পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
স্টালিন সরকার : ইউপি নির্বাচনে ভোটের হাঙ্গামা গ্রামীণ মানুষের যাপিত জীবন দূর্বিষহ করে তুলেছে। নিত্যদিন শত শত গ্রামে সংঘাত-সংঘর্ষ ঘটছে। ৫ ধাপের ভোটে সারাদেশে প্রাণ হারিয়েছে ১১০ জন আর আহত হয়েছে ১০ হাজার। ভোটের সংঘাত-সংঘর্ষের রেশ গ্রামীণ জনপদ করে তুলেছে অস্থির। নির্বাচনী সহিংসতার বিভেদ চলছে তো চলছেই।
শহর আর গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রায় পার্থক্য বিস্তর। শহরে একই বিল্ডিংয়ে বছরের পর বছর বসবাস করেও অধিকাংশ মানুষ কেউ কাউকে চেনেন না। নিত্যদিন একই সিঁড়ি বেয়ে বা একই লিফটে ওঠানামা করেও কুশল বিনিময়ের প্রয়োজন বোধ করেন না। ব্যতিক্রম ছাড়া ঢাকা শহরের এটাই স্বাভাবিক চিত্র। গ্রামের চিত্র একেবারেই উল্টো। সব ধর্ম এবং মত-পথের মানুষের প্রতিদিন দেখা-সাক্ষাৎ হয়। পথে হাঁটতে, ক্ষেতে কাজ করতে, জমিতে পানি দিতে, স্কুল-কলেজে যাতায়াতে সবার দেখা হয়, কথা হয়Ñএকই হাট-বাজারে যান, আড্ডা দেন, বিতর্ক করেন। রান্নার মসলা লবণ-তেল-পিঁয়াজ-রসুন-আদা না থাকলে প্রতিবেশীর কাছে গৃহিণীদের এখনো ধার করে নেয়ার রেওয়াজ প্রচলিত। তরিতরকারি পর্যন্ত আদান-প্রদান হয়। শহরে বিরোধ, ঝগড়াঝাঁটি হলে তা বেশিক্ষণ থাকে না। সবাই ব্যস্ত, ঝগড়া-বিবাদ করে যে যার পথে চলে যান, কর্মময় জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু গ্রামীণ বিরোধদের রেশ দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এমনকি যুগের পর যুগ চলতে থাকে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রাণহানি, বিরোধ, সংঘাত-সংঘর্ষ যে মাত্রায় হয়েছে তা হাজার বছরের গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থার সহ-অবস্থানের চিত্রই পাল্টে দিয়েছে। ইউপি নির্বাচনের বিরোধের কারণে দেশের গ্রামগুলো যেন কুরুক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। ভাইয়ে-ভাইয়ে বিরোধ, ভাই-বোনে বিরোধ, চাচা-ভাতিজায় বিরোধ, প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশীর বিরোধ, মহল্লায় মহল্লায় বিরোধ, দলের ভিতরে গ্রুপিং-লবিং বিরোধ, দলীয় নমিনেশন পাওয়া-না পাওয়া নিয়ে বিরোধ চরম আকার ধারণ করেছে। ইউপি নির্বাচনের ভোট ইস্যুতে আগের মতো জ্বলছে মানুষের মন। এ বিরোধ কতদূর গড়ায় কেউ জানে না।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোট ইস্যুতে বিরোধ এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে যে, সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠছে গ্রামীণ জনপদের মানুষ। ভোটের রাজনীতির তুঘলকিকা- যেন মানুষকে ওই পথে ঠেলে দিচ্ছে। ঢাকায় বসে বিভিন্ন এলাকার খবর পাচ্ছি। বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে ফোন করে মানুষ গ্রামীণ বিরোধের চিত্র জানাচ্ছে। পত্রপত্রিকা ও ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে এমন খবর প্রায়ই প্রকাশ পাচ্ছে। দেশের চারদিকের গ্রাম, শহর-বন্দর সবখান থেকেই এমন খবর আসছে। রাষ্ট্রের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা মানুষকে ধৈর্যহারা করছে। ভোট বিরোধেই পরিবারিক ও সামাজিক বন্ধন ছিঁড়ে যাচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের একটি ঘটনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে তা দেখিয়ে দিল। আল্লাহর নামে কটূক্তি করার ঘটনায় মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত। প্রশাসন যন্ত্র, রাজনৈতিক দল সর্বত্র একই অবস্থা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে ক্ষমতাসীন দলের কর্মী বাহিনী।
