Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অবিস্মরণীয় জিয়া

প্রকাশের সময় : ৩০ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ড. মুহাম্মদ সিদ্দিক
দুই বড় দলের মহান দুই মরহুম নেতাকে নিয়ে তাদের অনুসারীদের ভিতর চলছে অগ্রহণযোগ্য বাকবিতন্ডা। যেভাবে তাদের নিয়ে মন্তব্য করা হয়, মনে হয় তাতে যেন দুজনই আমাদের ইতিহাসে অপাংয়ের। অনেক অপবাদের সঙ্গে বলা হয়, একজন পাকিস্তানের চর, আরেকজন ইন্ডিয়ার। অথচ কেউই কারও চর ছিলেন না। এটা ঐতিহাসিক তথ্য দিয়ে প্রমাণ করা যায়। শহীদ জিয়া যদি পাকিস্তানের চর হতেন তাহলে বঙ্গবন্ধু কি তাকে ডেপুটি চিফ অব আর্মি স্টাফ করতেন, বীরত্বের পদক দিতেন? এভাবে চরিত্র হনন ঠিক নয়।
জিয়া সম্পর্কে বলা হচ্ছে, তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না, পাকিস্তানের এজেন্ট ছিলেন ইত্যাদি। অথচ তিনিই সংঘবদ্ধ একটি বাঙালি সেনা কনটিনজেন্ট নিয়ে বিদ্রোহ করেন। তিনি সে মুহূর্তে তার পরিবারের কথাও ভাবেননি। দুই মহান নেতার পরিবার যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত গৃহবন্দি ছিলÑ এক পরিবার ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে, আরেক পরিবার ধানম-িতে।
পাকিস্তান বিমান বাহিনী যে প্রথম বিমান আক্রমণ করে বোমাবর্ষণ করে তা জিয়ার অবস্থান লক্ষ্য করেই। সেই প্রাথমিক আক্রমণেই তিনি শেষ হয়ে যেতে পারতেন। অথচ তাকে অযথা গালাগাল করা হয়। কোনো এককালে তার সামরিক গোয়েন্দাতে পদায়ন হয়, সে খোটাও দেওয়া হয়। অথচ সামরিক বাহিনীতে পালাক্রমে (বাই রোটেশন) প্রায় সব অফিসারকে গোয়েন্দা দফতরগুলোতে কাজ করতে হয় অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য। গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ সামরিক বাহিনীর অন্যতম কর্তব্য। কর্নেল জামিল পাকিস্তানে সামরিক গোয়েন্দা বিভাগে এক সময় কর্মরত ছিলেন। তাতে কী হয়েছে? তিনি তো দেশে ফিরে এসে প্রেসিডেন্টের ডাকে তাকে রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন। যাই হোক, জিয়ার স্বল্পকালীন পাকিস্তান গোয়েন্দা দফতরে পদায়ন কোনো অপরাধ ছিল না। তার রেডিও ঘোষণাই বাঙালি সেনা সদস্যদের দ্বারা মুক্তিযুদ্ধের সামরিক কার্যক্রম শুরুর রণভেরির আওয়াজ ছিল। ইংরেজিতে বলা হয়, ‘হু বেল দি ক্যাট’ (বিড়ালের গলায় কে ঘণ্টা লাগাবে?’)। অকুতোভয়ী জিয়াই বাস্তব যুদ্ধ শুরু করেন তার বাহিনী নিয়ে। এ ইতিহাস অস্বীকার করা খুবই দুঃখজনক হবে। জিয়া কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথমে নিজের নামে, পরে বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতা ও যুদ্ধের ঘোষণা দেন। মেজর জলিল তার এক নিবন্ধে লেখেন, এটা ছিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের মতো আর কি। পরবর্তীতে ১৭ এপ্রিল ১৯৭০ মুজিবনগর সরকার গঠনের আগ পর্যন্ত জিয়ার ঘোষণার মাধ্যমে বাঙালি সৈনিকরা যুদ্ধ করার আইনগত ভিত্তি (কভারেজ) পায়। জিয়ার ঘোষণাকে পরবর্তীতে ইন্ডিয়ান প্রেসিডেন্ট সঞ্জীব রেড্ডি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিয়া গান্ধী স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। যাই হোক, জিয়ার কালুরঘাটের ঘোষণা বঙ্গবন্ধুর প্রতি কোনো অশ্রদ্ধা ছিল না। এটা তিনি ইন গুড ফেইথে করেন। তাই বঙ্গবন্ধু এ নিয়ে জিয়ার সমালোচনা করেননি। জিয়ার প্রেসিডেন্ট হওয়ার কোনো খায়েশ ছিল না।
