Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

তামাক ও ধূমপানের ক্ষতি

প্রকাশের সময় : ৩১ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এম এ জব্বার

আজ ৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের ন্যায় বাংলাদেশেও যথাযথ গুরুত্ব সহকারে দিবসটি পালিত হচ্ছে। প্রতি বছর এ দিবসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারিত থাকে। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় Get Ready for Plain packaging অর্থাৎ সাদামাটা মোড়ক - তামাক নিয়ন্ত্রণে আগামী দিন। তামাক কোম্পানীগুলোর আগ্রাসী প্রচারণা এবং বাজারজাত কার্যক্রম প্রতিরোধে এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় সবিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে।
তামাকের ক্ষতি সম্পর্কিত সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোবাক্যু কন্ট্রোল WHO FCTC)--এর ১১ নং আর্টিকেল অনুযায়ী সদস্য রাষ্ট্রসমূহ কর্তৃক সিগারেটের প্যাকেট এবং তামাকের বিভিন্ন মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য বাণী ছাপানোর বিষয়ে বাধ্যবাধকতা আছে। এ বিষয়ে অস্ট্রেলিয়া হচ্ছে প্রথম দেশ, যেখানে ডিসেম্বর ২০১২ হতে সচিত্র সতর্কবাণী পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়েছে। এছাড়া আয়ারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, উত্তর আয়ারল্যান্ড এবং ফ্রান্সসহ বেশিরভাগ সদস্য রাষ্ট্র সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী ব্যবহারের ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে। সচিত্র সতর্কবাণী হচ্ছে তামাকের ক্ষতি সম্পর্কিত রংগিন ছবি ও লেখা। দিনে কমপক্ষে ২০ বার এবং বছরে ৭৩০০ বার ছবি দেখে তামাক ব্যবহারীগণ নিরুৎসাহিত হবেন। ফলে তামাকের ব্যবহার কমে আসবে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী তামাকমুক্ত সমাজ গঠনে বেশ কার্যকর। বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপটে বলা যায়, বিশ্বের ৭৭টি দেশে ইতোমধ্যে সচিত্র সতর্কবাণী কার্যকর হয়েছে। নেপালে সিগারেটের প্যাকেটে ৯০ ভাগ অংশজুড়ে সতর্কবাণী ব্যবহার হয়। ভারতে ও থাইল্যান্ডে ৮৫ ভাগ, শ্রীলংকা ৮০ ভাগ এবং ইন্দোনেশিয়ায় সিগারেটের প্যাকেট এবং তামাকের বিভিন্ন প্রকার মোড়কে ৪০ ভাগ পর্যন্ত সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী ব্যবহার হয়ে আসছে।
বাংলাদেশে ২০১৩ সালের সংশোধিত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন এবং ২০১৫ সালে প্রণীত বিধিমালা অনুযায়ী তামাক কোম্পানীগুলো কর্তৃক সিগারেটের প্যাকেট এবং তামাকের বিভিন্ন মোড়কে ৫০ ভাগ পর্যন্ত সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী ব্যবহার করার বিষয়ে বাধ্যবাধকতা আছে। এর ব্যত্যয়ে কোম্পানীগুলোর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিষয় বলা আছে। এ বিষয়ে পুরোপুরি বাস্তবায়নের জন্য তামাক কোম্পানীগুলোকে এ বছরের ১৯ মার্চ পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বেশিরভাগ কোম্পানী তা মেনে চলছে না। ফলে সরকারের সহায়ক শক্তি হিসেবে বিভিন্ন স্বাস্থ্য ও তামাকবিরোধী প্রতিষ্ঠান যেমন- ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, প্রঞ্জা, প্রত্যাশা, আধূনিক, মানবিক, উবিনীগ, তাবিনাজ, আহছানিয়া মিশন, অ্যান্টি টোবাক্যু মিডিয়া অ্যালায়েন্স, ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ, সীমান্তিক, বিসিসিআইসহ আরো অন্যান্য সংগঠন দেশের বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। সংগঠনগুলোর কর্মসূচির উদ্দেশ্য ছিল তামাক কোম্পানীগুলোকে স্বাস্থ্য সতর্কবাণী ছাপানোর বিষয়ে বাধ্য করা।
