Inqilab Logo

শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ড্রেজিংয়ের পরও শুষ্ক মৌসুমে গড়াই নদীতে নাব্য সঙ্কট

পুনঃখননে ১৩৬৫ কোটি টাকা ব্যয় লুটপাটের অভিযোগ

প্রকাশের সময় : ৩০ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৩৮ পিএম, ২৯ মে, ২০১৬

এস এম আলী আহসান পান্না, কুষ্টিয়া থেকে : ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সুন্দরবনসহ দেশের উপকূলভাগে মিঠা পানির একমাত্র উৎস গড়াই নদী। সারা বছর নদীর নাব্য বজায় রাখতে গড়াই নদীর উৎসমুখ থেকে ভাটিতে প্রায় ৩০ কিমি খননে দুই বারের দু’প্রকল্পসহ তিন দফায় ১৩৬৫ কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও তাতে কাজ হয়নি। এ টাকার অধিকাংশই লুটপাট করে খেয়েছেন রাঘব বোয়ালরা। ফলে নদী খননের ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত ফল আসেনি। এ কারণে শুষ্ক মৌসুম এলেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে নদীর প্রবাহ। নভেম্বর মাসের পর উৎসমুখ থেকে নদীতে পানি প্রবাহ একেবারেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এর জন্য অপরিকল্পিত ড্রেজিং ও লুটপাটকে দায়ী করেছেন পানি বিশেষজ্ঞসহ সচেতন মহল।
পরিবেশগত দিক থেকে গড়াই নদীকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। কারণ, পৃথিবীবিখ্যাত ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন ও উপকূলীয় অঞ্চলে মিঠা পানি সরবরাহ করে লবণাক্ততা কমাতে বড় ভূমিকা রাখে এ নদী। পদ্মা নদীর প্রধান শাখা নদী হচ্ছে গড়াই। কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার তালবাড়িয়া ও মহানগর টেক এলাকা হচ্ছে গড়াই নদীর উৎসমুখ। মরণবাঁধ ফারাক্কার কারণে শুষ্ক মৌসুমে পদ্মা নদীর পানিপ্রবাহ অস্বাভাবিকভাবে হ্রাস পায়। ফলে নেমে যায় পানির স্তর। উল্লেখ্য, একদিকে পদ্মার পানিপ্রবাহ হ্রাস, অন্যদিকে বছরের পর বছর বিপুল পরিমাণ পলিমাটি ও বালি জমে দেড় যুগ আগে গড়াই নদীতে পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯৮ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার এ নদী পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে গড়াই নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্প-১ নামে ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প অনুমোদন করে। প্রকল্পের মেয়াদ ছিল দুই বছর। নেদারল্যান্ডের জিআরসি কোম্পানির মাধ্যমে জোরেশোরে প্রকল্পের কাজ শুরু হলে এলাকাবাসীর মাঝে আশার সঞ্চার হয়। তবে জিআরসি নদী খনন করে খননকৃত বালি নদীর পাড়েই রাখে যা বৃষ্টি ও বর্ষায় আবার নদীতেই মিশে গিয়ে নদী ভরাট হয়ে যায়। ফলে প্রকল্পের মেয়াদ শেষের পর দেখা যায়Ñ ‘যথা পূর্বং তথা পরং।’ এ প্রকল্পের অর্থ ব্যাপকভাবে লুটপাট হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে পদ্মার পানির স্তর নেমে যাওয়ায় গড়াই নদীর উৎসমুখে বিশাল বালিরাশি জমে পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়া অব্যাহত থাকে। তখন গড়াই নদী একেবারে মরা খালে পরিণত হয়। এর মারাত্মক প্রভাব পড়তে শুরু করে দক্ষিণাঞ্চলের নদী এবং সুন্দরবনের প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর।
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে আবার ক্ষমতায় আসার পর গড়াই নদীর পাানি প্রবাহ স্বাভাবিক রাখা, এলাকার খাদ্য নিরাপত্তা রক্ষা, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব থেকে প্রতিবেশকে মুক্ত রাখা, সুন্দরবন এলাকার লবণাক্ততা দূরীকরণ, দক্ষিণাঞ্চলে মিষ্টি পানির প্রবাহ বৃদ্ধি, সেচ সহযোগিতা প্রদান, মৎস্য চাষের সুবিধা, সুন্দরবনের বৃক্ষরাজির বিকাশ, কুষ্টিয়া-যশোর-ঝিনাইদহ-মাগুরা-ফরিদপুর ও খুলনার বিস্তৃত এলাকাকে মরূকরণ ও লবণাক্ততার হাত থেকে রক্ষাসহ আরো বেশ কয়েকটি মহৎ লক্ষ্য নিয়ে ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে ৪ বছর মেয়াদী বৃহত্তর আকারে ড্রেজিং করতে “গড়াই নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্প-২” প্রকল্প গ্রহণ করে। এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯৪২ কোটি টাকা। এ প্রকল্পের আওতায় নদীর উৎসমুখ থেকে কুমারখালি উপজেলার নন্দলালপুর ইউনিয়ন অফিস পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার পলিমাটি, মাটি ও বালি খনন করা করা হয়। চিনের চায়না হারবার কোম্পানি এ প্রকল্পের অধীনে চার বছর খনন কাজ চালায়। এ পর্যায়েও চলে ব্যাপক অর্থ লুটপাটের খেলা। এরপর ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড গড়াই