জিয়ার যে প্রেসিডেন্ট হওয়ার খায়েশ ছিল না তার আরেক প্রমাণ রয়েছে। ১৯৭৫ সালে ৩ থেকে ৭ নভেম্বরের কথা। এ নিয়ে বিএনপি নেতা সাবেক এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ১৯ নভেম্বর ২০১৫ টিভি টকশোতে বলেন, কর্নেল (অব.) জাফর ইমাম (যিনি ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের ঘনিষ্ঠ ছিলেন) এক বইয়ে লিখেছেন, ব্রিগেডিয়ার খালেদ বন্দি জিয়ার নিকট প্রস্তাব পাঠান যে, জিয়া হবেন প্রেসিডেন্ট আর খালেদ সেনাপ্রধান। জিয়া এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এমন কি সেই ৭ নভেম্বরের ডামাডোলে কর্নেল তাহের জিয়াকে সামরিক আইন প্রশাসক, এমন কি রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রস্তাব রাখেন। এ সম্পর্কে জাসদ নেতা মহিউদ্দিন আহমদ লেখেন “৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান, জাসদ গণবাহিনীর হঠাৎ জড়িয়ে পড়া, জিয়ার সঙ্গে তাহেরের সখ্য এবং পরিণামে প্রতারণার শিকার হওয়াÑ এসব দলের মধ্যে অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। এ ছাড়া তাহেরের আগ বাড়িয়ে জিয়াকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, এমন কি রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া নিয়েও বিতর্ক হয়।” (জাসদের উত্থান পতন : অস্থির সময়ের রাজনীতি, পৃষ্ঠা ২২১)।
জিয়া যদি তাহেরের সঙ্গে সমঝোতা করতেন তাহলে ৭ নভেম্বরেই তিনি প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন। কিন্তু জিয়া সে সমঝোতা করে পদ নেননি। তিনি বুঝেছিলেন যে, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র একটা মুসলিম দেশে চলবে না। জনগণ ধর্মের বাইরে যাবে না। মহিউদ্দিন লেখেন, “তার গোটা মেয়াদকালে জিয়া বাইরের রাজনৈতিক শক্তির চেয়ে সেনাবাহিনীর লোকদের কাছ থেকে অনেক বেশি বিরোধিতার মোকাবিলা করেছেন। তাকে ১৭-১৮টি অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা সামাল দিতে হয়েছিল। এসবের মধ্যে শেষটিতে তিনি নিহত হন।” (পৃ. ২৪০)।
এই যে ঘন ঘন অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা, তারও কারণ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। বঙ্গবন্ধু তাদের দমন করতে একদলীয় বাকশাল করলেন, যদিও তিনি বাকশাল না করেও এই সমস্যার সমাধান করতে পারতেন, যেহেতু তার নিয়ন্ত্রণে পার্লামেন্ট, ক্যাবিনেট, দল, সামরিক বাহিনী, রক্ষীবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ ইত্যাদি সবই ছিল। দেশে-বিদেশে তার জনপ্রিয়তা ছিল। যে সমস্যা বঙ্গবন্ধু মোকাবিলা করেন সেই সমস্যা জিয়াকেও মোকাবিলা করতে হয়। দুজনের সরকারকেই উৎখাতের চেষ্টা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত উৎখাতকারীরা সফল হয়নি। মাঝখান থেকে ছোট দেশ বাংলাদেশের দুই বড় মাপের নেতার সেবা থেকে দেশ বঞ্চিত হলো।
জিয়া শহীদ হওয়ার আগে একটা চেষ্টা নিয়েছিলেন পরিস্থিতি শান্ত করতে। তবে সব বিফলে যায়। সিরাজুল আলম খান ১৯৮০ সালের মে ময়মনসিংহ জেল থেকে ছাড়া পান। মহিউদ্দিন লেখেনÑ “জিয়াউর রহমান সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। জিয়ার সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের সাক্ষাতের ব্যবস্থাটি করে দিয়েছিলেন মেজর জলিল (যিনি ১৯৮০ সালের ২৪ মার্চ জেল থেকে ছাড়া পান) ” (পৃ. ২৪০)