তামাকের বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি যেমন ক্যান্সার, হার্টের বিভিন্ন রোগ, স্ট্রোক, শ্বাসকষ্ট ও পায়ে পচন এবং ধুয়াবিহীন তামাক জর্দা ও সাদাপাতা ব্যবহারের ফলে খাদ্যনালীতে ক্যান্সারসহ নানা শারীরিক জটিলতা সম্পর্কে এখন আর কারো অজানা নয়। বাংলাদেশে তামাকের ব্যবহার সম্পর্কে বলতে গেলে এখানে ধূমপায়ীর হার শতকরা ৪৩ ভাগ। ধুয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারী মহিলার হার ২৮% এবং পুরুষ ২৬% ভাগ। সিগারেটের ব্যবহারকারী পুরুষ ৪৫% এবং মহিলা ১.৫%। বাংলাদেশে প্রতি বছর তামাকের কারণে প্রায় এক লক্ষ লোক মৃত্যুবরণ করে। এছাড়া ৩ থেকে ৪ লক্ষ লোক তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের কারণে অসুখ ও অক্ষমতাজনিত কুফল ভোগ করে।
বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে গেলে তামাকের কারণে প্রতি বছর ৬০ লক্ষ লোকের মৃত্যু হয়। যার মধ্যে ৬ লক্ষ পরোক্ষ ধূমপানজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করে। তামাকের ব্যবহার অনিয়নন্ত্রিত থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে প্রতি বছর এ সংখ্যা দাঁড়াবে ৮০ লক্ষ। যার শতকরা ৮০ ভাগ নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে তামাকে ৫০টির বেশি পদার্থ ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী। এসব কারণে তামাকের ব্যবহার প্রতিরোধ করা জরুরি। তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এবারে প্রতিপাদ্য বিষয় তামাক কোম্পানীগুলোর আগ্রাসী প্রচারণা এবং প্রমোশনাল কার্যক্রম বন্ধ করে একটি রোগমুক্ত সুস্থ সমাজ গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে পরিবারের প্রয়োজনীয় খরচ বহন করতে গিয়ে প্রায় সময় অভাবের মধ্যে দিন যাপন করতে হয়। গরিব ধূমপায়ীর আয়ের অংশ তামাকের ব্যবহারে খরচ করার কারণে খাদ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিচর্যা ইত্যাদি প্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়। পাশাপাশি তামাক ব্যবহারের কারণে অসুস্থ থাকে বিধায় চিকিৎসা খরচ তাদের জন্য একটি বাড়তি বোঝা এবং কর্মস্থলে অনুপস্থিতির কারণে পরিবারের আয়ের উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয়। যেহেতু তামাক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে একক কৌশল পুরোপুরি কার্যকর নয়, তাই সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণীর পাশাপাশি পর্যায়ক্রমে বেশি হারে কর আরোপের বিষয়টিও কার্যকর রাখতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে তামাকের উপর শতকরা ১০ ভাগ করারোপ করা হলে উন্নত দেশগুলোতে তামাকের ব্যবহার ৪ ভাগ হ্রাস পায়। অপরদিকে মধ্য ও নি¤œ আয়ের দেশগুলোতে তামাকের ব্যবহার হ্রাস প্রায় ৮ ভাগ। অতএব তামাকের উপর বেশি হারে করারোপ করা গেলে দরিদ্র জনগোষ্ঠী বেশি উপকৃত হবে যা পরবর্তীতে তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে সহায়ক হবে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে তামাকের উপর কর কাঠামো চার স্তর