Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জনপ্রিয়তাই প্রাণ কেড়ে নিল কামাল উদ্দিনের

প্রকাশের সময় : ৩১ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ জসিমউদ্দিন মোল্লা, কুমিল্লা উত্তর থেকে : বিএনপি নেতা কামাল উদ্দিন (৫৫)। অত্যন্ত মিষ্টভাষী, পরোপকারী ও জনপ্রিয় এক সমাজকর্মীর নাম। কুমিল্লার তিতাস উপজেলার বলরামপুর ইউনিয়নের পাঙ্গাসিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বিপুল ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে ২ মেয়াদে কামাল অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এলাকার সার্বিক উন্নয়ন ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় নির্ভীকভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। জয় করে নিয়েছেন মানুষের হৃদয় নিংড়ানো অকৃত্রিম ভালবাসা। কামাল চেয়ারম্যান বেঁচে নেই, এই নির্মম সত্যটি কেউ যেন বিশ্বাসই করতে চাইছে না। ২৮ মে ইউপি নির্বাচনের দিন প্রতিপক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর দুর্বৃত্তদের হাতে নির্মমভাবে খুন হন বিএনপি’র এই বিদ্রোহী (স্বতন্ত্র) চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী। আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা ও মনোনয়ন বাণিজ্যের জন্যই নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হলো এই সমাজকর্মীকে।
নরপিচাশদের টাকার ক্ষুধা মেটাতে পারেননি কামাল। তাই তিনি বিএনপি নেতা হয়েও দলীয় মনোনয়ন পাননি। টাকার বিনিময়ে মনোনয়ন পায় সদ্য বিদেশ ফেরত তোফায়েল আহমেদ তপন ভূইয়া। বিএনপিতে যার কোন পদপদবী নেই। কামাল উদ্দিন বিএনপি’র মনোনয়ন পাননি বলে ইউপি নির্বাচনে প্রার্থী হতে চাননি। কিন্তু এলাকার হাজারো মানুষের ভালবাসা ও জোরালো দাবি তাকে চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে বাধ্য করে। অধিক জনপ্রিয়তাই কাল হলো তার। নরঘাতকরা তাকে বাঁচতে দিলো না। গোটা তিতাসবাসী শোকে মূহ্যমান।
তিতাস সদর ও বলরামপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, বর্তমান চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন বিএনপি করতেন। তিনি ছিলেন উপজেলা বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। ১৯৯৭ ও ২০১১ সালে বিপুল ভোটে বলরামপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তার মিষ্টভাষী আচরণ, কাজের প্রতি একাগ্রতা, সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের প্রতি অগাধ ভালবাসা, সর্বোপরি এলাকার উন্নয়নের জন্য তার বিরামহীন প্রচেষ্টা তাকে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে দিয়েছে। কামালের জন্য ভিন্ন গ্রামের, পাড়ার মানুষ, খেটে খাওয়া দিনমজুর, রিক্সা-ভ্যান চালক সকলেই কাঁদছে। এ কান্নার যেন শেষ নেই। এবারের নির্বাচনেও কামাল উদ্দিন বিপুল ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতেন- এমনটা জানালেন সাধারণ ভোটাররা।
জানা গেছে, কামালের চাচা নবাব আলী মাস্টার এই ইউনিয়ন পরিষদে একাধিক্রমে ২৮ বছর চেয়ারম্যান ছিলেন। চেয়ারম্যান চাচার জনপ্রিয়তা, সেবামূলক কর্মকা-, মানুষের প্রতি ভালবাসা তাকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করেছে। চাচা চেয়ারম্যান নবাব আলী মাস্টারের অনুপ্রেরণায় তিনি জনসেবক হবার স্বপ্ন দেখতেন। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নও করেছেন কামাল। চাচার মতো সেও দীর্ঘদিন মানুষের মন জয় করে এলাকার উন্নয়নে অংশিদার থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে প্রতিপক্ষের দুর্বৃত্তরা কামালের লালিত স্বপ্ন চুরমার করে দিলো। এই নির্মম পৈচাশিক হত্যাকা-ের প্রতিবাদে নিন্দার ঝড় উঠেছে গোটা তিতাস তথা কুমিল্লা জেলায়। সমাজের বিবেকবান মানুষেরা এই হত্যাকা-ের সামান্যতম যৌক্তিকতা খুঁজে পাচ্ছে না। বিবেকের কাছে প্রশ্ন- নির্বাচনে পরাজিত হবার ভয়ে একজন জনপ্রিয় ব্যক্তিকে খুন করতে হবে? আমরা কোন সমাজে বাস করছি? হায়েনার দল আজ বড় শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।