সাক্ষাৎ হয় ১৯৮১ সালের ৯ মে রাত ১২টার পর জিয়াউর রহমানের বাসায়। মহিউদ্দিন লেখেনÑ “জিয়াউর রহমান ও সিরাজুল আলম খানের মধ্যে এটাই প্রথম ও শেষ সাক্ষাৎ। এরপর ২০ দিন পর জিয়া নিহত হন। সেপ্টেম্বরে সিরাজুল আলম খান লন্ডনে চলে যান। ফিরে আসেন এগার মাস পর” (পৃ. ২৪০)। লে. কর্নেল এম এ হামিদ (অব.) লেখেন, “১৯৮১ সালে চট্টগ্রামে সেনাঅভ্যুত্থানে নিহত হলেন জেনারেল জিয়া । ... চট্টগ্রাম অভ্যুত্থান প্রকৃতপক্ষে সেনাঅভ্যুত্থান ছিল না। ৩ নভেম্বরের মতো। এটা অফিসারদের দ্বারা পরিচালিত একটি ‘অফিসার্স অভ্যুত্থান’ আখ্যা দেওয়া যেতে পারে, যেখানে সৈনিকদের স্বার্থ সামান্যই জড়িত ছিল। সবগুলো অভ্যুত্থানই ছিল প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতার লড়াই। চট্টগ্রাম অভ্যুত্থানও ছিল তাই, কিন্তু পর্দার আড়ালে নেপথ্যে থেকে কোন ক্ষমতাধর ব্যক্তি কলকাঠি নেড়েছেন, তা সবার কাছে আজও অজ্ঞাতই থেকে গেছে।”
জিয়া সম্পর্কে একটা অপবাদ দেওয়া হয় যে, তিনি পররাষ্ট্রনীতিতে পাকিস্তানপন্থি হয়ে পড়েছিলেন। এটা অযৌক্তিক অপবাদ। তথ্য দিয়ে প্রমাণ করা যেতে পারে যে, শহীদ জিয়ার পররাষ্ট্র নীতি বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্র নীতির ‘এক্সটেনশন’ (বর্ধিতরূপ)। শুধু তিনি এতে “ফাইন টিউনিং” (সুরেলা/মার্জিত) করেন। বঙ্গবন্ধু শেষ দিকের পররাষ্ট্রনীতি এমন হয়ে পড়ে যে, ইন্ডিয়া নাখোশ হয়ে পড়ে। এ সম্পর্কে জানতে হলে বাংলাদেশে ইন্ডিয়ার সাবেক হাইকমিশনার ও ইন্ডিয়ার সাবেক পররাষ্ট্র সচিব জে এন দীক্ষিতের “লিবারেশন অ্যান্ড বিয়ল্ড” বইটি পাঠ করুন। দীক্ষিত অভিযোগ করেন, শেখ ইন্ডিয়ার পরামর্শ মানছেন না। আর শেখ সাহেব দেশে বলছেন, তিনি কি তাঁবেদার প্রধানমন্ত্রী হবেন? যে নেতা পাকিস্তান আন্দোলনে এত বড় অবদান রাখার পরও পাকিস্তানের সামরিক নেতাদের বেইনসাফির জন্য তাঁবেদারি করতে অস্বীকৃতি জানান, তিনি অখ- ভারতের নেতাদের নিকট তাঁবেদারি করবেন, এটা অচিন্তনীয়। বঙ্গবন্ধু কখনই কারো তাঁবেদার হওয়ার মতো ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। তিনি পররাষ্ট্র নীতিতে ভারসাম্য আনতে, দেশকে সত্যিকারের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি দিতে দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্রের ঘোষণা দেন, বিদেশি সেনা হটান, ক্যাবিনেট পুনর্গঠন করেন, ওআইসিতে যোগদান করেন, মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠা করেন, স্বীকৃতি না থাকা সত্ত্বেও চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব সম্পর্ক রাখেন, যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, ভুট্টোকে ঢাকায় এনে তাকে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল চড়াতে বাধ্য করেন, নজরুলকে এনে জাতীয় কবির মর্যাদা দেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন সৃষ্টি করেন এবং আরও অনেক কিছু করেন বাংলাদেশের আলাদা স্বাধীন বৈশিষ্ট্য সৃষ্টিতে। শহীদ জিয়া এসব নীতি নিয়েই আরও এগিয়ে যান। বরঞ্চ ইন্ডিয়াকে সঠিক স্থানে আনতে সার্ক গঠনের উদ্যোগ নেন। এই ছিল জিয়ার পররাষ্ট্র নীতির ‘ফাইন টিউনিং’। বঙ্গবন্ধুর “সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারও বিরুদ্ধে শত্রুতা নয়” এই পররাষ্ট্র নীতির স্পষ্ট রূপ আমরা পাই শহীদ জিয়ার পররাষ্ট্রনীতিতে।
লেখক : ইতিহাসবিদ, গবেষক ও সাংবাদিক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: অবিস্মরণীয় জিয়া
আরও পড়ুন