স্বাধীনতার পর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হয়েছে ১৯৭৩, ১৯৭৭, ১৯৮৩, ১৯৮৮, ১৯৯২, ১৯৯৭, ২০০৩, ২০০৭ ও ২০১১ সালে। ’৮৮ নির্বাচনে কিছু প্রাণহানি ঘটলেও অধিকাংশ নির্বাচনে তেমন প্রাণহানি ঘটেনি। এই যে দু’মাস ধরে সারাদেশে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন চলছে। বিগত ৪০ বছরেও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন এবারের মতো সহিংসতা দেখা যায়নি। নির্বাচনের ৫ ধাপে ভোটের সহিংসতায় ১১০ জন প্রাণ হারিয়েছে। নির্বাচনে এই প্রাণহানির অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বিনা ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার ঘটনাও রেকর্ড গড়েছে। এ অভিমত স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞদেরই শুধু নয়; এমনটাই দাবি করেছে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। সুজনের কর্মকর্তারা সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, বাংলাদেশে অতীতের যেকোনো ইউপি নির্বাচনের চেয়ে এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছে। নির্বাচন কমিশনের প্রতি কারো বিশ্বাস নেই। ওই সংবাদ সম্মেলনে প্রবীণ সাংবাদিক সৈয়দ আবুল মকসুদ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে ‘শহিদী নির্বাচন’ হিসেবে অবিহিত করেছেন। তার মতেও নির্বাচনে এতো মানুষ অতীতে কখনো মারা যায়নি। দেশের সর্ব নিম্নস্তর তথা তৃর্ণমূল পর্যায়ের স্থানীয় নির্বাচনে ব্যাপক অনিময় ও প্রাণহানির ঘটনা ভোটারদের চোখে দুঃস্বপ্নের নির্বাচনে পরিণত হয়েছে। এই নির্বাচনে মৃত ব্যক্তিরাও নাকি ভোট দিয়েছেন। ভোট গণনার পর সেটাই প্রমাণ হয়েছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এই যে ভয়াবহ চিত্র কি মানুষ ভুলতে পারবে?
দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করতে গিয়ে জেলায় জেলায়, গ্রামে গ্রামে, পাড়ায় পাড়ায় দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সঙ্কীর্ণ দলীয় আধিপত্য সমাজকে বিভেদের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। অবৈধ ভাবে স্থানীয় প্রশাসন নিয়ন্ত্রণের যে প্রক্রিয়া দেখছি তা ভয়ংকর। প্রশাসন সেখানে নীরব দর্শক। প্রতিপক্ষ এখন শুধু বিরোধী দল নয়, নিজ দলের বিদ্রোহী নেতারাও। আধিপত্যকামিতার সংস্কৃতিচর্চার পাশাপাশি পরিলক্ষিত হলো সেই আধিপত্যর বিরুদ্ধে হিংসাশ্রয়ী লড়াই। দলের বাইরে শুধু নয়, প্রতীকের বাইরে থাকলেই সেও আমার শত্রু এমন মানসিকতা ক্ষমতাসীন দলের তৃণমূল নেতাদের মধ্যে। নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর পক্ষ নেয়ায় ইউপি নির্বাচনে রাজনৈতিক উন্মত্ততার যে প্রকাশ ঘটছে তা রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতার নামান্তর। অথচ সেদিকে খেয়াল নেই আমাদের নেতাদের। হাজার হাজার বছর ধরে সব ধর্ম-বর্ণ, মত-পথের মানুষ সৌহার্দ্যরে সঙ্গেই বসবাস করছে। পরিবার, সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ থেকে মানুষ জীবনধারণে অভ্যস্ত। এনজিওগুলো নারীর অধিকার, নারীর স্বাধীনতার নামে সেই বন্ধনে আঘাত হানায় পারিবারিক বন্ধনে কিছুটা ব্যত্যয় ঘটলেও সহযোগিতা সহমর্মিতা অটুট ছিল। সেটা যেন ক্রমান্বয়ে ফিকে হয়ে আসছে। রাজধানী ঢাকায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে যারা রাজনৈতিক দল পরিচালনা করেন তারা কি ভাবতে পারছেন কি স্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি হলো দলের তৃণমূল