তিতাস উপজেলার বিভিন্ন সূত্র জানায়, কামাল উদ্দিন চেয়ারম্যান হত্যার মূল কারণ অর্থলোভী বিএনপি’র কতিপয় নেতাদের মনোনয়ন বাণিজ্য ও তার বিপুল জনপ্রিয়তা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার এপিএস-২ (উন্নয়ন) আবদুল মতিন মিয়া এবং তিতাস উপজেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান সালাহ্ উদ্দিন সরকার মনোনয়ন দেয়ার জন্য কামাল উদ্দিনের কাছে ১৫ লাখ টাকা দাবি করেছিলেন বলে পরিবারের পক্ষ থেকেও অভিযোগ করা হয়েছে। কামাল এত টাকা তাদের হাতে তুলে দেননি। ফলে উপজেলা চেয়ারম্যান সালাহ্ উদ্দিন টাকার বিনিময়ে মনোনয়ন দেন সদ্য বিদেশ ফেরত তোফায়েল আহমেদ তপন ভূইয়াকে। বিএনপিতে যার কোন পদ-পদবী নেই। মনোনয়ন বাণিজ্যের এই খবর বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হলে এলাকায় ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়। এতে কামাল ও স্থানীয় সংবাদিকদের প্রতি ভীষণ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন সালাহ্ উদ্দিন সরকার। এই ক্ষোভের বহি:প্রকাশ ঘটেছে চেয়ারম্যান কামালকে হত্যার মাধ্যমে। এমনটিই মনে করছেন এলাকাবাসী ও তার পরিবার।
নিহত কামাল উদ্দিনের বড় ভাই ইঞ্জিনিয়ার মোজাম্মেল হক তার ভাইয়ের হত্যাকারীদের অবিলম্বে গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করে বলেন, সমাজসেবা ও এলাকার উন্নয়নের জন্যই কামাল রাজনীতি করতো। সে খুবই জনপ্রিয় ছিল। এবারও সে বিপুল ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতো। তার অকাল মৃত্যুতে আমাদের পরিবার এবং এলাকার অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেলো। কামাল বিএনপি’র একজন ত্যাগী নেতা হওয়া সত্ত্বেও কুচক্রিরা তাকে মনোনয়ন দেয়নি। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে অর্থলোভী বিএনপি নেতারা বিদেশ ফেরত তোফায়েল আহমেদ তপন ভূইয়াকে মনোনয়ন দিয়েছে।
কামালের স্ত্রী আসমা কামাল কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমার স্বামী পরিবারকে বেশী সময় দেয়নি। সারাক্ষণ মানুষের সমস্যা, সুখ-দুঃখ নিয়ে কাজ করেছেন। একথা বলেই মুর্ছা যান তিনি। আর কথা বলতে পারেননি।
ভাই কামালের লাশ দেখে বোন রোকেয়া বেগম বলেন, নির্বাচনের আগেই আমার ভাইকে হত্যা করবে বলে খুনিরা একাধিকবার হুমকি দিয়েছে। পুলিশকে জানানোর পরও কোন ব্যবস্থা নেয়নি। জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে পরিকল্পিতভাবে আমার ভাই কামালকে খুন করা হয়েছে। আমি খুনিদের ফাঁসি চাই।
৮৫ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের
এদিকে, কামাল উদ্দিন চেয়ারম্যান হত্যাকা-ে জড়িত থাকার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার এপিএস-২ (উন্নয়ন) আবদুল মতিন মিয়া এবং তিতাস উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক সালাহ উদ্দিন সরকারসহ ৮৫ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন নিহতের স্ত্রী আছমা কামাল।
এ হত্যাকা-ের পর পর বেগম খালেদা জিয়ার এপিএস আব্দুল মতিন, তিতাস উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সালাহ্ উদ্দিন সরকার ও বিএনপি’র চেয়ারম্যান প্রার্থী তোফায়েল আহমেদ তপন ভূইয়া গা ঢাকা দিয়েছে। পুলিশ তাদের হন্যে হয়ে খুঁজছে। এলাকাবাসী কামাল হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ও নির্দেশ দাতাদেরসহ খুনিদের অবিলম্বে গ্রেফতার ও ফাঁসি দাবি করেছে এবং এলাকার নিরীহ নিরপরাধ মানুষ যাতে এই হত্যা মামলায় অন্তর্ভুক্ত না করা হয় সেই জন্য এলাকাবাসী প্রশাসনের কাছে দাবী জানিয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জনপ্রিয়তাই প্রাণ কেড়ে নিল কামাল উদ্দিনের
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