বিশিষ্ট। সর্বনিম্ন ৪০% এবং সর্বোচ্চ ৬০%। বিড়ির উপর সম্পূরক কর ফিল্টার থাকা না থাকা সাপেক্ষে ২০% হতে ২৫% পর্যন্ত। আগের বাজেটে সকল প্রকার আমদানী ও স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত তামাকজাত পদার্থের উপর শতকরা ১ ভাগ স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ নির্ধারণের বিষয় বলা ছিল। বাজেটে এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ এবং জনস্বার্থে উচ্চতর হারে সারচার্জ নির্ধারণপূর্বক তা আদায় করে চিকিৎসা খাতে ব্যয় করার উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা গেলে সুফল পাওয়া যাবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, তামাক কোম্পানীগুলো বেশ কৌশলী। তারা জনগণের শুভাকাক্সক্ষীরূপ ধারণ করে বৃক্ষ রোপণ কর্মসূচি, হেলথ্ ক্যাম্পের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে। এসব কর্মসূচির আসল উদ্দেশ্য হলো তামাকের বাজার ও বিক্রয় বাড়ানো। সচিত্র সতর্কবাণী ও কর আরোপের পাশাপাশি কোম্পানীগুলোর এসব কর্মসূচি প্রতিহত করা গেলে তামাকবিরোধী আন্দেলন সুফল বয়ে আনবে।
তামাকবিরোধী কার্যক্রমে বাংলাদেশের ভূমিকা বিশ্ব পরিম-লে প্রশংসিত হয়েছে। সরকারের কার্যক্রমের পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠনও সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। এদেশে তামাকবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হলো ২০০৫ সালে প্রণীত আইনের সংশোধিতে যা ২০১৩ সালের এপ্রিলে হয়েছে এবং সংশোধনীর পর ২০১৫ সালে বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। সংশোধনী আইনে জরিমানার হার ৫০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৩০০ টাকা নির্ধারণ করা, ধুয়াবিহীন তামাকজাত পদার্থ তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের আওতায় আনা, সিগারেটের প্যাকেটে সতর্কবাণী ৫০% ভাগ পর্যন্ত রাখা ইত্যাদিসহ আরো নানা কল্যাণমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে এবং গৃহীত এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়নে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল National Tobacco Control Cell (NTCC) সহ বিভিন্ন ধূমপানবিরোধী সংগঠন কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন গবেষণা, সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন শিক্ষামূলক প্রকাশনা এবং তামাক ও তামাকজাত পদার্থের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও আইনের বাস্তবায়নসহ জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের বিবিধ কাজ উল্লেখযোগ্য।
আইনের আওতায় যেখানে ধূমপান নিষিদ্ধ : পাবলিক প্লেসসমূহ : শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, শিশুপার্ক, সরকারি অফিস, আধাসরকারি অফিস, স্বায়ত্তশাসিত অফিস, বেসরকারি অফিস, গ্রন্থাগার, লিফট, আচ্ছাদিত কর্মক্ষেত্র, হাসপাতাল ও ক্লিনিক ভবন, আদালত, বিমানবন্দর ভবন, সমুদ্রবন্দর ভবন, নৌবন্দর ভবন, রেলওয়ে স্টেশন ভবন, বাস টার্মিনাল ভবন, ফেরি, প্রেক্ষাগৃহ, আচ্ছাদিত প্রদর্শনী কেন্দ্র, থিয়েটার হল, বিপণি ভবন, চতুর্দিকে দেয়াল দ্বারা আবদ্ধ রেস্টুরেন্ট, পাবলিক টয়লেট, মেলা বা পাবলিক পরিবহনে আরোহণের জন্য যাত্রীদের অপেক্ষার জন্য নির্দিষ্ট সারি, জনসাধারণ কর্তৃক সম্মিলিতভাবে ব্যবহার্য অন্য কোন স্থান অথবা সরকার বা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান কর্তৃক, সাধারণ বা বিশেষ আদেশ দ্বারা সময় সময় ঘোষিত অন্য যে কোন বা সকল স্থান। মোটরগাড়ি, বাস, রেলগাড়ি, ট্রাম, জাহাজ, লঞ্চ, যান্ত্রিক সকল প্রকার জন-যানবাহন, উড়োজাহাজ এবং সরকার গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা নির্দিষ্টকৃত বা ঘোষিত যে কোন যান। সকলে সক্রিয় হলে আইনের বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত হবে।