নদী পুনঃখনন কাজ শুরু করে। এ জন্য দু’টি ড্রেজারও কেনা হয়। এ ড্রেজার ক্রয়েও ব্যাপক দুর্নীতি হয় বলে জানা যায়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা সাব ডিভিশনকে খনন কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়। খনন কাজের ব্যয় ধরা হয় ২৩ কোটি টাকা। কিন্তু এ পর্যায়েও চলে লুটপাটের মহোৎসব। উপর থেকে নিচ পর্যন্ত রুই-কাৎলা, জনপ্রতিনিধি, আমলা, প্রকৌশলি থেকে একবারে নি¤œ পর্যায় পর্যন্ত চলে বেপরোয়া লুটপাট। এ কারণে চলতি অর্থবছরে ভেড়ামারা সাব ডিভিশনকে বাদ দিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মানিকগঞ্জ সাব ডিভিশনকে পুনঃখনন কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়। এর সংশোধিত ব্যয় প্রাক্কলন ৬৭৬ কোটি টাকা। নদী পুনঃখনন কাজের দায়িত্ব পান প্রকল্প পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের মানিকগঞ্জস্থ নির্বাহী প্রকৌশলি মো. শহিদুল ইসলাম। তদারকির দায়িত্ব পান পানি উন্নয়ন বোর্ডের কুষ্টিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী নৈমুল হক। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মানিকগঞ্জ সাব ডিভিশন মাঝে মাঝে খনন কাজ চালায়। তবে ড্রেজারে বড় ধরনের ত্রুটি দেখা দেয়ায় মার্চ থেকে চলতি মাস পর্যন্ত তাদের খনন কাজ বন্ধ রয়েছে।
এ ব্যাপারে কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, মানিকগঞ্জ সাব ডিভিশনও খনন কাজ চালাতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা নানা অজুহাতে খনন কাজ বন্ধ রাখে। এ নদী খনন প্রকল্পের অর্থ তারাও ব্যাপক লুটপাট করেছে।
গড়াই নদীর উৎসমুখ তালবাড়িয়া-মহানগর টেক থেকে গড়াই রেল সেতু পর্যন্ত নদী প্রায় শুকিয়ে গেছে। চলতি মৌসুমেও গড়াই নদী মরাখালে পরিণত হয়েছে। অনেক জায়গায় মানুষ হেঁটে নদী পার হচ্ছে। বালিভর্তি ট্রাকগুলোও প্রায় শুকনো নদী দিয়ে আসা-যাওয়া করছে। গড়াই রেলসেতুর ভাটি অংশে নদীর অবস্থা শোচনীয়। কোথাও কোমর পানি, কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও শুকিয়ে গেছে।
নদী পাড়ের বাসিন্দা আবদুর রহমান ও শহিদুল ইসলাম জানান, নদীতে পানি নেই এটাই বাস্তবতা। শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে খননের পর যদি পর্যাপ্ত পানিই না থাকে তাহলে খনন করে লাভ কি? আমরা তো পানি পাচ্ছি না। নদীতে মাছ নেই, নৌকা চলে না, সেচের পানি মেলে না। এমনকি অেেনক স্থানে গোসলও করা যায় না। এটাই হল বাস্তবতা।
এদিকে ক্ষমতাসীন দলের নেতারাও খনন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী বলেন, প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে। অথচ নদীতে পানি থাকে না। যত টাকা নদীতে ঢালা হয়েছে তা বিফলে গেছে। খনন করা বালি নদীপাড়েই রাখা হচ্ছে। বৃষ্টিতে ও বর্ষা মওসুমে সেই বালি নদীতে পড়ে আবার যা ছিল তাই হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে অনিয়ম ও দুর্নীতিরও নানা তথ্য পাওয়া গেছে বিভিন্ন সময়।
কুষ্টিয়ার পরিবেশ ও পানি নিয়ে কাজ করেন গৌতম কুমার রায়। তিনি জানান, ‘যেভাবে ড্রেজিং চলছে তাতে গড়াইকে পুরোপুরি প্রবহমাণ করা কঠিন।’ প্রতি বছর উজান থেকে প্রচুর পলি আসছে যার বড় একটি অংশ গড়াই নদীর উৎসমুখ থেকে বেশ কয়েক কিলোমিটার ভাটি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে জমছে। এ কারণে পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাই পদ্মায় পানি প্রবাহ পর্যাপ্ত না হলে গড়াই খনন করে লাভ হবে না।
সচেতন মহলের মতে, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব থেকে প্রতিবেশকে মুক্ত রাখা, সুন্দরবন এলাকার লবণাক্ততা দূরীকরণ, দক্ষিণাঞ্চলে মিষ্টি পানির প্রবাহ বৃদ্ধি, সুন্দরবনের বৃক্ষরাজির বিকাশসহ বিভিন্ন লক্ষ্যে গড়াই নদী পুনঃখনন অতি জরুরি। এ জন্য আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহবান করে বিদেশী পানি বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে কাজটি করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে অবশ্যই শুষ্ক মওসুমের শুরু অর্থাৎ নভেম্বর থেকেই ড্রেজিং আরম্ভ করতে হবে এবং এপ্রিলের মধ্যে শেষ করতে হবে। ড্রেজিংকৃত বালি নদীপাড় থেকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, দুর্নীতি, স¦জনপ্রীতির অবসান ঘটাতে হবে। তাহলে গড়াই নদী আবার নবযৌবন ফিরে পাবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ড্রেজিংয়ের পরও শুষ্ক মৌসুমে গড়াই নদীতে নাব্য সঙ্কট
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