যে,) যারা অঙ্গীকার করে তা পূরণ করে, এবং যারা দু:খ-কষ্টের মাঝেও যুদ্ধের সময় ধৈর্য ধারণ করে, তারাই ঐ লোক যারা সত্যবাদী এবং তারাই হচ্ছে মুত্তাকী। (সূরা বাকারাহ : রুকু-২২)
এই বিশ্লেষণের দ্বারা এটা সুস্পষ্ট বুঝা যায় যে, ইসলামে কিবলার গুরুত্ব কতখানি। কিবলা অর্থাৎ ঐ দিক অথবা স্থান যার দিকে মুখ করা হয়, ইবাদতের জন্য কোনও আবশ্যকীয় বস্তুু নয়। কিন্তু নামাজের মাঝে উম্মতের একতার নিয়ম-শৃঙ্খলা কায়েম রাখার জন্য কোনও দিকে মুখ করার নির্ধারণ আবশ্যক ছিল। এজন্য হিজরী, প্রথম সালে খানায়ে কা’বাকে কিবলা বানানোর হুকুম হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, “সুতরাং তুমি স্বীয় মুখ মসজিদে হারামের (খানায়ে কা’বা) দিকে ফিরিয়ে নাও, তোমরা যেখানেই হও, এরই দিকে স্বীয় মুখ ফিরাও।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-১৭)
ইসলাম কিবলার জন্য কোনও নির্দিষ্ট দিকে নয়, বরং এক কেন্দ্রীয় মসজিদ নির্বাচিত করেছে। যার চারদিকে এবং চারদিক হতেই নামাজ আদায় করা যায়। এভাবে পশ্চিম, পূর্ব, দক্ষিণ, উত্তর সকল দিকের মুসলমানের জন্য একই সময়ে কিবলারূপে যা প্রতিষ্ঠিত। এবং এর দ্বারা এই সূ² হেকমত পাওয়া যায় যে, মুসলমানদের উপাস্য আল্লাহর মত তাদের কিবলা ও দিকহীন বা দিকমুক্ত এবং এর দ্বিতীয় ফায়দা হচ্ছে এই যে, দিক নির্ধারণের দ্বারা সেদিকের কেন্দ্রীয় প্রাধান্য (যেমন সূর্য অথবা ধ্রুবতারা ইত্যাদি) এবং উপাসনার স্থান হওয়ার যে ধারণা বৃদ্ধি পেত এবং যার দ্বারা মূতিপূজা ও নক্ষত্র পূজার রেওয়াজ ছড়িয়ে পড়েছিল, এর সম্পূর্ণ বিলুপ্তি সাধিত হয়ে যায়। (চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।