তামাক ও ধূমপান বর্জনের উপকারিতা অনেক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, যারা ৩০ বছর বয়সের আগেই ধূমপান সম্পূর্ণভাবে বর্জন করতে পারে তারা ধূমপানজনিত কারণে অকাল মৃত্যুর ঝুঁকি থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে। মোট কথা, একজন ধূমপায়ী যতবেশিই ধূমপান করুক, ধূমপানজনিত কারণে স্বাস্থ্যে এর যতই প্রতিক্রিয়া ঘটুক এবং তার যতই বয়স হোক না কেন ধূমপান বর্জন করার ফলে তার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে যাবার ঝুঁকিসমূহ অনেকাংশে কমে আসবে। অর্থৎ বয়সের যে কোন পর্যায়ে ধূমপান বর্জন করলে এর উপকারিতা পাওয়া যায়। (তথ্য সূত্র: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা / বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস-১৯৯৯)। ধূমপান বর্জন করার ফলে স্বাস্থ্যের উন্নতি, খাবারের রুচি বৃদ্ধি, উন্নত ঘ্রান শক্তি, অর্থ অপচয় রোধ, অধিকতর আত্মবিশ্বাস এবং পরিষ্কার শ্বাস-প্রশ্বাস ইত্যাদি উপকারিতা লাভ করতে পারেন। ধূমপান বন্ধের ফলে পিতা-মাতাগণ তাদের সন্তানদের জন্য ভালো দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন। এছাড়া নিজের ধূমপানের কারণে অন্যের ক্ষতি হবার আশংকা থেকে বিরত থাকা যায়। ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া যায় এবং তামাকের যে আসক্তি তা থেকে মুক্ত থাকা যায়।
তামাক বর্জনের অর্থনৈতিক সুফলও কম নয়। জনস্বাস্থ্যের জন্য বিভিন্ন ঝুঁকি ছাড়াও তামাক অর্থনীতিতে বিরাট অপচয় ঘটায়। দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের পথে ধূমপান ও তামাকের ব্যবহার একটি বিরাট প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। ধূমপান বর্জনের ফলে যেমন সিগারেট ক্রয়ের খরচটি বেঁচে গেলে তা দিয়ে পরিবারের পুষ্টি চাহিদা, শিক্ষার খরচসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় খরচ মিটানো সম্ভব হয়।
পরিবেশের দিক থেকে বিবেচনায় তামাকমুক্ত সমাজ স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ। উন্নত, স্বাস্থ্য ও সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে তামাকমুক্ত সমাজ গড়া প্রয়োজন। ১৯৯৮ সালে US Surgeon General’s Report এ বলা হয় যে, সিগারেট এবং তামাকের বিভিন্ন ব্যবহার আসক্তি সৃষ্টি করে। শারীরিক ও ব্যবহারগত আচরণ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, তামাকাসক্তি হেরোইন এবং কোকেনাসক্তির মতোই। হেরোইন এবং কোকেনের মতোই তামাকের নিকোটিন মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে। মনোক্রিয়াশীল মাদকের উর মান নির্ণয় করে দেখা গেছে যে হেরোইন, কোকেন, এলকোহল, কেফিন এবং গাঁজার চেয়ে নিকোটিনের প্রভাব অনেক বেশি। মানবদেহে নিকোটিন প্রধানত উত্তেজক হিসেবে ক্রিয়াশীল থাকে। নিকোটিন ব্যবহারের চরম ফলাফল হিসেবে দেখা যায় এতে হদস্পন্দন বেড়ে