পর্যায়ে; গ্রামীণ জনপদে? পরিবারে-পরিবারে, ভাইয়ে-ভাইয়ে, নানা ধর্মের মানুষের মধ্যে তথা সামাজিক বিরোধের বীজ কত গভীরে রোপিত হলো? ইউপি নির্বাচনের ভোট শেষ হবে; কিন্তু হিংসা, বিদ্বেষ, ক্ষোভ কি মানুষের মন থেকে মুছে যাবে? কখনোই না। বিরোধ সমাজে থেকে যাবে। ভোট নিয়ে মানুষের হৃদয়ে যে আগুন জ্বলছে সেটা নেভাবে কে? ক্ষোভের আগুনে পুড়ছে মানুষ। একদিকে অভাব, অনিশ্চয়তা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা; অন্যদিকে সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় বিরোধ। ভোটে যারা স্বজন হারিয়েছে, যে নেতা তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত কর্মীর লাশ পড়ে থাকতে দেখেছেন; যিনি জনপ্রিয়তা ও যোগ্যতায় এগিয়ে থেকে মনোনয়ন বাণিজ্যের কাছে হেরে দলের প্রতীক পাননি, যাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে, তার হৃদয়ের আগুন কি ছাইচাপা থাকবে? সুযোগ পেলেই প্রতিশোধ নেবেন।
দেশের পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে আমজনতার দিকে তাকানোর কেউ নেই। মানুষকে বোঝার কেউ নেই, দেখার কেউ নেই, মানুষের পক্ষে কথা বলারও কেউ নেই। মানুষের মন বোঝার চেস্টা কেউ করছে না। না করছে রাজনৈতিক দল না সুশীল সমাজ। মানুষ ভোটের অধিকার হারিয়েছে। পাশের দেশের নাগরিকদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ভোট দিতে দেখে গণতন্ত্রমনা মানুষের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের বক্তব্য জনগণের বক্তব্য হিসেবে প্রচার করছে। সুশীল, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, এনজিওবাজ, বিদেশী অপসাংস্কৃতির ফেরিওয়ালা যারা টিভির টকশোতে নিত্য গলা ফাটাচ্ছেন তারা নিজেদের বক্তব্য জনগণের মতামত হিসেবে চালিয়ে দিচ্ছেন। ওই লোকগুলো কোনোদিন সাধারণ মানুষের কাছে যাননি, বছরেও গ্রামে পা দেন না এবং গ্রামীণ মানুষের সমস্যা-সংকট সম্পর্কে ধারণা দেননি। তারা আমজনতার মুখপত্র হয়ে যান। প্রায়ই বিভিন্ন ইস্যুতে দাবি করা হয় ‘অমুক’ বিষয়ে জনমত গঠিত হয়েছে। ‘তমুক’ বিষয়ে সাধারণ মানুষ ঐক্যবদ্ধ। যে মানুষ কথা বলতে পারছেন না অথচ তাদের নামে দিব্যি মিথ্যার বেসাতি হচ্ছে; এতে মানুষের মধ্যে ক্রোধ বাড়ছে।
এবারই ইউপি নির্বাচন দলীয় প্রতীক দেয়া হয় শুধু চেয়ারম্যান প্রার্থীদের। দলের প্রতীক এমনই শক্তিশালী যে নির্বাচনের আগেই বহু সংখ্যক সরকারদলীয় প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। চেয়ারম্যান পদে এই প্রতীক দেয়ায় ক্ষমতাসীন দলে বিপজ্জনক মাত্রায় কোন্দল বেড়েছে। মনোনয়ন বাণিজ্য হয়েছে কেন্দ্র থেকে শুরু করে শেখড় পর্যন্ত ভয়ংকরভাবে। ইউপি নির্বাচনে অতীতে যারা বিজয়ী হতেন তাদের দলীয় পরিচয় থাকলেও সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা ছিল। ব্যক্তি ইমেজ, পারিবারিক প্রভাব, আঞ্চলিকতা ভোটযুদ্ধে ফ্যাক্টর হতো। যিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন তারও একই ধরনের যোগ্যতা ও শক্তি থাকত। এতে ভোট হতো গ্রহণযোগ্য উৎসবমুখর, কিন্তু সেটা হয়নি। গ্রামীণ জনপদে এই বিরোধ নিয়ে রাজনীতিকদের উপলব্ধি খুবই জরুরি। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের। কারণ মনোনয়ন বাণিজ্য এবং দলের পরীক্ষিত নেতাদের বদলে পয়সাওলারা নৌকা প্রতীক পাওয়ায় দলের ভেতরে এই নির্বাচন কতটা রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে, দলের তৃণমূলে এই নির্বাচন কতটা বিবাদ স্থায়ী রূপ দিয়েছে তা উপলব্ধি করা জরুরি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।