যায়, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তনালীর সংকোচন ঘটে। নিকোটিন ব্যবহারের ফলে রক্তে কার্বন মনোক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাবার দরুন অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায় এবং রক্তে চর্বিযুক্ত এসিড, গোকোস, এবং অন্যান্য হরমোনের পরিমাণ বেড়ে যায়। ধমনী শক্ত হয়ে যায় এবং রক্ত জমাট বেঁধে উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে হার্ট এটাক ও স্ট্রোক এর ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের উপসর্গ দেখা দেয়। নিকোটিনের সবচেয়ে মারাত্মক ফলাফল হলো এর উপর Dependency অর্থাৎ নির্ভরশীল হয়ে পড়া। একবার কেউ ধূমপানে অভ্যস্থ হয়ে পড়লে দৈহিক ও মানসিকভাবে এ বদঅভ্যাস থেকে মুক্তি পাওয়া কষ্টকর হয়ে পড়ে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে, ধূমপান গর্ভাবস্থায় মা ও শিশুর স্বাস্থ্যগত ক্ষতি সাধন করে। মায়ের ধূমপান গর্ভাবস্থায় শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করে যার ফলে শিশুর গড়পড়তা ওজন ২০০ গ্রাম কমে যেতে পারে এবং কম ওজনের শিশু জন্মদানের ঝুঁকি দ্বিগুণ করে দেয়। তাছাড়া, গবেষণায় আরো দেখা যায় যে, মায়ের ধূমপানের ফলে উচ্চ হারে ভ্রƒণ ও সদ্যজাত শিশুর মৃত্যু ঘটে। ধূমপানের ফলে Sudden Infant Deeath Syndrome-SDS অর্থাৎ হঠাৎ শিশু মৃত্যুর লক্ষণ এর সম্ভাবনা দেখা যায়। শিশু জন্মাবার পর তার চারপাশে মা-বাবার নিয়মিত ধূমপান শিশুদের শ্বাসপ্রশ্বাস তন্ত্রে প্রদাহ সৃষ্টি করে। তামাক বর্জনের উপকারিতার মধ্যে রয়েছে: হাত ও পায়ের তাপমাত্রা বেড়ে স্বাভাবিক হবে। রক্তে কার্বন মনোক্সাইডের মাত্রা স্বাভাবিক পর্যায়ে নেমে আসবে। হদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে আসে এবং রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পায়। ফুসফুসের কার্যক্ষমতা ৩০ ভাগ পর্যন্ত বেড়ে যায়। ফুসফুসের কাজের ক্ষমতা স্বাভাবিক হয়। স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ায় ঝুঁকি কমে আসবে। শরীরের কয়েকটি অঙ্গ যেমন-মূত্রথলি, বৃক্ক এবং অগ্নাশয়ের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস পায়।
কিভাবে তামাক বর্জন করবেন -  অনেক ধূমপায়ী আছেন যাদের তামাক বর্জনে সদিচ্ছার কোন ঘাটতি নেই। তামাক নেশা সৃষ্টিকারী দ্রব্য বিধায় এটা ছাড়তে কিছুটা সময়ের প্রয়োজন হতে পারে। তামাক ও তামাক-জাতীয় দ্রব্য বর্জনের ব্যাপারে চিকিৎসক বা সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনা করুন। তবে নিজের সদিচ্ছা, মানসিক শক্তি এবং দৃঢ়তার মাধ্যমে তামাক বর্জন করা যায়: ১. নিজেকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে- নিজের ইচ্ছাশক্তিকে দৃঢ় করুন, ইচ্ছাশক্তি বাড়ান এবং তামাকজাত দ্রব্য ছাড়ার জন্য একটি তারিখ ঠিক করুন। মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে যে কোন সময় তামাক ছাড়া যায়। ক্যালেন্ডারে একটি তারিখ ও সময় নির্দিষ্ট করে রাখুন এবং সে দিন ক্ষণ থেকে বর্জন শুরু করুন। ২. পারিপার্শ্বিক পরিবেশ যেমন- বাড়ি, অফিস এবং গাড়িতে কোন প্রকার তামাকজাত দ্রব্য রাখা যাবে না। তামাক গ্রহণকারী ব্যক্তিদের আশপাশে না যাওয়া ভাল। ৩. প্রেরণা ও সহযোগিতা- যেমন আপনার পরিবার-পরিজন, বন্ধু এবং সহকর্মীদের বলুন তারা যেন প্রতিনিয়ত তামাক ও তামাক জাতীয় দ্রব্য ছাড়ার ব্যাপারে আপনাকে উৎসাহিত করেন। ৪. গ্রুপভিত্তিক পদক্ষেপ- তামাক ছাড়ার ব্যাপারে দলগত পদক্ষেপ অনেক কার্যকর। এক্ষেত্রে গ্রুপভিত্তিক কার্যক্রম উৎসাহ ও প্রেরণা যোগায়। ৫. প্রয়োজনে ডাক্তার, নার্স, ফার্মাসিস্ট, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা স্বাস্থ্যকর্মীদের পরামর্শ নিতে হবে। ৬. নতুন নতুন কৌশল- ধূমপানের ইচ্ছা হলে সে সময় মনকে অন্যদিকে সরিয়ে নিতে হবে। কারো সাথে কথা বলা, হাঁটা, চলাফেরার মাধ্যমে এটা সম্ভব। ৭. তামাক বর্জনের ক্ষেত্রে মানসিক চাপ কমানোর জন্য ব্যায়াম করা, খেলাধুলা করা, বই পড়া এবং নামাজ, দোয়া, ধ্যান এবং ধর্মীয় কার্যক্রমে আত্মনিয়োগ করুন। এতে মানসিক অস্থিরতা কমে আসবে এবং তামাক ও ধূমপান বর্জনে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে। ৮. প্রচুর পানি ও বিশুদ্ধ তরল খাবার গ্রহণ করুন। ৯. প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। তামাক বর্জনের প্রথম কিছু দিন বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন- মাথা ব্যথা, বিষণœতা, ক্লান্তি, হতাশা, কোষ্ঠকাঠিন্য, বিরক্তি, ঘুম না আসা, ক্ষুধামন্দা, অস্থিরতা ইত্যাদি। তবে এ সমস্যাগুলো দৃঢ়ভাবে প্রতিরোধ করে এবং ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে তামাক ও ধূমপান বর্জন করে সুস্থ-সুন্দর ও স্বাস্থ্য-সম্মত জীবন-যাপন করা যায়।
জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম এর নেতৃত্বে ১৯৮৭ সালে ‘আমরা ধূমপান নিবারণ করি’ (আধূনিক) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ দেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রথম তামাক ও ধূমপান বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। এর ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে আরো বিভন্ন সংগঠন গড়ে উঠে। তামাক বিরোধী আন্দোলনে সরকারের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও সদিচ্ছার কারণে দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ও বিধিমালা প্রণীত হয়েছে। ধূমপানবিরোধী আন্দোলনের জন্য তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন একটি সহায়ক শক্তি। আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরি। সচেতনতা সৃষ্টিতে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলছে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ও তামাকমুক্ত সমাজ : Millenium Development Goal (MDG) অর্থাৎ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষমাত্রায় বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সাফল্যের পর Sustainable Development Goal (SDG) তথা টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা-২০৩০-এ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অন্যান্য বিষয়সহ স্বাস্থ্য খাতকে সবিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় ২০৪০ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ থেকে তামাক শতভাগ নির্মূল করার আশা ব্যক্ত করা হয়েছে। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়ের আলোকে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণীর ব্যবহার বাস্তবায়ন করা গেলে তামাকমুক্ত সমাজ গড়ার পথ সুগম হবে।
লেখক: নির্বাহী সচিব, আধূনিক (আমরা ধূমপান নিবারণ করি)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: তামাক ও ধূমপানের ক্ষতি
আরও পড়ুন